২৫শে ডানা -

২৫শে ডানা

‘ডানা’র রজত জয়ন্তী বর্ষে পদার্পন অনুষ্ঠান।

দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

মানুষ কোন বয়সে সবচেয়ে সুখী? আমেরিকার স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটি ৩ লাখ ৪০ হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে এই প্রশ্ন নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে যে উত্তরটি পেয়েছিল তা হল, বছর কুড়ি বয়সে সুখ ও আনন্দের বহর সবচেয়ে বেশি। কারণ, দু চোখে তখন অজস্র স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ জীবনে সাফল্যের হাতছানি। অন্যদিকে ৩০-৫০ বছর বয়সের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সুখের মাত্রা কমে যায়। জীবিকার চাপ, সংসারের দায়দায়িত্ব সব কিছু নিয়ে তখন যথেষ্ট নাজেহাল অবস্থা। আশা এবং আশাভঙ্গের নৈরাশ্য। আবার ৮৫ বছরে পৌঁছে মানুষ ফিরে পায় সেই ফেলে আসা ২০ বছর বয়সের আনন্দ। তখন নতুন করে আর কোনও দায় দায়িত্ব নেই। শরীরটুকু ঠিক থাকলেই সর্বসুখ। মানুষের মনের কাছাকাছি থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গড়ে ওঠা পরামর্শদাতা সংস্থা ‘ডানা’র রজত জয়ন্তী বর্ষে পদার্পন উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যায় বিড়লা অ্যাকাডেমি সভাঘরে আয়োজিত হয়েছিল একটি আলোচনাচক্র — ‘বয়স বাড়লেই বুড়ো!’ সেই বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই তথ্য তুলে ধরেন সংস্থার সঙ্গে জড়িত বিশিষ্ট মনোবিদ এবং আকাশবাণী ও দূরদর্শনের প্রাক্তন পদস্থ আধিকারিক ডঃ অমিত চক্রবর্তী। তিনি বলছিলেন, ছোটবেলায় মানুষ বড় হতে চায়, কিন্তু একটা বয়সের পরে আর বুড়ো হতে চায় না। প্রকৃতির নিয়মে বয়স বাড়লেও, শরীর অশক্ত হলেও মনের বিকাশ কিন্তু আমৃত্যু রুদ্ধ হয় না। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিচার বুদ্ধি বাড়ে। মার্কিন মনোবিদ এরিক এরিকসনের গবেষণায় এটি প্রমাণিত। ৮৯ বছর বয়স্ক সমাজকর্মী রীনা গুহ বলেন, বয়স বড় কথা নয়, জীবনের যে কোনও লগ্নে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে বেঁচে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। আকাশবাণীর প্রাক্তন আধিকারিক ও প্রাবন্ধিক কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত বলেন, বুড়িয়ে যাওয়া যে কোনও বয়সেই হতে পারে যখন নানা বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে যায়। বয়স্ক মানুষের ইচ্ছে বা শখ-সাধের প্রতি সমাজ সহানুভূতিশীল হলে মানুষ হয়তো বয়স হলেই বুড়ো হতে চাইবে না। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও আকাশবাণীর প্রাক্তন আধিকারিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু চারপাশে এত বুড়ো দেখিনি।’ হালকা চালেই তিনি বলছিলেন, ‘কলতলা যবে ওয়াশরুম হল, লুকিয়ে চুরিয়ে যে সিগারেট খাওয়া শুরু ডাক্তারের কথায় তা ছেড়ে দেওয়া কিংবা ওপর থেকে কী করছিস, নেমে আয় থেকে অনলাইনে আয় — এমন সব রূপান্তরের মাঝেই বুড়ো হলাম।’ স্বপ্নময় বলছিলেন, এক সময় আকাশবাণীতে প্রবীণদের জন্যে অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল, ‘জীবন সন্ধ্যা’। তিনি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার পর অনুষ্ঠানের নাম বদলে হয় ‘মাননীয়াসু’। সংস্থার অন্যতম সহযোগী ও বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক ডাঃ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, যে কোনও ক্ষেত্রে সৃজনশীল থাকতে পারার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী রত্না মিত্রের সংক্ষিপ্ত কিন্তু মনোজ্ঞ সঞ্চালনা ছিল অনুষ্ঠানের বাড়তি আকর্ষণ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল ‘বসুন্ধরা’ প্রযোজিত পাঠ ও সংগীতানুষ্ঠান ‘দুঃসময়’। ‘ছবির ভাবনা’ বিষয়ে বার্ষিক স্মারক ভাষণ দেন শিল্পী ও মনোচিকিৎসক ডাঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য। রবিবার সন্ধ্যায় সমাপ্তি অনুষ্ঠানে রয়েছে বিতর্ক – ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজের কথাই বেশি ভাবে’, ‘ভালো আছি, থাকব’ বিষয়ে বলবেন ডঃ অমিত চক্রবর্তী আর সবার শেষে রত্না মিত্র পরিচালিত ও পরিবেশিত কথা-কবিতা-গানের অনুষ্ঠান।

মার্ক অ্যাগ্রোনিন বছর ছয়েক আগে ‘দ্য এন্ড অব ওল্ড এজ’ বই লিখে দুনিয়া জুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কারণ, বার্ধক্যের প্রচলিত সংজ্ঞা তিনি বদলে দিয়েছেন। প্রবীণত্ব বা বার্ধক্য যে প্রজ্ঞার জন্ম দেয় তার মাধ্যমে সমাজে অনেক গঠনমূলক কাজ করা যায়। সুতরাং বয়স্ক মানুষ পরিবারের কাছে বা সমাজের কাছে বোঝা না হয়ে বরং হয়ে উঠতে পারেন কার্যকরি সম্পদ। প্রয়োজন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। ‘ডানা’ আয়োজিত শনিবার সন্ধ্যার আলোচনা বয়স্কদের বাড়তি না ভেবে একটু অন্য চোখে দেখতে সাহায্য করবে।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *