অনিরুদ্ধ সরকার
মোনা….আজ সোশ্যাল সাইটে তোর চিকেন মাঞ্চুরিয়ানের যে ছবিটা দেখলাম। জাস্ট অসম। থ্রিকে লাইক। হাজার কমেন্টস।কি করেছিস রে তুই। আমার তো দুশো পার হয় না। তাতেও কতজনকে তোষামোদ করতে হয়।
– কি যে বলো দেবযানী দি।
আরে মোনা তুই যা দিস সেটাই হিট। তোর ফ্যান ফলোয়িং দেখে তো হিংসে হয় রে।
আরে তোমারও হবে তুমিও সব দেখাতে শুরু করো। মানে সকালে বাথরুম যাওয়া থেকে শুরু করো কি সাবান কি পেস্ট কি থালা কি বাটি কি খাচ্ছো কি লাগাচ্ছো আই মিন ক্রিম! সব দাও সব দেখো দুদিনে তোমার ফলোয়িং কোথায় যায়। আর ব্রাণ্ডেড জিনিসপত্র নিয়ে ছবি দাও। ব্যাস তাহলেই হিট।
বলছিস।
আরে হ্যাঁ গো।
তুমি করেই দেখো না।
মোনার ছেলে স্কুল থেকে ফিরল।
আরে গুবলু তুই তো মাটন খেতে ভালোবাসিস। আমি আনতে গিয়েও আনলাম না। তোর মা আজ চিকেন মাঞ্চুরিয়ান বানিয়েছে। তোর মায়ের মাঞ্চুরিয়ানের কাছে কি আর আমার ঘরোয়া মাটন কষা ধারে কাছে লাগে। আচ্ছা এলাম রে বাবু।
এদিকে খাবার টেবিলে গুবলু দেখে একথালা ভাত একবাটি ডাল আর পাশে কুমড়োর ঘ্যাঁট।
গুবলু তো মেনু দেখে খাপ্পা।
– মাম্মি…মাম্মি….
দেবযানী আন্টি যে বলল তুমি চিকেন মাঞ্চুরিয়ান বানিয়েছো?
কোথায় মাঞ্চুরিয়ান ?
তুই ও যেমন! দেবযানী আন্টিরও কাজ নেই কি বলতে কি বলেছে। তুই খেয়ে নে আমি সিরিয়ালে বসব। সন্ধ্যায় আবার সাইটে রিভিউ দিতে হবে।
অফিস থেকে মোনার বর দীপ রাতে বাড়ি ফিরল।
ডিনার টেবিল। খেতে বসে দীপ জিজ্ঞাসা করল মোনাকে
– চিকেন মঞ্চুরিয়ান কোথায়? এতো ভাত ডাল কুমড়োর ঘ্যাঁট!
-মাঞ্চুরিয়ান?
তুমি কি যা-তা বলছো। নেশা টেশা করছো নাকি? না-কি বস চাপ দিচ্ছে বেশি। হ্যাঁ। এই খাবার জুটছে তাই না কত। প্রাইভেট ব্যাঙ্কের চাকরিতে আর মাঞ্চুরিয়ান খেতে হবে না!
– তার মানে তুমি মাঞ্চুরিয়ান বানাও নি?
কিসের মাঞ্চুরিয়ান…
তোমার সোশ্যাল সাইটে তাহলে এটা কি?
এই বলে দীপ মোবাইল বের করল। এই যে তুমি
মাঞ্চুরিয়ানের ছবি পোস্টেছ! এটা কী?
এটা তো নেট থেকে দেওয়া। আমার রান্না লিখে পোস্ট করেছি। কি হয়েছে তাতে। ও তো আমি হামেশাই করি। ‘সংগৃহীত’ লেখাটা সযত্নে তুলে দিই। কি লেখা… কি ছবি…সবই ঝাড়া। আর সেগুলো সবই আমার মৌলিক প্রতিভা বলে লোকে জানে। দেখো বাজারে পপুলার হতে গেলে অন্যের প্রতিভাকে নিজের বলে চালাতে হয়। এই খেলা সোশ্যাল সাইটে আমাদের মত মেয়েরা শিখে নিয়েছে। এই যে বস্তা ভরে ক্রিয়েটিভিটির নামে অন্যের ছবি, গল্প, ভাবনা সব ঝেঁপে দিয়ে দিনে দিনে সেলিব্রেটি তৈরি হচ্ছে…..পুরানো ব্যক্তিত্বদের নিয়ে পড়াশোনা রিসার্চ না করে ‘ড্রইং রুমের সিরিয়াল’ বানানো হচ্ছে। নিজেই নিজেকে পুরস্কার দিচ্ছে
তাতে কার কি আসছে যাচ্ছে! এসবেরই এখন ক্রেজ। কেউ গভীরে ঢোকে না। যেটা দেখে সেটাই ভাবে বিশ্বাস করে। আর একে অন্যের পিঠ চাপড়াতে ব্যস্ত। তুমি অত ভেবো না। প্রেসার বেড়ে যাবে।
– তুমি জানো তোমার এই পোস্ট দেখে অফিস কলিগরা আমার পকেট ফাঁঁকা করে দিল । তোর বউ বানিয়েছে। তুই কি লাকি…. হ্যানা ত্যানা….. তুই তো আর বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়াবি না। তাহলে আমাদের অফিসেই খাওয়া। কি করব খাওয়াতে হল।
তোমার এই লোককে দেখানো অভ্যাসটা ছাড়ো মোনা। দেখবে কোনদিন এটার জন্য আমরা বিপদে পড়ব। তোমার অবস্থাটা হয়েছে অনেকটা হাওয়া ভরা চিপসের প্যাকেটের মত। চিপসের প্যাকেটে তাও দুটো চারটে চিপস থাকে তোমার তো পুরোটাই হাওয়া৷ তোমাকে কিছু বলাটাই বৃথা।
– বাবা বাবা জানো তো দেবযানী আন্টিও বলল তোর মা মাঞ্চুরিয়ান বানিয়েছে বলে আর মাটন টা দিলাম না।
আচ্ছা বাবু, কুমড়োর ঘ্যাঁটটাই মাঞ্চুরিয়ান ভেবে ভেবে এখন খেয়ে নাও কেমন।
মোনা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
– “দেখো বাপু এখন বিজ্ঞাপনের যুগ।আমি তোমাদের মত ওই মিডিলক্লাস হাভাতে গোছের থাকতে পারব না।আর হ্যাঁ আমি কি দিচ্ছি হাওয়া না চিপস তাতে তোমার কী? তোমার তো পয়সা লাগছে না। ও তো আমি আর আমার অ্যাপের কামাল। নেটে সেগুলোও খুঁজতেও প্রতিভা লাগে। বুঝেছো। ইউ ডোন্ট নো হোয়াট ইজ সোশ্যাল স্ট্যাটাস। সারাদিন তো মুখ গুঁজে অফিসের কাজ নিয়ে পড়ে থাকো। নিজের কাজ করো। বেশি জ্ঞান দিও। ভালো লাগে না।”
মোনা আসলে ঘুম থেকে উঠেই লেগে পড়ে ফটো সেশনে। দুনিয়ার অ্যাপ ঘেঁটে নিজের হাজার সেলফি তুলে খেয়াল মত ব্যাকগ্রাউন্ড ডিজাইন করে নেয়। আর সেটা পোস্ট করে। আজ প্লেন তো কাল রিসর্ট। আর সুযোগ পেলেই সেলেব’ দের সঙ্গে ছবি তোলার নেশা তো আছেই। এদিক সেদিক উৎসব অনুষ্ঠানে কোনো ছবিই বাদ যায় না। শপিং মলের ট্রায়াল রুমে ব্রাণ্ডেড ড্রেস ট্রায়ালের ছবিগুলো যত্ন করে রেখে দেয় ধীরেধীরে ব্যাকগ্রাউণ্ড চেঞ্জ করে পোস্ট করে। অন্যের বাড়ি….. অন্যের গাড়ি….
কুছ পরোয়া নেই সবই মোনার। ‘অ্যাঞ্জেল মোনা’ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের রাণী।হাজারো ছেলে মোনার একটা ‘হাই’ এর উত্তরের অপেক্ষায় থাকে আর উত্তর না মিললে ‘হায় হায়’ করে ওঠে । আর মোনা মজা নেয়। মোনার কথায় অ্যাঞ্জেল মোনা যেটা করে সেটাই ট্রেণ্ডস।
এদিকে পুজোর ছুটিতে মোনা বেড়াতে গেল সপরিবারে গোয়া। মোনা দীপকে বলল, তুমি এই এক সপ্তাহ ফোনটা একটু অফ রাখবে?
কেন?
আসলে আমি সোশ্যাল সাইটে গোয়ার ছবির জায়গায় সিঙ্গাপুর পাটয়ার ছবি দিয়ে ফেলেছি। দুটো সমুদ্রের জলে বেশ মিল আছে তো তাই।
তো বুঝতেই পারছ সেন্টিমেন্টের ব্যাপার আছে।
মানে?
আমরা গোয়ায় নেই! আছি পাটয়ায়… সিঙ্গাপুরে।ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর। মাই গড। –লোককে দেখাতে দেখাতে পাটনা আর পাটয়ার পার্থক্য বোঝো না তুমি। ঝাঁঝিয়ে ওঠে দীপ।
সব বুঝি ডার্লিং। তুমি এই কথাটা রাখো তাহলেই হবে লক্ষ্ণীটি।
দীপ তো সব শুনে থ বনে যায়।
-কিন্তু মোনা ফোন বন্ধ রাখাটা চাপের। অফিসের দরকার থাকতে পারে কিম্বা কোনো আপদ বিপদ।
-আরে দূর ছাড়ো তোমার আপদ বিপদ।
কিচ্ছু হবে না। এমনিতেও আমায় সময় দাও না। এখানে দাও অন্তত। প্লিজ। এই বলে দীপের ফোনটা মোনা কাড়িয়ে নেয়।
একের পর এক গোয়ার বুকে থেকে সিঙ্গাপুরের এডিটেড ছবি পোস্ট হচ্ছে মোনার। লাইক কমেন্টসের বন্যা বইছে। ওয়াও। মু আ……. আরও কত কী…..
সাতদিন পর বাড়ি ফিরে মোনা দীপ দুজনেই অবাক। বাড়ির সামনে একভ্যান পুলিশ।
কি হয়েছে দেখতে এগিয়ে গেল দীপ। ঘরে ঢুকেই দীপের তো চোখ তো ছানাবড়া। ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। চোর ঝেঁটিয়ে সব নিয়ে গেছে । আলমারিতে ব্যাঙ্কের একটা মোটা টাকা রাখা ছিল তাও বেমালুম হাওয়া। মাথায় হাত পড়ে গেল দীপের।
পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করল, “গেছিলেন কোথায়?”
এবার দীপ পড়ল মহাফাঁপড়ে। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মোনা এসে বলল, “আমরা সিঙ্গাপুর গেছিলাম।” পুলিশের বড়বাবু বলল, ” আপনি কি সব সোশ্যাল সাইটে আপলোড করেন?”
হ্যাঁ মোটামুটি।
-“সেকারণেই এই চুরিটা হয়েছে ম্যাডাম।”
আপনি ঘটা করে ঘন্টায় ঘন্টায় পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানিয়েছেন আপনি কি করছেন কোথায় আছেন? আর সেই সুযোগটাই নিয়েছে চোর।
এদিকে পাশের বাড়ির বিল্টু এসে দীপকে বলল
,”তোকে অনেকবার ফোন করেছি।ফোন সুইচ অফ বলছিল।”
মোনার প্রতিবেশী দেবযানী ব্যালকনি থেকে সব দেখে মনে মনে বলল, এবার আমার প্রোফাইলে রিচ বাড়বে।
শেয়ার করুন :