অনিরুদ্ধ সরকার
চলে আসি কলকাতায় বাজার তৈরির গল্পে। যদিও সে ইতিহাস বড়ই আবছা। অনুমানিক ১৫৩০ সাল নাগাদ বাংলায় পর্তুগিজদের যাতায়াত শুরু হয়। সেযুগে আদিগঙ্গা ছিল সমুদ্রে যাতায়াতের অন্যতম পথ। এই নদী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে যে-তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল, গোবিন্দপুর ছিল তার অন্যতম। গোবিন্দপুর ছাড়া অন্য দুটি গ্রাম ছিল সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা।
কলকাতা মহানগরীর প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা তাদের নিজস্ব পরিচিতি হারায় এবং নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের সময় গোবিন্দপুর গ্রামটি ধ্বংস করে ফেলা হয়।গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে, ‘গোবিন্দ দত্ত’ নামে এক ব্যক্তি এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীর্থে যাচ্ছিলেন। দেবী কালী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দেন এবং আদেশ করেন নদীর তীরবর্তী পরিত্যক্ত ভূভাগ খনন করতে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তিনি কাজ শুরু করেন। গোবিন্দ দত্ত মাটির নিচ থেকে প্রচুর ধনসম্পত্তি উদ্ধার করেন। গোবিন্দ দত্ত সেখানেই থেকে যান আস্তানা বানান । তাঁর নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয় ‘গোবিন্দপুর’।
শোনা যায়,জোব চার্নক সুতানুটির নিরাপদ অবস্থানের জন্য সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। সেযুগে সুতানুটির পশ্চিমে হুগলি নদী এবং পূর্বে ও দক্ষিণে দুর্গম জলাভূমি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব অংশে প্রহরার প্রয়োজন পড়ত। সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর ছিল মুঘল সম্রাটের খাসমহল অর্থাৎ সম্রাটের নিজস্ব জায়গির বা ভূসম্পত্তি। এই অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব ছিল বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উপর। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর জব চার্নকের উত্তরসূরি তথা জামাতা চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের থেকে এই তিনটি গ্রামের জমিদারির অধিকার কিনে নেন। এরপরই কলকাতা মহানগর দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়মিত এই অঞ্চলের রাজস্ব মুঘল সম্রাটকে দিয়ে এসেছিল। বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতায় দুর্গপ্রতিষ্ঠা ও সামরিক আয়োজনে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ ও অধিকার করে নেন। এই সময় ইংরেজরাই গোবিন্দপুরে অগ্নিসংযোগ করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। নদীর চল্লিশ মাইল ভাটিতে ফলতায় তাঁরা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পরই তারা কলকাতার অধিকার পুনরায় ফিরে পেয়েছিল।
কলকাতায় ফিরে এসে ব্রিটিশরা যে কাজটি করেছিল তা হল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পুনর্নির্মাণ। ১৭৫৮ সালে এই কাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৭৭৩ সালে। দুর্গনির্মাণের জন্য বেছে নেওয়া হয় বর্ধিষ্ণু গোবিন্দপুর গ্রামের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটিকে। সুতানুটি-হাটখোলায় সেযুগে বেশ বড় একটা হাট বসত আর পর্তুগীজদের সঙ্গে এই হাটের কেনাবেচা চলত। সারা ইউরোপে বাংলার মসলিন সিল্ক,নীল আর মসলার চাহিদা ছিল প্রবল। এখানকার হাট থেকে সস্তায় কিনে নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে পারলে প্রচুর লাভ হয় একথা বুঝতে পারল পর্তুগিজরা। আর তারপর থেকেই এই হাটে বিক্রি বাড়তে থাকে।
ষোড়শ শতকে পর্তুগীজদের ব্যবসা বাণিজ্য ধীরেধীরে বৃদ্ধি হতে লাগল এই অঞ্চলজুড়ে, আর সপ্তদশ শতক থেকে ডাচ ,ডানিস আর ফরাসিদের আনাগোনা শুরু হল এই অঞ্চলে। সবশেষে এল ‘ইংরেজরা’, রাজার জাত বলে কথা তাই শেষ হাসিটা তারাই হাসল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যকুঠি গড়ে তুলল এই অঞ্চলে। তারপর ধীরেধীরে এলেন জোব চার্নকের মত লোকেরা। জোব চার্নক যখন কলকাতায় বসবাস করা শুরু করেছেন তখন সুতানুটি গোবিন্দপুর আর কলকাতা নামের তিনটি অঞ্চলই ছিল জলা-জঙ্গল আর সেখানে ছিল জন্তু-জানোয়ারের আধিক্য।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে ধীরেধীরে ব্যবসা বাড়ানোর ফলে বাড়তে থাকে লোকসংখ্যা। ধীরে ধীরে গ্রামের মোড়ক ছেড়ে সুতানুটি গোবিন্দপুর আর কলকাতা হয়ে ওঠে আস্ত এক শহর। গড়ে উঠতে থাকে ‘প্রাসাদ’। কলকাতার নতুন নাম হয় ‘প্রাসাদ নগরী’। ইংরেজ ছাড়াও এদেশের ধনীরাও নিজেদের মত করে বাজার তৈরি করলেন। কারণ এই সমস্ত বাজার থেকেই তাদের রোজগারের পরিমাণ ছিল প্রচুর।
পরমেশ্বরণ থাঙ্কাপ্পন নায়ারকে বলা হয় ‘কলকাতার খালি পায়ের ঐতিহাসিক’। সেই নায়ারের কথায়, “বড়বাজার এলাকাটা ছিল সুতানুটিতে। এখনকার ডালহৌসি স্কোয়ারও সুতানুটিরই অংশ ছিল। আর গোবিন্দপুর গ্রামটি ছিল এখনকার ময়দান –ফোর্ট উইলিয়াম এলাকা। আর গোবিন্দপুরের পূর্ব দিকে, ছিল কলকাতা গ্রাম। গোবিন্দপুরে প্রচুর ধনী মানুষের বাড়ী ছিল – যাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষদের বাড়িও ছিল। এখন যেখানে বিড়লা তারামণ্ডল, সেখানেই ছিল ঠাকুরবাড়ী। এইসব পরিবারগুলিকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল যখন ব্রিটিশ শাসকেরা নতুন করে ফোর্ট উইলিয়াম তৈরী করেন – সেই সময়ে।
বর্তমান উত্তর কলকাতার বাগবাজার, শ্যামবাজার ও তার আশেপাশের এলাকাগুলিই অতীতে সুতানুটি গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। গোবিন্দপুর, সুতানুটি, ও ডিহি কলকাতা এ ছাড়াও কালীঘাট ও চিৎপুর নিয়ে তৈরি হয় অধুনা কলকাতা ও সালকিয়া ও বেতড় হাওড়ার শিবপুরের কাছের অঞ্চল। যা নিয়ে তৈরি হয় হাওড়া । সুতানুটি ও বেতড় দুটি গ্রামই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। সপ্তদশ শতাব্দীতে কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে যখন নগরায়ণ শুরু হয়, তখন এই দুটি গ্রাম যথাক্রমে কলকাতা ও হাওড়া মহানগরীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।”
শেয়ার করুন :