কমলেন্দু সরকার
মুম্বইয়ের মেহবুব স্টুডিয়ো। সময়টা সাতের দশকের শেষদিক। মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর পূর্বের কথা। হিন্দি ছবির নামীদামি প্রযোজক-পরিচালক মনমোহন দেশাই ভাবলেন তারকাখচিত একটা ছবি করলে কেমন হয়! নিজেই নিজেকে উত্তর করলেন, বেশ হবে। নিজের অফিসে বসে ঠিকও করলেন, ছবিতে কারা থাকবেন। ছবির নাম ‘দেশপ্রেমী’। ছবির দুই প্রধান চরিত্রে থাকবেন বলিউডের শাহেনশা অমিতাভ বচ্চন, আর থাকবেন টলিউডের মহানায়ক উত্তমকুমার। ফোনে ধরলেন উত্তমকুমারকে। রাজি মহানায়কও। টলিউডের শাহেনশা তো রাজিই।
পরিচালক শক্তি সামন্তর ‘অমানুষ’ হিন্দি ভার্সান সারা দেশে বক্স-অফিসে ব্যাপকভাবে সফল। উত্তমকুমারের সঙ্গে চুক্তিপত্রে সইসাবুদও হল মনমোহন দেশাইয়ের।
পরিচালক মনমোহন দেশাইয়ের খুব ইচ্ছে হল, ছবির মহরত অনুষ্ঠানটি হোক ধুমধাম করে। সেইমতো ছবির পরিচালক মহানায়ক আর শাহেনশাকে তাঁর মনের ইচ্ছা জানালেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, যে-ছবিতে উত্তমকুমার ও অমিতাভ বচ্চন একসঙ্গে কাজ করবেন, সেই ছবির মহরত তো বড় করে হওয়াই কাম্য। উত্তমকুমাররের মনে পড়ল, তাঁর কাজের জায়গা টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় বাংলা নববর্ষের দিন নতুন ছবির মহরতের কথা।যদিও উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়জীবনে খুব বেশি যাননি ছবির মহরতে। বাংলা নববর্ষের দিন পয়লা বৈশাখ টালিগঞ্জের প্রতিটি স্টুডিয়োই ব্যস্ত থাকত নতুন ছবির মহরতে।সাংবাদিক, অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজকের ভিড় হয়তো পছন্দ করতেন না তিনি। মহরতে না গেলে কী হবে, সব খবরই রাখতেন উত্তমকুমার।
উত্তমকুমার কলকাতা থেকে উড়ে গেলেন মুম্বই। যতদূর জানা যায়, দিনটি নাকি পয়লা বৈশাখই ছিল। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন থাক বা না-থাক, তবে তারকার আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল ছিল সেদিন মুম্বইয়ের মেহবুব স্টুডিয়ো! শোনা যায়, অমিতাভ বচ্চন নাকি বলেছিলেন, “উত্তমদা, আপনার নিউ আলিপুরের বাড়ির পাশে কলকাতায় চাকরি করার সময় কিছুদিন ছিলাম। আপনাকে দেখতাম।”
সেদিন কথায় কথায় জমে জমাট বেঁধেছিল মেহবুব স্টুডিয়োয় ‘দেশপ্রেমী’ ছবির মহরত অনুষ্ঠান। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর ১৯৮২-র বাংলা নববর্ষের একসপ্তাহ পর। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা নববর্ষে বাংলা ছবির মহরত এবং মুক্তি ছিল প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশকদের মূল লক্ষ্য। নববর্ষের দিন মহরত ঘিরে পুরনো দিনের কত গল্প, কত ঘটনা ঘোরে টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ার আনাচকানাচে!
টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন এবং অক্ষয়তৃতীয়ায় বাংলা সিনেমার মহরত কবে শুরু হল, এই শুরুর ইতিহাসের কথা কেউই তেমনভাবে বলতে পারেন না। বলতে পারেননি বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র সাংবাদিক নির্মল ধরও। উনি বললেন, “ইদানীং তো আর ঘটা করে মহরতের অনুষ্ঠান দেখি না। হয়ও কিনা জানি না। স্টুডিয়ো পাড়ায় মহরতের অনুষ্ঠান দেখে আসছি সেই ষাটের দশকের শুরু থেকেই। উত্তমকুমার-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে খোশ গল্প করতে দেখেছি পরিচালক সলিল দত্তের ‘স্ত্রী’ ছবির মহরতে। সে ছিল এলাহি ব্যাপার। সেইসময় এই দুই নায়ককে ঘিরেই বাংলা ছবির দর্শকদের ছিল উন্মাদনা।”
মহরতের দিন হাজির ছিল ছবির হাতিটিও
আর এক চলচ্চিত্র সাংবাদিক এবং লেখক চণ্ডী মুখোপাধ্যায় হাজির ছিলেন তপন সিংহের ছবি ‘সফেদ হাতি’র মহরতে। তিনি বললেন, “সেদিন মহরত হয়ে যাওয়ার পর পাত-পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল স্টুডিয়োতে। নেমন্তন্নবাড়ির মতো ম্যারাপ বাঁধা হয়েছিল স্টুডিয়োজুড়ে। সবচেয়ে মজার মহরতের দিন হাজির ছিল ছবির হাতিটিও। তাকে ঘিরে সবাইয়েরই ছিল বেশ কৌতূহল। বেশ মজায় কেটেছিল। আর একটা নববর্ষের দিন মহরতের কথা মনে আছে। সেটি হল পরিচালক প্রভাত রায়ের ‘প্রতিবাদ’। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সন্ধেবেলা ছিল ককটেল। অঢেল আয়োজন। তখন পার্টি শুরু হত সন্ধে সাতটায়। শেষ সার্ভ হত রাত দশটায়। এর কোনও অন্যথা হত না। এখন এসব শুনলে মনে হবে রূপকথার গল্প।”
‘ধুলোমাখা রসগোল্লাগুলো পরের ব্যাচে বালুসাই বলে চালিয়ে দে, কেউ টের পাবে না।‘
চণ্ডী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাত-পেড়ে খাওয়াদাওয়ার কথা হতে হতেই মনে পড়ে পুরনো দিনের সব মজার কথা। সেবার বাংলা নববর্ষের দিন ছবির মহরত উপলক্ষে ইন্দ্রপুরীতে জমিয়ে দুপুরের ভূরিভোজ চলছে। সেইসময় স্টুডিয়োর ক্যান্টিনই বরাত পেত দুপুরের খাওয়াদাওয়ার। ভূরিভোজনের তখন শেষপর্যায়। পাতে তখন পড়ছিল দই, সন্দেশ আর রসগোল্লা। পরিবেশনকারী যে-ছেলেটির হাতে ছিল রসগোল্লার বালতি তার পায়ে তার জড়াতেই ছেলেটি একেবারে ভূপতিতমোহন অর্থাৎ চিৎপটাং! বালতির রসগোল্লাগুলো মাটিতে পড়ে টেনিস বল! উপস্থিত ছিলেন জহর রায়। উনি বললেন, “ভয় পাস না মোটেও। ধুলোমাখা রসগোল্লাগুলো পরের ব্যাচে বালুসাই বলে চালিয়ে দে, কেউ টের পাবে না।” জহর রায়ের কথা বলার ভঙ্গিতে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ে ইন্দ্রপুরীর চত্বরে। খেতে বসা কেউ কেউ বিষমও খেলেন।
ছবি বিশ্বাস হাসতে হাসতে পাহাড়ী সান্যালকে বলেন, “না, রে, ওসব কিছু নয়। আমি চিরকাল জমিদার হয়ে থাকলাম। তুই সেই নায়েব হয়েই রইলি।”
ছবি বিশ্বাস আর পাহাড়ি সান্যালের মধ্যে ছিল ভীষণ ভাল সম্পর্ক। দু’জনের ভিতর সবসময়ই লেগে থাকত খুনসুটি। পাহাড়ী সান্যাল বাংলা সিনেমায় এসেছিলেন ছবি বিশ্বাসের বছরতিনেক আগে। কিন্তু বয়সে ছবি বিশ্বাস ছিলেন ছ’বছরের বড় পাহাড়ী সান্যালের চেয়ে। এই ফারাক কোনওদিন বাধা হয়ে দাঁড়ানি ওঁদের দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্কে। একদিন ছবি বিশ্বাস বললেন, “পাহাড়ী জানিস, তোর সঙ্গে আমার অনেক তফাত।” পাহাড়ী সান্যাল তখন বলেন, “সে তো বটেই। তুমি লম্বা আমি বেঁটে। তুমি আমার থেকে ভাল অভিনেতা।” ছবি বিশ্বাস হাসতে হাসতে বলেন, “না, রে, ওসব কিছু নয়। আমি চিরকাল জমিদার হয়ে থাকলাম। তুই সেই নায়েব হয়েই রইলি।”
পাহাড়ী সান্যালের প্রথম ছবি নিউ থিয়েটার্সের ‘মীরাবাই’ (১৯৩৩)। পরিচালক দেবকী বসু। আর ছবি বিশ্বাসের প্রথম ছবি ছিল কালী ফিল্মসের ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (১৯৩৬)। পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী। ছবি বিশ্বাস আর পাহাড়ী সান্যালের একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল একবার পয়লা বৈশাখের মহরতে। সেদিন ছিল ছবি বিশ্বাসের প্রথম ছবির প্রযোজকের নতুন ছবির মহরত। গল্পটি শুনেছিলাম কনিষ্ঠ সাংবাদিক গুঞ্জন ঘোষের কাছে– পঞ্চাশের দশকে কোনও একটা ছবির মহরত অনুষ্ঠানে কালী ফিল্মস স্টুডিতে ভূরিভোজ হচ্ছে। তখনকার তাবড় শিল্পীরা সব হাজির। ছবি বিশ্বাস আম খেতে ভালবাসতেন খুব। কানাঘুষো শোনা গেল প্রযোজক ল্যাংড়া আমের ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে পাহাড়ি সান্যালের পছন্দের খাবার ছানার ডালনা। তিনিও খবর নিয়ে জেনেছেন তাঁর প্রিয় পদটি আছে দুপুরের মেনুতে। কিন্তু খেতে বসে দেখা গেল দুটোর কোনও পদটিই নেই। ছবি বিশ্বাসকে লক্ষ করে পাহাড়ী সান্যাল বললেন, ‘টাকায় টাকা বাড়ে, গরমে বাড়ে ঘাম, প্রোডিউসার এত কিপটে, পাতে দেয়নি আম!’ ছবি বিশ্বাসও সঙ্গেসঙ্গে বললেন, ‘হায়রে ছানার পাই না দেখা, কোথায় গেলি তুই?, তোর অভাবে ভরলো না পেট, হাত-পা তুলে শুই!’ এইরকম মজার সম্পর্ক ছিল ওঁদের দু’জনের ভিতর। আর মজাও হত সেকালের পয়লা বৈশাখের মহরতে।
বাংলা ছবির সিনিয়র প্রচারবিদ উত্তম বসু বহুদিন সাক্ষী ছিলেন টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ার নববর্ষের মহরতে। তিনি বললেন, “সেইসময় একসঙ্গে পাঁচ-সাতটা ছবির মহরত হত। মহরত হওয়া সব ছবিই যে বাস্তবে রূপায়িত তা নয়। রাঙাদা (দিলীপ রায়) একটি ছবির মহরত করলেন পয়লা বৈশাখ। ছবিটিতে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন উত্তমকুমারও এসেছিলেন। উনি ছবিটিতে ছিলেন না। যেহেতু দিলীপ রায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভাল ছিল তাই ওঁর আমন্ত্রণে হাজির ছিলেন মহরতে। এ-ছবিটি পরে হয়নি। ওই মহরতেই শুধু হয়েছিল। ঠিক এমনই হয়েছিল পরিচালক প্রভাত রায়ের ‘প্রহার’ ছবির ক্ষেত্রে। ছবিটিতে ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। সেদিন এলাহি আয়োজন। পুরো স্টুডিয়ো চত্বর ছিল নিরাপত্তার চাদরে মোড়া। কিন্তু শুরুতেই শেষ।”
মহরতের দিন কেউ কেউ স্টুডিয়োতেই পুজো করে মহরত করতেন। বেশিরভাগই প্রযোজক-পরিচালকই কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর বা অন্যকোনও কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে সেই প্রসাদীফুল ক্যামেরায় ঠেকাতেন আবার অনেক প্রথম শট নিয়ে প্রসাদীফুল ক্ল্যাপস্টিকে ঠেকাতেন। টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ার প্রযোজক-পরিচালকেরা পুজো দিতেন কালীঘাটে বা দক্ষিণের কোনও জাগ্রত কালীমন্দিরে, উত্তরের অরোরা, আড়িয়াদহ-দক্ষিণেশ্বরের ইস্টার্ন টকিজ, সিঁথির মোড়ের এমপি স্টুডিয়োর পুজো দেওয়া হত দক্ষিণেশ্বরে কিংবা বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে। কেউ কেউ আবার মহরত অনুষ্ঠান করতেন না, করেনওনি। যেমন, বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় কোনও ছবিরই মহরত করেননি। “মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষও কোনও ছবির মহরত করেননি,” বললেন বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র সাংবাদিক স্বপনকুমার ঘোষ।
একসময় টালিগঞ্জ স্টুডিয়োপাড়া পয়লা বৈশাখের দিন গমগম করত সেকথাও বললেন, স্বপনকুমার ঘোষ, “উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ, কে আসতেন না মহরত অনুষ্ঠানে! আমি দেখেছি নিউ থিয়েটার্সের তিন জায়গায় তিনটি ছবির মহরত একসঙ্গে হচ্ছে! আমি শুধু সুচিত্রা সেনকে কোনওদিন দেখিনি পয়লা বৈশাখের মহরতে। তাছাড়া সবাইকে দেখতাম পয়লা বৈশাখের মহরতে। যাঁদের ছবি তাঁরা তো আসতেনই। এছাড়াও আমন্ত্রিতরাও আসতেন। কখনওসখনও প্যান্ডেল বেঁধে পাত-পেড়ে খাওয়াদাওয়া হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সকলকে খাওয়ার প্যাকেট দেওয়া হত। আরও একটা কথা বলে রাখি, মহরত হওয়া মানেই কিন্তু ছবি হবে এমন কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। বহু ছবিরই মহরত হয়েছে কিন্তু ছবি হয়নি।” এমনটা হয়েছিল উত্তমকুমারের ক্ষেত্রেও। উত্তমকুমার-মালা সিনহা ছবির জুটি। মহরতের সকালে জানা গেল চিত্রনাট্যকার এখনও রেডিওই করতে পারেননি চিত্রনাট্য। ওদিকে পরিচালকের রক্তচাপ বেড়ে হাই। তিনি হাতজোড় করে বলছেন, ‘আমার ছবির কি হবে? আপনি অন্তত কয়েকপাতার একটা চিত্রনাট্য লিখে দিন। নইলে…’
চিত্রনাট্যকার দন্ত বিগলিত করে যা বললেন, এমন চিত্রনাট্য বাপের জন্মে শুনেছেন কিনা পরিচালক তা তাঁর জানা ছিল না! তবে মহরতের দিন দুয়েক শুটিংয়ের পর এই বন্ধ হয় ছবি।
স্বপনকুমার ঘোষ বলেন, “মহরতের শট অনেকসময় ছবিতে থাকত না।”
ঢাকঢোল পিটিয়ে মহরত হত কিন্তু ছবি…, না, হত না। কারওর কারওর শুনেছিলাম, টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় কোনও পরিচালকের পরিচিতিই হয়েছিল মহরতের পরিচালক। আসলে এঁরা ছিলেন খদ্দের ধরার দলে। গ্রামগঞ্জে কিংবা মফসসলের অনেকেই প্রভূত ধনী ছিলেন। তাঁদের ব্যামো হল সিনেমায় মুখ দেখাবেন। তাঁদের টোপ দিয়ে মহরতে আনা হত। ওই মহরতেই শুটিং শুরু, সেখানেই শেষ। যদিও এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মহরতের দিন আনন্দের বন্যা বয়ে যেত স্টুডিয়োপাড়ায়। ফুল দিয়ে সাজানো হত। সানাই বাজত। টেকনিশিয়ানরা আসতেন নতুন জামা-কাপড় পরে। একসময় টালিগঞ্জ স্টুডিয়োপাড়ায় নিত্য যাতায়াত ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির সাহিত্যিকদের। সেই তালিকায় ছিলেন— নজরুল ইসলাম, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য প্রমুখর। এঁদের অনেকেই ছিলেন সে-যুগের নামী পরিচালক। তাঁরা ছিলেন একাধিক হিট ছবির পরিচালক।
আশির দশকেও দেখা গেছিল আর ডি বর্মন, মিঠুন চক্রবর্তী প্রমুখকেও। দু’জনেই একই স্টুডিয়োয় এসেছেন। এ-প্রসঙ্গে জনপ্রিয় পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী বললেন, “আগে মহরতের দিনগুলো ছিল– পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, রথযাত্রা আর মহালয়া। আমি নিজেই ‘মহান’ ছবির মহরত করেছিলাম রথযাত্রার দিন। তবে পয়লা বৈশাখ আর মহালয়ার দিন মহরত হত সবচেয়ে বেশি। কত বড় বড় লোক আসতেন। চা, কফি, শরবত, ডাবের জল দিয়ে শুরু হত আপ্যায়ন। দুপুরে লাঞ্চ। প্রচুর খাওয়াদাওয়া হত। অনেকেই বড় বড় হোটেলে পার্টি দিত। যাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হত তাঁদের প্রায় সকলেই আসতেন। এত মধুর সম্পর্ক ছিল। একবার পয়লা বৈশাখে নিউ থিয়েটার্সে প্রভাতদা (রায়)-র ছবি করতে এলেন মিঠুন চক্রবর্তী। যদিও পরে সে-ছবি আর হয়নি। অঞ্জনদা (চৌধুরী)-র ছবিতে ক্ল্যাপস্টিক দিলেন আর ডি বর্মন। স্টুডিয়োর বাইরে বিশাল ভিড়। ভিতরের অবস্থাও গমগমে। শেষে এমন অবস্থা হল যে, পাঁচিল ভেঙে পড়ল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োর!”
সিনেমা সাংবাদিকতার সূত্রে জেনেছিলাম, একবার পয়লা বৈশাখে মহরতের দিন মনকষাকষি হয় পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী আর রঞ্জিত মল্লিকের মধ্যে। সেই ‘শত্রু’ থেকে দু’জনের জুটি বাংলা ছবিকে দিয়েছিল প্রভূত আর্থিক সাফল্য। ছবিতে নামীদামি নায়ক-নায়িকা থাকলেও রঞ্জিত মল্লিকের ভূমিকা থাকত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একবার নববর্ষের দিন মহরতে রঞ্জিত মল্লিক স্টুডিয়োতে ঢুকতে গিয়ে খেলেন হোঁচট। আক্ষরিক অর্থে নয়। তিনি দেখলেন, ছবির নায়ককে হাইলাইট করেই বড় বড় কাটআউট লাগানো হয়েছে। তিনি কোথায়! স্টুডিয়ো পাড়ায় ভদ্রলোক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে রঞ্জিত মল্লিকের। তিনি কিচ্ছু বললেন না মুখে। একজন সিনিয়র অভিনেতা হিসেবে খারাপ লাগল। তিনি অঞ্জন চৌধুরীকে জানালেন, এ-ছবি তিনি করতে পারবেন না। আর ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে ছবি করার ইচ্ছা থাকলে চিত্রনাট্য আগে তাঁকে পড়াতে হবে। পছন্দ হলে করবেন, নইলে নয়।
দীর্ঘ সম্পর্কে ফাটল যেমন ধরেছিল, তেমনই সম্পর্কের রসিকতায় ভেসে যেত স্টুডিয়োর মেক-আপরুম। ঘটনাটি দীর্ঘদিন আগে শোনা। পঞ্চাশ দশকের একেবারে শেষে। স্থান- ক্যালকাটা মুভিটোন স্টুডিয়ো। সেইসময় ক্যলকাটা মুভিটোন ছিল ব্যস্ত স্টুডিয়ো। প্রচুর ছবির শুটিং হত। পয়লা বৈশাখের দিন ছবির মহরত। পরিচালক সুশীল মজুমদার। ছবির নাম ‘অগ্নি সম্ভবা’ (১৯৫৯)। ছবির মহরত শট হবে। স্টুডিয়োর মেক-আপরুমে মেক-আপ নিতে নিতে গল্প করছিলেন শ্যাম লাহা আর কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ফ্লোর থেকে বারবার ডাক আসছে। শ্যাম লাহা প্রায় তৈরি। গোঁফটা লাগানো বাকি। তিনি খুঁজছিলেন মেক-আপম্যানকে। ধারেকাছে ছিলেন না তিনি। এমন সময় কালী বান্যার্জি বললেন, “দাদা, অত দুঃশ্চিন্তা করছ কেন? তোমার বিশাল কিংসাইজ দুটো ভুরুর একটা কেটে ঠোঁটের ওপর সেঁটে নাও।”
শ্যাম লাহা বললেন, “সে না হয় করলাম, কিন্তু কাটা ভুরুটার কী হবে!”
কালী ব্যানার্জি তৎক্ষণাৎ বললেন, “ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে ওই জায়গায় ব্ল্যাকটেপ সেঁটে দাও!”
সেইসময় টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় একটা কথা খুব চালু ছিল, বাংলা বছরের শুরুর দিন ছবির মহরত করলে সিনেমা দেবীর আশীর্বাদে মা দুর্গা পুজোর আগে পরে বা দেবীপক্ষে ছবি ঠিক রিলিজ করিয়ে দেবে। তাই প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশকদের শ্লোগানই ছিল —‘পয়লা বৈশাখে মহরত, দেবীপক্ষে রিলিজ।’ পরিচালক সুশীল মজুমদারের ‘অগ্নি সম্ভবা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯-এর দুর্গাপুজোর কয়েকদিন আগেই।
“নব্বইয়ের শুরুতেই পয়লা বৈশাখে খুব ধুমধাম করে ‘নবাব’ ছবিটির মহরত করেছিলাম। সেইসময় মহরতের একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। একটা বনেদিয়ানা ছিল। সেই বনেদিয়ানাটাই আজকে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে হারিয়ে গেছে। মনে হয়, প্রযোজকদেরও মহরতের জন্য খরচের মানসিকতাও আর নেই। সেইসময় এই সংস্কৃতিটা ছিল বাংলা সিনেমার বাঙালিয়ানার অন্যতম এক অংশ। তাই মহরত চলতেই থাকত,” বললেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী।
বাংলা ছবির বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তীও একই কথা বললেন, “আমি তখন বহু ছবিতে কাজ করতাম। মহরতও হত একাধিক ছবির। তাই সব জায়গাতেই যেতে হত। কোনও ছবিতে মহরত শট হত শুধু আমাকে নিয়ে। কোনওটাই একটা বাচ্চার সঙ্গে। আবার আমি হয়তো ছবিতে নেই, কিন্তু মহরতে একবার ঘুরে আসতাম আমার শট হয়ে যাওয়ার পর। সকলের সঙ্গে দেখা হত। একটা অন্যরকম মজা ছিল, আনন্দ ছিল। যেখানেই যেতাম সেখানেই মিষ্টির প্যাকেট দিত। আর যে-ছবির আমি মহরত শট দিতাম, তারা মিষ্টির প্যাকেট তো বটেই, লাঞ্চ প্যাকেটও দিত। বাঙালিয়ানা ছিল সবকিছুর মধ্যে। বাঙালি সংস্কৃতি ছিল। এখন তো এসব কিছু নেই। সেইসময় পয়লা বৈশাখের দিন আনন্দ ছিল। পুরুষেরা ধুতি-পাঞ্জাবি, মহিলারা শাড়ি পরতেন। পুরোপুরি বাঙালিয়ানা থাকত মহরতে।”
একদা বাংলা সিনেমার সুপারস্টার চিরঞ্জিত-এর কাছে মহরতটা ছিল একটা ফ্যান্টাসির মতো। তিনি বললেন, “আমি যখনই ছবির মহরত করতাম তখনই একটা ফ্যান্টাসির জগতে ঢুকে পড়তাম। পুরো ছবিটা আমার চোখের সামনে ভাসত। সে আমার নিজের ডিরেকশনের ছবি হোক বা অন্যের। আমারা মহরতের দিন খুব মজা করতাম।”
চিরঞ্জিতের প্রথম ছবি ‘মর্যাদা’র মহরত শটে ক্ল্যাপস্টিক দিয়েছিলেন পরিচালক প্রভাত রায়। এ-প্রসঙ্গে চিরঞ্জিত বললেন, “প্রভাতদাকে আমি গুরু মানতাম। তাই গুরুকে প্রণাম করে মহরতের দিন যাত্রা শুরু করলাম। সবমিলিয়ে মহরতের দিন আমার খুব ভাল লাগত। নিজের ছবি হলে তো যেতেই হত। অন্য কেউ আমন্ত্রণ জানালেও যেতাম মহরতে। তবে পরে কোনও কারণে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম।” টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় বাংলা সিনেমার সেইসব সোনার দিন আর নেই পয়লা বৈশাখের দিন! সময়ের সঙ্গে অনেককিছুই হারিয়ে গেছে স্টুডিয়ো পাড়া থেকে। সেকালের সাবেক পয়লা বৈশাখের মহরতও উধাও। স্টুডিয়ো পাড়ার সেই রীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি এখন শুধুই স্মৃতিচারণের ভূমি। পুরনো দিনের অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, টেকনিশিয়ান, প্রযোজক, পরিবেশকদের কাছে রয়েছে শুধুই পয়লা বৈশাখের স্মৃতিরোমন্থন।
শেয়ার করুন :