কমলেন্দু সরকার
ঠিকই করে নিয়েছিলেন অভিনয় করবেন। আর কিছু করবেন না। সেই কারণে রেডিয়ো অফিসের চাকরি ছেড়েছিলেন। খেলাধুলার পাটও চুকিয়ে দিলেন। ভাল হকি খেলতেন। কলকাতা মাঠের দ্বিতীয় ডিভিশনের একটি দলে খেলতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হকি খেলছেন গড়ের মাঠে ঠিক মেলানো যাচ্ছে না, তাই তো। উত্তমকুমারকে তবুও ছবিতে ফুটবল খেলতে দেখা গেছিল ‘সপ্তপদী’ ছবিতে। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে? ভাবতে হবে। এ-প্রসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কি বলেছেন, “তখন আমি কলেজের হয়ে হকি খেলি, সেকেন্ড ডিভিশনের একটা ক্লাবেও খেলি, হয়তো চেষ্টাচরিত্র করে ফার্স্ট ডিভিশন অবধি যেতে পারতাম…”
যাঁর স্বপ্ন অভিনেতা হওয়ার তিনি কি আর অন্যকিছু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? পারেন না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও পারেননি। তিনি বলেছিলেন, “থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন শিশিরবাবুর অভিনয় দেখতে দেখতে আমি মনে মনে স্থির করে নিয়েছি যে আমি অভিনয় করব– আর কিছু করব না।” ভাগ্যিস অন্যকিছু করেননি তাহলে আমরা অর্থাৎ বাংলা ছবির দর্শকেরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক অভিনেতা থেকে বঞ্চিত হতাম।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়াতে বাড়ি থেকেও তেমনভাবে কোনও বাধা আসেনি। এ-প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেছেন, “অভিনয়টা পেশা হিসেবে অনিশ্চিত– আমার বাবা সে বিষয়ে সচেতন করতেন…।” তিনি তাঁর দাদার খুব সমর্থন পেয়েছিলেন অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করাতে।
শিশির ভাদুড়ির অভিনয় দেখাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম নিয়ে গেছিলেন তাঁরই বয়োজ্যেষ্ঠ এক বন্ধু গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়। না, তিনি অভিনেতা ছিলেন না। গৌরমোহন করতেন অধ্যাপনা। জানা যায়, শিশির ভাদুড়ির অভিনয় দেখে প্রায় সপ্তাহখানেক ঘোরের মধ্যে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন তিনি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র।পরবর্তী সময়ে তিনি শিশির ভাদুড়ির কাছে অভিনয়ের পাঠ নিয়েছিলেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম পেশাদার অভিনয় ছিল ‘প্রফুল্ল’। সময়টা ১৯৫৭। রিহার্সাল দেওয়ার সময় শিশির ভাদুড়ি তাঁকে বলেছিলেন, তোমাকে জানতে হবে তোমার কণ্ঠস্বরের জোর কোথায়। তোমাকে কণ্ঠটিকে তৈরি করতে হবে। গলার আড় ভাঙতে হবে। কিন্তু তোমার উচ্চারণ খুব ভাল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন, অভিনেতাকে নিজের মতো করে ভাবতে শেখাতেন। তাঁর কাছে শিখেছিলেন নিজের মতো করে অভিনয় করতে। শুধু নাটক নয়, সিনেমার প্রতি আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকেই। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতেন। টিফিনের পয়সায় সিনেমা দেখতেন। তখন টিকিটের দাম ছিল একপয়সা। হলিউডের ছবি থেকে বাংলা ছবি ছিল দেখার তালিকায়। তবে ‘পথের পাঁচালী’ দেখে তাঁর ছবি দেখার ধারণাটাই বদলে গেছিল। মুহ্যমান হয়ে গেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’ দেখে। সেইসময় তিনি শুনেছিলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘অপরাজিত’র জন্য অপু খুঁজছেন। বন্ধু তপন সত্যজিৎ রায়ের প্রোডাকশনের একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে কফি হাউসের সামনে থেকে বাস ধরে সোজা সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি চলে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ঘরে ঢুকতেই সত্যজিৎ রায় বলেন, এ হে, আপনি যে একটু বড় হয়ে গেলেন। না, সত্যজিৎ রায়ের নতুন ছবিতে কাজ করা হল না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। করলেন পরে– ‘অপুর সংসার’-এ। তিনি যে এই ছবির জন্য নির্বাচিত সে খবর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ‘জলসাঘর’-এর সেটে।
‘অপরাজিত’ ছবিতে সুযোগ না-পেলেও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছিল যোগাযোগ। শুটিংও দেখতে যেতেন। তেমনই একদিন গেলেন ‘জলসাঘর’ শুটিং দেখতে পরিচালকের আমন্ত্রণে। আলাপ হয়েছিল সেদিন ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে। ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করানোর ফাঁকে ছবি বিশ্বাসকে বলেছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়, এর নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এ আমার পরের ছবির অপু। সেইসময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল, চিৎকার করে বলি– আমি অপু!
এরপর চাকরি ছাড়া। নাটক নয়, তখন শুধু সিনেমায় অভিনয় করার স্বপ্ন দু’চোখে। তবে নাটকের প্রতি ভালবাসা তাঁর রয়ে গেছিল তার বহিঃপ্রকাশ পেলাম পরবর্তী কালে। যাইহোক, অপু থেকে শুরু করে উমাপ্রসাদ, অমূল্য, নরসিং, অমল, অমিতাভ, অসীম, গঙ্গাচরণ, ফেলুদা, উদয়ন মাস্টার, সন্দীপ, ডাক্তার অশোক গুপ্ত, প্রশান্ত কতরকম চরিত্র চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর চিত্রনাট্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাঙালি মনে রেখেছেন শুধুমাত্র অপু, গঙ্গাচরণ, ফেলুদা হিসেবে নয়, মনে রেখেছেন ‘ঝিন্দের বন্দি’ (১৯৬১)র ময়ূর-বাহন, ‘বাঘিনী’ (১৯৬৮)র চিরঞ্জীব, ‘সংসার সীমান্তে’ (১৯৭৫)র অঘোর, ‘কোনি’ (১৯৮৪)র খিদদা, ‘অগ্রদানী’ (১৯৮৩)র অগ্রদানী ব্রাহ্মণ পুণ্য চক্রবর্তী, ‘তিন ভুবনের পারে’ (১৯৬৯) সুবীর, ‘আতঙ্ক’ (১৯৮৬)র স্কুল মাস্টার, ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫)-এর অজয়কেও।
আরও অসংখ্য মনে-রাখার মতো চরিত্র করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি ‘আকাশ কুসুম’-এর সৌমিত্র অভিনীত অজয় সরকার চরিত্রটি বাঙালি যুবকদের মধ্যে প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি পরার ফ্যাশন এনেছিল ষাটের দশকে। সেইসময়কার বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের ছেলেদের চেনা যেত প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবিতে। ষাটের দশকের ওই ফ্যাশন আজও বহমান। পরিচালক পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অগ্রদানী’ ছবিতে অগ্রদানী ব্রাহ্মণের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছিল অভিনয়জীবনে অন্যতম সেরা অভিনয়। আজও বাংলা ছবির দর্শক মনে রেখেছেন সৌমিত্রের অভিনয়!
ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক নতুন অভিনেতার জন্ম হয়েছিল ৯ অগস্ট, ১৯৫৮। এই দিনই ছিল ‘অপুর সংসার’-এর প্রথম শুটিং। ক্রমশ তিনি হয়ে উঠলেন তারকা-অভিনেতা। সত্যজিৎ রায়ের অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয় চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোশাওয়ার অভিনেতা তোশিরো মিফুনে-র। মিফুনে ১৯৪৮-১৯৬৫ কুরোশাওয়ার মোট ১৬টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘সুকুমার রায়’ নিয়ে মোট ১৫ টি ছবিতে অভিনয় করেন।
‘অপুর সংসার’ ছবিটি করার আগেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যাতায়াত ছিল সত্যজিৎ রায়ের কাছে। পরিচালকের সঙ্গে তাঁর গল্পগুজব হত। বইয়ের আদানপ্রদানও ছিল। ছবি দেখাতে নিয়ে যেতেন পরিচালক তাঁর ছবির ভাবী অভিনেতাকে। একটি ছবি সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে– Last word of cinema acting. ছবিটি ছিল বিলি ওয়াইল্ডার-এর ‘দ্য লস্ট উইকএন্ড’। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে নানারকম আলোচনা বই আদানপ্রদান তাঁকে তৈরি অর্থাৎ groom করেছিল। সেই কারণে হয়তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম দিনের শুটিংয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন পরিচালক।
‘অপুর সংসার’-এর পর করলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ (১৯৬০)। এ-বছরই তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ দেখা গেল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬১-তে শুধু সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ ছবির ‘সমাপ্তি’তে নয়, সৌমিত্রকে দেখা গেল মৃণাল সেনের ‘পুনশ্চ’, অসিত সেনের ‘স্বরলিপি’, ‘স্বয়ম্বরা’, তপন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দি’ ছবিতেও। ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায়ের অভিযান, চারুলতা, কাপুরুষ ছাড়া হরিসাধন দাশগুপ্ত, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় কর, তরুণ মজুমদার-সহ একাধিক পরিচালকের মোট ৩৩টি ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
বাংলা ছবিতে প্রয়োজন ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন অভিনেতা কাম নায়কের। তাই সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, অসিত সেন প্রমুখ পরিচালকের ছবিতে কাজ করার পাশাপাশি একেবারে মেনস্ট্রিম ছবির পরিচালকদের কাছেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নয়ের দশকে তা আরও প্রকট হল। ছয়ের দশকের শেষে পরিচালক আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তিন ভুবনের পারে’ (১৯৬৯) ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রকে-বসা যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দুর্দান্ত। তাঁর ঠোঁটে মান্না দে’র গাওয়া ‘জীবনে কি পাব না’ আজও সমান জনপ্রিয়।
সেইসময়ে তো ছিলই। শুধু তাই নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানেই ইন্টলেকচুয়াল অভিনেতা এই ধারণাটা একেবারে ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি বাঙালি যুব প্রজন্মের কাছে। তিনি যে সিরিয়াস অভিনেতা সেই ধারণাও দর্শক বদলে ফেলে পরিচালক দীনেন গুপ্তের ‘বসন্ত বিলাপ’ (১৯৭৩)-এর পর। এরপর একাধিক ছবিতে চমৎকার কমেডি করেছিলেন সৌমিত্র।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ছবিতে আত্মপ্রকাশের পরই অভিনয় করেছিলেন বাংলা ছবির প্রথম সারির নায়িকাদের সঙ্গে। ‘অপুর সংসার’ মুক্তির চারবছর পরই সুচিত্রা সেনের সঙ্গে করলেন পরিচালক অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩)। অপর্ণা সেনের প্রথম ছবি ‘সমাপ্তি’র প্রধান অভিনেতাই ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই সৌমিত্র-অপর্ণা জুটি বাংলা ছবিতে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকেই উত্তম-সুচিত্রার জুটির সঙ্গে তুলনা করতেন। সৌমিত্র-সন্ধ্যা রায় জুটিও বাংলা ছবির দর্শকেরা পছন্দ করেছেন। সৌমিত্রের বিপরীতে শর্মিলা, মাধবী, তনুজার ছবিগুলিও বক্স-অফিস পেয়েছিল বেশ ভাল। উত্তমকুমারের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও বাংলা ছবির দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছিল সেইসময়। পরবর্তী সময়ে তো উনি অপরিহার্য অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ছবিতে। কিছু কিছু ছবি দেখে মনেই হত বা আজও হয় এ-ছবিটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে দিয়ে হত না।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছবির জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও নাটক করার প্রবণতা তাঁর মধ্যে হয়তো থেকে গেছিল। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যে সত্তর দশকের শেষে আবার মঞ্চে ফিরেছিলেন। করেছিলেন ‘নামজীবন’। তারপর একাদিক্রমে করেন– রাজকুমার, ফেরা, নীলকণ্ঠ, ঘটক বিদায়, দর্পণে শরৎশশী, চন্দনপুরের চোর, টিকটিকি, প্রাণতপস্যা, হোমাপাখি ইত্যাদি।
সিনেমা, নাটকের পাশাপাশি চলেছিল নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে যুগ্মভাবে সাহিত্য পত্রিকা ‘এক্ষণ’ প্রকাশ। প্রথম সংখ্যা থেকেই একশ্রেণির পাঠকের কাছে শুধু জনপ্রিয় নয়, পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে ‘এক্ষণ’।
‘এক্ষণ’ প্রকাশ নিয়ে এই পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘নির্মাল্য আর আমি যখন ১৯৬১ সালে দ্বিমাসিক ‘এক্ষণ’ প্রকাশ করা মনস্থ করি তখন তার মধ্যে আমাদের দু’জনের সাহিত্যসংস্রব একটা আধার পাবে এমন কোনও গৌরবের আকাঙখা ছিল না।… একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সান্ধ্য আড্ডার শেষে আমি আর দীপা মির্জাপুর স্ট্রিটে বাড়ি ফিরছি, নির্মাল্য সঙ্গ নিল। অ্যামহার্স্ট আর হ্যারিসন রোডের ক্রশিংয়ে নির্মাল্য বলল, ‘শোন, আমি একটি পত্রিকা বের করব বলে স্থির করে ফেলেছি। খালি একটা শর্ত আছে, তোকে যুগ্মভাবে সম্পাদক থাকতে হবে। তুই না থাকলে পত্রিকা বের করব না।’ উত্তরে আমি বললাম, ‘আমি তোর সঙ্গে থাকব, তোকে সব ব্যাপারে সাহায্য করব, কিন্তু যুগ্মভাবে সম্পাদক থাকব না। তোকে বুক ঠুকে বলতে হবে তুই একাই সব দায়িত্ব নিবি।’ এই নিয়ে যুক্তি-প্রতিযুক্তি-তর্ক-বিতর্ক শুরু হল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে।… এই সময় দীপা ভেটো দিল। বলল, ‘তোমাদের এতদিনের ইচ্ছে একটা কাগজ বের করার সেটা তুমি না থাকলে বেরোবে না– তুমি রাজি হও।’ এইভাবে অ্যামহার্স্ট স্ট্রিট হ্যারিসন রোডের সংযোগে নৈশ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ‘এক্ষণ’ প্রকাশ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছিল’। (নির্বাচিত ‘এক্ষণ’ খণ্ড-১/পূর্বকথা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)।
এরপর তো পুরোটাই ইতিহাস অধুনালুপ্ত ‘এক্ষণ’-এর। পত্রিকার নামকরণ, প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। শোনা যায়, তিনি কিছু পরামর্শও দিয়েছিলেন পত্রিকা চালানো, লেখক সম্পর্কে। পত্রিকা চালানোর ব্যাপারে পরামর্শ বা উপদেশ দিয়েছিলেন কবি অরুণ মিত্র। কবিতার পাতা দেখতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজে। তিনি নিজেও ছিলেন কবি। তাঁর রয়েছে একাধিক কাব্যগ্রন্থ। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে কবিতাসমগ্র। তিনি ভাবানুবাদ করেছিলেন খলিল জিব্রান-এর ‘প্রফেট’।
বাংলা ছবির সর্বগুণনিধি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫, ১৯ জানুয়ারি।
বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি কৃষ্ণনগর।
মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্ট-এ ওকালতি করতেন। সৌমিত্রের ঠাকুরদাও ছিলেন উকিল। তিনি প্র্যাকটিস করতেন কৃষ্ণনগর আদালতে। তবে মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্র্যাকটিস ছেড়ে সরকারি চাকরি নেন। এরপর তিনি একাধিকবার চাকরি বদল করেন। তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও একাধিকবার জায়গা বদল করতে হয়েছিল। কখনও বারাসত, কখনও হাওড়া আবার কখনও কলকাতা। তবে বরাবরই বাড়িতে বিরাজমান ছিল এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। বাড়িতে নাট্যচর্চার একটা ব্যাপার ছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলছেন,… বাড়িতে নাট্য অভিনয় বলতে– আমরা ছোটরা নিজেরা করতাম। …আমরা ভাইবোনেরা বন্ধুবান্ধবরা মিলে করতাম– ওই তক্তপোশ টেনে এনে স্টেজ তৈরি করতাম, আর বিছানার চাদর এনে পর্দা উইংস কার্টন–এসব তৈরি করতাম। অনেকসময় পোশাকপত্তরে মা-বাবাও কিছু কিছু সাহায্য করতেন। মা রাংতা কেটে মুকুট তৈরি করে দিতেন। দর্শক ছিল বাড়ির লোকেরাই, বন্ধুবান্ধব এবং গৃহভৃত্যরা।’ তাই ধরে নেওয়াই যেতে পাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের ভিতটি তৈরি হয়েছিল বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিবেশ-পরিমণ্ডলেই। অভিনেতার পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ও চমৎকার আবৃত্তি করতেন বলে জানা যায়। নাটকেও ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। সেইহেতু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়জগতে আসাটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি কখনও।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অভিনেতা-মন প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। সেই কারণেই হয়তো অভিনয়, থিয়েটার সিনেমা– এগুলো কি তা বুঝতে পেরেছিলেন অতি সহজেই। এবং বোঝার মতো মন তৈরি ছিল আগে থেকেই। সেই কারণে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল অভিনয় ছাড়া আর কিছুই করবেন না। শিশির ভাদুড়ির কথামতো নিজের কণ্ঠ তৈরি করে নিয়েছিলেন। ভুলগুলো শুধরে নিয়েছিলেন সময়মতো। পাশাপাশি মুখের মাংসপেশির ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলেন। তাই সহজেই তাঁর অভিনীত চরিত্রটি দর্শকের কাছে পৌঁছতে দিতে পেরেছিলেন। সে চরিত্র অন্যধারার ছবির হোক কিংবা বাণিজ্যিক। একজন বড় অভিনেতার মধ্যে থাকে নিজের শরীরের ওপর দখল রাখা তা রাখতে পারতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সে ছবি হোক বা নাটক। একজন মানুষ একনাগাড়ে মদ্যপান করলে তার শারীরিক পরিবর্তন আসে এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার পেগ খাওয়ার পর…। এ-প্রসঙ্গে ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকে তাঁর অভিনীত চরিত্রটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর মনে অভিনীত চরিত্রটিকে চমৎকারভাবে সৃজন করতেন বলে ধারণা। তাই চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত দর্শকের কাছে। উদাহরণ হিসেবে ‘অগ্রদানী’ ছবিতে পুণ্য চক্রবর্তীর চরিত্রটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
যে-কোনও চরিত্র-চিত্রণে বর্ষীয়ান এই অভিনেতা তাঁর শেষটুকু দিতে কার্পণ্য করতেন না। ছোট থেকেই তাঁর এই ব্যাপারটা ছিল। এ-সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “...অভিনয় করার সময় প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস পেতাম, করার আগে যেমন প্রচণ্ড ভয় পেতাম– কি হবে– ভুলে যাব– লোকে গালাগাল দেবে– কি বলবে– কিন্তু অভিনয়টা করতে উঠে নিজেকে ভুলে যাবার, আত্মহারার যে অবকাশ–ওই জিনিসটা আমাকে সবচাইতে বেশি টানত।… তারপর নিশ্চয়ই সবচাইতে বড় আকর্ষণ ছিল ওই সুখ্যাতি বা যশ বা তারই লোভ আর কি– লোকে ভাল বলবে।” সেই কারণে হয়তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চেষ্টা করতেন পারফেকশনের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছতে। তাই একবার বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এক কমেডি রিয়্যালিটি শোয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কখন পড়ে যাব আমি জানি না, তবে যতদিন আছি আমি খেলা দেখাব।”
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ছবি বা অভিনয়জগতে ছ’টি দশক কাটিয়ে দিলেন। ১৯৫৮ থেকে ২০২০। ষাট বছরেরও বেশি সময়ে অনেক দেখেছেন। বাংলা তো বটেই, ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেরা পরিচালকদের ছবিতে কাজ করেছেন। নবীন, প্রবীণ প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। বহু ওঠাপড়ার সাক্ষী। পর্দা এবং পর্দার বাইরে দেখেছেন বহু চরিত্র। হয়তো শিকারও হয়েছেন বঞ্চনার। ষাট-বাষট্টি বছরের অভিজ্ঞতা কম নয়! তবুও তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আত্মজীবনী কখনও লিখবেন না। তার কারণ দর্শিয়েছিলেন জীবনী সত্য হবে না। আমাদের দেশে বেশি সত্যি কথা লেখা যায় না।
গত ছ’ অক্টোবর তিনি কোভিড নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এক বেসরকারি হাসপাতালে। ক্রমশ তাঁর অবস্থা খারাপ এবং জটিল হচ্ছিল। তিনি ছিলেন ঘোরের মধ্যে। হাসপাতালের প্রকাশিত বুলেটিনে তাই থাকত। তখন তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলতেন, অনিবার্যকে কি করে মানতে পারব সেইটেই ভাবি মৃত্যু সম্পর্কে। আগে আমি ভীষণ মৃত্যুভীত ছিলাম, যখন বয়স কম ছিল। ভাবতাম যে মৃত্যু আমাকে ভয়ানক বেদনা দেবে, কিন্তু এখন বোধহয় অতটা বিচলিত হই না। এখন ভাবি যে মৃত্যু সামনাসামনি এসে দাঁড়ালে সেটাকে কি করে নিতে পারব– তার জন্য মনকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করি।
হয়তো সেই কারণে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ক্রমশ। কথাও বলছিলেন। তাঁকে গান শোনানো হচ্ছিল। সকলেই ধরে নিয়েছিলেন ফেলুদাকে নকআউট করা অত সহজ কর্ম নয়। টলিউডের সকলেই ধরে নিয়েছিলেন আবার কাজে ফিরবেন তিনি। খিদদার সেই ‘ফাইট কোনি, ফাইট’ যেন কোনির মুখে শোনা যাচ্ছিল ‘ফাইট খিদদা, ফাইট।‘ কোনির সেই কথা হয়তো পৌঁছয়নি বেসরকারি হাসপাতালের দেওয়াল আর জানালা ভেদ করে বাঙালির খিদদার কর্ণে। না-পৌঁছলেও লড়াই জারি রেখেছিলেন অপু। না, অপু তাঁর সংসার ছেড়ে রওনা দিলেন না-ফেরার দেশে।
ছবি ঋণ :তপন দাস,টাইমস অফ ইন্ডিয়া,পিন্টারেস্ট,হাফ সামোসা ডট ইন,এপিএন লাইভ,এক্সপ্লরা,মিলেনিয়াম পোস্ট,রিডিফ ডট কম,কোনি,জি বাংলা,মধূলিকালিডল ডট কম,ওয়ার্ডপ্রেস ডট কম।
.
.
শেয়ার করুন :