গত ১০ মাস ধরে চলা করোনা অতিমারীতে বেশিরভাগ পরিবারের দুশ্চিন্তা,স্ট্রেস,অশান্তির প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। চাকরি,কাজ হারানো,বেতন সঙ্কোচ,সব আগামী প্ল্যানের দফারফায় স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিত্য নতুন মানি ফাইট, ঝগড়া অশান্তি মনোমালিন্যয় জীবন ভীষণ বিপর্যস্ত যে কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা যায়না বলে মনের মধ্যে চেপে রাখা গভীর দুঃখ,রাগ,ফ্রাস্ট্রেশন সুখী গৃহকোণের আকাশে ঘন কালো মেঘের মত চেপে আছে।এই ভয়ঙ্কর অস্থির সময়ে পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি ঘটছে।
ফাইনান্সিয়াল এক্সপার্ট রবার্ট ফ্রেডম্যান,চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দেবাশিস ভট্টাচার্য্য,রজত শুভ্র মল্লিকের জরুরি টিপস:
১)এই সময় একসঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন থাকায় পরিবারের নিজেদের মধ্যে ‘মানি ম্যাটার্স ‘নিয়ে অশান্তি অবধারিত তাই প্রথমেই যে কোনও বড় ফাইনান্সিয়াল ডিসিশন একা নেওয়া একদম ঠিক নয়, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেওয়াই শ্রেয়।ধরা যাক গত ৬/৭ মাসে বাইরে বেরোনোর খরচ আর নতুন ড্রেস কেনা হয়নি বলে একা ডিসিশন নিয়ে একটা বড় টিভি কেনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য ‘এমার্জেন্সি ফান্ড’ তৈরী করে সরিয়ে রাখা শ্রেয়।
২) ক্রেডিট কার্ড নিয়ন্ত্রণ – এই সময়ের সবচাইতে বড় সর্বস্ব আর সর্বনাশ।এখন অনলাইনে কাটাপোনা থেকে কিয়া মোটর্সের গাড়ি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে বলে অসংযমী ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার চরম বিপর্যয় আনতে পারে তাই সাধু সাবধান।’স্ট্রেস শপিং সিনড্রোম’ এড়াতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হবে,আর মনে রাখতে হবে-
- যে কোনও কিছু কেনার আগে চেক করুন সেটা এই সময়ে অপরিহার্য কিনা।
- বিলিং সাইকেলের মধ্যে পুরোটা পেমেন্ট করুন নইলে ভয়ঙ্কর ইন্টারেস্টের ফাঁদে পড়বেন।
- নগদ টাকায় কিনলে কত দামের মধ্যে কিনতেন সেই বাজেট ক্রেডিট কার্ডে কেনার সময় অবধারিত ভাবে বেড়ে যায়। এই সময় সেদিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখুন।
- ক্রেডিট কার্ড ব্যালেন্স ট্রান্সফার ফেসিলিটি -বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি নতুন কাস্টমার পাওয়ার জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যালেন্স ট্রান্সফারে লোয়ার ইন্টারেস্ট অফার করে।এই সুযোগ নিলে আউটস্ট্যাডিং অ্যামাউন্টের ওপর পেনাল্টি চার্জ লাগেনা।
- একটা ক্রেডিট কার্ডে আউটস্ট্যান্ডিং অ্যামাউন্ট বেড়ে গেলে সেটা কার্ড ব্যবহার বন্ধ করে প্রদেয় টাকা ইএমআই কিস্তিতে পেমেন্ট করুন।
৩)দুম করে মান্থলি ৭০,০০০ টাকার এক্সপেন্স কে ৪০০০০ এ নিয়ে আসতে যাওয়া ভীষণ কঠিন তাই মান্থলি বাজেট কার্টেল করার আইটেমগুলো নিয়ে ফ্যামিলির সবার সঙ্গে কথা বলে ফাইনাল করুন।আমাদের অজান্তে প্রচুর মান্থলি এক্সপেন্স হয়ে যায় যেখানে আমরা উদাসীন,সেগুলোর পরিমাণ আপাত কম বলে আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।যেমন এই সময় অনেক অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বন্ধ,ইলেক্ট্রিসিটি বিল কমানোর জন্য সদর্থক হয়ে এসি, টিভি,আলো,গ্যাজেটস, ওয়াই ফাই ব্যবহারে সতর্ক থাকলে মাসে ২/৩০০০ টাকা সাশ্রয় করা যায়।
৪) এই সময় চাকরি গেলে ও স্যালারি কার্টেল হলে তাতে পরিবারের সকলের আতঙ্ক,দুশ্চিন্তা,অদৃষ্টের দোষ,একে অন্যকে দোষারোপ,স্ট্রেসের থেকেও স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়েদের একে ওপরের পাশে সঙ্গবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালে অনেক সাময়িক বড় আঘাত কাটিয়ে ওঠার শক্তি রাখে।মনে রাখবেন এতদিন চাকরি,ব্যাবসা সাফল্যের সঙ্গে করেছেন আপনার নিজস্ব মেধা আর ক্ষমতায়,এটা একটা পৃথিবী কাঁপানো পরিস্থিতি তাই এই সঙ্কট আপনার,পরিবারের নিজস্ব ব্যর্থতা নয়।এটা শুধু সময়ের অপেক্ষা,আজ নয়ত কাল আবার সব স্বাভাবিক হবে।
৫) এই সময় স্ট্রেস,দুশ্চিন্তা কাটাতে,একটা এস্কেপ রুট খুঁজতে যে কোনও খরচ,সেটা ইনস্টলমেন্টে দামি ফোন , গ্যাজেটস একদম পরিত্যাজ্য।
৬)যেখানে সম্ভব সেই পেন্ডিং বিল ডেফার/বিলম্বিত করা যায় কিনা খোঁজ নেওয়া যাতে বর্তমান সঙ্কট কিছুটা হলেও কমে।
৭)মানি ডিসিপ্লিন থ্রেশহোল্ড বাজেট– পরিবারের সকলে যদি একটা নির্দিষ্ট টাকার অঙ্ক খরচের আগে সেটা ৫/১০/১৫/২০০০০ হতে পারে,ফ্যামিলির সবার সম্মতি নিয়ে খরচ করা।না,এর মধ্যে প্যাট্রিয়ার্কি, স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ নয় কারণ রিসার্চে দেখা গেছে এই কোভিডকালে এই বিষয়ে স্বামী স্ত্রীর ভয়ঙ্কর অশান্তি হচ্ছে এবং তাতে ছেলেমেয়েরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৮) খরচ কমানোয় সাম্য: খুব ছোট ছোট কারণে এই নিয়ে অশান্তি হচ্ছে।পরিবারের একজন তার মান্থলি এক্সপেন্স যেভাবে কমিয়ে কষ্ট করে চলছে সেই অনুযায়ী অন্য একজন নিজের ক্ষেত্রে তাকে পাত্তাই দিচ্ছেনা বরং কিছু বেপরোয়া খরচ করছে স্ট্রেস কাটাতে।এখানে একটা ব্যাল্যান্স করতেই হবে।
৯) অর্থনৈতিক বিষয়ে বাক্যালাপ বন্ধ -এই সময়ে এই কারণে মারাত্মক মানসিক সমস্যায় মাসের খরচে,ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেটা বন্ধ করতে হবে।স্বামী স্ত্রী একে অপরকে না জানিয়ে ফাইনান্সিয়াল ডিসিশন নেওয়ার ফলে সংসারে ভয়ানক অশান্তির সূত্রপাত হয়েছে বহু পরিবারে।এই বিষয়ে সুষ্ঠূ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য মিটিয়ে নেওয়া উচিত।এই সময় ব্যক্তিগত প্রেস্টিজ,হার-জিত ভুলে পরিবারের কল্যাণই প্রধান।ব্রডব্যান্ড প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্ত্রীর এই সময়ে বৃদ্ধির কারণে প্রমোশন আর ডাক্তার স্বামীর চেম্বারে যাওয়া বন্ধের ফলে সাত মাসের উপার্জনহীনতা যেন সম্পর্কে উঁচু নিচুর দেওয়াল না তোলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’মহানগর’ছবিতে অনিল-মাধবী সম্পর্ক মনে আছে ?
১০) আপনি আচরি ধর্ম -ছেলেমেয়েরা প্রধানত শুনে শেখে না,দেখে শেখে।নিজেরা স্ট্রেস কাটাতে অসংযমী হয়ে ছেলেমেয়েদের সমস্ত শখ আহ্লাদে কঠোর লাগাম পরালে হিতে বিপরীত হবে।ছেলেমেয়েরা দেখে শিখুক আপনার সংযম,ওরাও সংযমী হবে।
শেয়ার করুন :