সন্মাত্রানন্দ
হ্রদের জলতলে মুখচ্ছবি দেখছে সে ঘাড় নিচু করে। তার মানে এই নয় যে, নীলাক্ষ নিজরূপমুগ্ধ। শারীরিক সৌষ্ঠবে তত মুগ্ধ সে নয়, বরং নিজের দৈহিক সামর্থ্যেই তার অধিকতর আস্থা। সে জানে, সে ক্রোশের পর ক্রোশ একবারও বিশ্রাম না নিয়ে ছুটে যেতে পারে, পথে কোনো অনতিপ্রসর জলধারা পড়লে সে এক লাফে পার হয়ে যেতে পারে, অনুচ্চ টিলার মাথায় পক্ষীরাজের মতো লাফ দিয়ে উঠে সূর্যের বলীয়ান আঘ্রাণ নিতে পারে বুক ভরে, ছুটতে ছুটতে ছুটতে ঘাড়ের উপর তার সাদা কেশরগুলোকে ফুলিয়ে শুভ্র কাশফুলের মতো সে উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে, সহসা তীব্র হ্রেষারবে সম্মুখস্থ সকলকে সে এক লহমায় চমকিত করে দিতে পারে।
হ্রদের তলা থেকে আরেকটা ঘোড়া নীলাক্ষর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদা ঘোড়া, চোখের মণি নীল, পায়ের পেশি সুদৃঢ়, বক্ষদেশ বলিষ্ঠ, নাসা সুস্ফীত। তার শরীরের এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমবয়সিনী ঘোটকীদের মধ্যে নানা কানাকানি হয়; সেসব মাঝে মাঝে নীলাক্ষর কানে আসে, কিন্তু এসব স্তুতিবাদ পাত্তা দেয় না সে। ওদের ওসব কথার মধ্যে ‘তুমি আমার হও’-জাতীয় অনুচ্চারিত বার্তা লুকোনো আছে, সে জানে। আর জানে বলেই সে এসব প্রণয়বিজল্প গ্রাহ্য করে না। সে স্বাধীন, চিরকাল স্বাধীনই থাকতে চায়, কারও কাছেই সে বাঁধা পড়তে চায় না। ভাবতে ভাবতে নীলাক্ষ জলতল থেকে ঘাড় তুলে আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে আবক্ষগভীর শ্বাস নিয়ে নিল।
বন্ধনের মতো দুঃখ আর কিছুতে নেই। মাঝে মাঝে বনের ভিতর গাছেদের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে, রোহিত আর সিতিগ্রীব লক্ষ করেছে, টিলার নীচে ওই দূরে ঊষর মরুপথ দিয়ে কারা সব যায়। অশ্বপৃষ্ঠে বণিকদের গোষ্ঠী। ঘোড়সওয়ার পার্বত্য দস্যুর দল। সূর্যপতাকাবাহী অজস্র তুরঙ্গমপৃষ্ঠে দুরন্ত বেগবান রাজপুত সেনাবাহিনী। শ্যাম শ্যাওলার মতো চাঁদ-আঁকা পরচম লহরানো টাট্টু-দাবড়ানো মুঘল সেপাইসান্ত্রী। ঘোড়ায় টানা রথ, শকট, উটে টানা যানবাহন। এরা সবাই বুনো ঘোড়াকে, উটকে বাগে এনে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে, বনের স্বাধীন পশুর স্বতন্ত্রতা হরণ করে তাদের পিঠের উপর চড়াও হয়ে বসেছে। আর সেই সব মানুষের বাগমানা পশুগুলোও কেমন ঘাড় নিচু করে মালিকের হুকুম তামিল করে চলে। সওয়ারিকে পিঠের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় না। হা রে জীবন! ছিঃ!
নীলাক্ষ মনে মনে ভাবে, মরে যাবে সে, তবু এমন ঘৃণিত দাসত্বের জীবন তার কখনও যেন না হয়।
নীলাক্ষর মা হৃষ্টরোমা নীলাক্ষকে প্রাণপণে বোঝায়, ‘বাছা, শান্ত হ। তুই এত সুদর্শন, একটু শান্ত সুশীল হয়ে বড়োদের কথা মেনে চললে ক্ষতি কী? সবাই তোকেই ভালো বলবে। প্রশংসা করবে। সময় থাকতে থাকতে পছন্দসই একজন ঘোটকীকে জীবনসঙ্গিনী করে নে। কত ঘোড়ি তোর দিকে যে হা-পিত্যেস করে চেয়ে আছে! আমাদের ঘোড়া-সমাজে ক-টাই বা নিয়ম? এই ক-টা নিয়ম মেনে ভালো ঘোড়া হয়ে যা। তোকেই তো এই ঘোড়ারাজ্যের মোড়ল হতে হবে, রাজা হতে হবে। তা না করে কী সারাদিন দৌড়ে বেড়াস এ মুল্লুক, সে-মুল্লুক?’
মায়ের এই সব কথা একদম পছন্দ নয় নীলাক্ষর। সে সুন্দর, সে সমর্থ, এই কি যথেষ্ট নয়? কেন তাকে ঘোড়াসমাজের অনুমোদন পেতে হবে, অ্যাঁ? তার যা ইচ্ছে, সে তা-ই করবে। দেখি, তাকে কে আটকাতে পারে! বড়োদের কথা শুনবে? বড়ো কারা? তার মতন কাজ কি বড়োরা করতে পারে? আগে জন্মালেই কেউ বড়ো হয় না। দেখা আছে ওদের দৌড়। দূর, দূর! জরদ্গবগুলো সব। এই সব ঘোড়াগুলোর জীবনে দুটি মাত্র স্বপ্ন। ক্রোশের পর ক্রোশ ঘাস খেয়ে চলা। আর উৎকৃষ্ট এক ঘোটকী দেখে তার পেছনে মাছির মতন সারাদিন বিনবিন করা। এদের আবার অনুমোদন!
এই সব ঘোড়াদের আবার এক কল্পিত ঈশ্বরও আছেন বটে! সেই ঈশ্বর এক বিশাল হুমদোমুখো ঘোড়া। এত বিশাল যে সারা পৃথিবী, আকাশ-পাতাল সব পিঠে নিয়ে সেই অশ্বেশ্বর মহাশূন্যের ভিতর ছুটে বেড়াচ্ছেন। কী কাণ্ড! প্রতিদিন প্রভাতবেলায় সমস্ত ঘোটক-ঘোটকী সামনের দুই পা মুড়ে মাটির উপর আধখানা বসে প্রার্থনা করেঃ ‘হে তুরগেশ্বর! আমাদের প্রার্থনা শোনো। আমাদের তুমি যোজনের পর যোজন ঘাসজমি দাও। জলভরা হ্রদের পর হ্রদ দাও, প্রভু। আমাদের দিকে যেন আমাদের প্রিয় ঘোটকীরা প্রেমভরে তাকায়, কাছে আসে, গা চেটে দেয়। আমরা যেন ঘোটকসমাজে সমর্থ বলে সম্মান পাই।’
একদিনও সকালে নীলাক্ষ এই সব প্রার্থনায় বসে না। জোর করে বসালেও সে ভাবে, কখন এই যোগাসন শেষ হবে। প্রার্থনা সে করে না। ওরকম কোনো অশ্বেশ্বরে তার বিশ্বাস নেই। যদি সত্যিই কোনো ঈশ্বর থাকেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই স্বাধীনতার ঈশ্বর হবেন। কিংবা ওই স্বাধীনতাই ঈশ্বর। ওই যে যেটা সারাদিন শ্বাসবায়ু হয়ে নীলাক্ষর ভিতর হুম্ হুম্ গুম্ গুম্ করে শিরায় ধমনীতে দারুণ অগ্নিস্রোতের মতো দৌড়োচ্ছে, ওটিই নীলাক্ষর ঈশ্বর।
নীলাক্ষর এসব অবাধ্যতা তাদের সমাজের কেউই ভালো চোখে দেখে না। নীলাক্ষর পিতা কে, নীলাক্ষ জানে না। হবে কেউ একটা। নীলাক্ষর মা হৃষ্টরোমা নীলাক্ষকে তার পিতা চেনায়নি। কোনো অশ্বিনীই তার সন্তানকে ওসব বলে দেয় না। তাদের মধ্যে অন্য সব কঠিন নিয়ম আছে। কেউ বনের ত্রিসীমানার বাইরে যাবে না। কোথাও সন্দেহজনক গহ্বর দেখলেই চেঁচিয়ে অন্যদের ডাকবে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পা ঠুকবে না। আগুন দেখলেই ভয় পাবে। আরও কত কিছু। একটা নিয়মও নীলাক্ষ মানে না। তাই নিয়েই অন্যদের কত কথা!
অশ্বসমাজে নামকরণ মানুষের মতো ব্যঞ্জনাত্মক শব্দে হয় না। কারও নাম হয় না আয়ুধ বা অনামিকা। ওসব ব্যঞ্জনাত্মক নাম। মানুষের নাম। ঘোড়াদের নামকরণ হয় শারীরিক লক্ষণ মিলিয়ে। যেমন—নীলাক্ষ, হৃষ্টরোমা, সিতিগ্রীব, ফেনকেশর ইত্যাদি। ঠিক এই শব্দগুলোই নয়। এসব শব্দের অশ্বভাষায় অনুবাদ করলে যা যা হয়, ওই সব শব্দেই ঘোড়ারা পরস্পরকে ডাকে। তবু আপাতত, এ কাহিনিতে নীলাক্ষকে নীলাক্ষ বলেই ডাকা যাক। যদি ডাকি, তাতে কারও কোনো সমস্যা আছে?
সমস্যা নেই। কেননা নীলাক্ষর কোনো সমস্যাই নেই এসব ব্যাপারে। তার শুধু একটাই সমস্যা। কী করে সে এই যাবতীয় দুষ্টুমি বজায় রেখে তার মা-কে একটু খুশি রাখতে পারে। কেন যে সে মায়ের উপরে এত দুর্বল! বেচারি মা! কিচ্ছু জানে না। জানে না বলেই মা-কে এত ভালোবাসতে ইচ্ছে করে নীলাক্ষর। অন্যান্য ঘোড়ারা একথাও বলে, তার এই মা-ঘেঁষা ভাবটা মোট্টে ভালো না, মোট্টে ভালো না!
নীলাক্ষ কল্পনা করে, কোনও এক বসন্তের রাতে প্রসবযন্ত্রণায় কাতর হয়ে শাল্মলী গাছের নীচে খড়ঘাসভরা ভিজে মাটিতে সামনের পা দুটো মুড়ে বসে পড়েছিল তার মা হৃষ্টরোমা। ধীরে ধীরে একদিকে কাত হয়ে শুয়েছিল সে। তীব্র ব্যথায় ও উত্তেজনায় পেটটা ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাসে উঠছিল পড়ছিল। এমনই একটা মুহূর্তে মাটিপৃথিবীর টানে গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসছিল নীলাক্ষ ধীরে ধীরে। নীলাভ উল্বে ঢাকা ছিল তার নবজাত অবয়ব। তারপর এক সময় মায়ের গর্ভ থেকে জন্মপথ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল উল্বাবৃত নীলাক্ষ। ধীরে ধীরে উল্ব বিদীর্ণ হয়ে গেল, নড়াচড়ার ফলে ছিঁড়ে গেল নাভির বাঁধন। ক্লান্ত, অবসন্ন প্রসূতী হৃষ্টরোমা খানিক বিশ্রাম নিয়ে ফিরে তাকিয়েছিল সদ্যোপ্রসূত সন্তানের দিকে। অর্ধস্বচ্ছ চোখ তুলে নীলাক্ষও দেখেছিল মায়ের মুখ জীবনে সেই প্রথমবার। ঘাড় ঘুরিয়ে মা তার জিভ দিয়ে লেহন করে করে পরিষ্কার উজ্জ্বল করে তুলেছিল নীলাক্ষর ত্বক। ক্ষুধার্ত নীলাক্ষ মায়ের ভারী হয়ে ওঠা স্তনে মুখ দিয়ে সেই প্রথম পান করেছিল মায়ামৃত। তারপর সেই শাল্মলীর ছায়ায় খড়ঘাসের শয্যায় মা-পুতে ঘুমিয়ে পড়েছিল শান্তিতে।
এসব নীলাক্ষর মনে নেই। সে এসব কল্পনা করেছে শুধু। তবু তার সেই কল্পনা ভিত্তিহীন নয়। পরে সে বহু ঘোটকীকে সন্তানের জন্ম দিতে দেখেছে। আর তার থেকেই সে কল্পনা করেছে সদ্যোপ্রসূতী তার মাকে, সদ্যোপ্রসূত নিজেকে।
মা কখনও এই অরণ্যের বাইরে যায়নি। ঘোটক-সমাজের ঘোষিত নিয়ম মেনে চলেছে মা সারাজীবন কঠোরভাবে। মা মনে করে, এই বনের সীমানাতেই পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই মায়ের ঘোরাফেরা। শুধু ঘাসখাওয়া, অন্য পুরুষ-ঘোটকদের সঙ্গ দেওয়া, আর ক্লান্ত হয়ে পড়লে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোনো। এর বাইরে মা কিছু জানে না বলেই মায়ের জন্যে নীলাক্ষর খুব করুণামায়া হয়। আহা, কিচ্ছুটি জানে না তার মা! কেমন সরল শিশুঘোটকীর মতো এখনও তার মায়ের চোখমুখ।
শুধু মা কেন, এ অরণ্যের কোনো অশ্ব, অশ্বিনীই জানে না যে, এই অরণ্যের বাইরে কী আছে। কিন্তু নীলাক্ষ? নীলাক্ষ জানে! জেনে ফেলেছে!
একদিন অপরাহ্ণবেলা। দলছুট হয়ে সে অরণ্যের শেষ সীমানায় গেছিল। সে দেখেছিল, এর পর গাছেদের প্রহরা আর নেই। এর পর ঢালু জমি। জমিটা ওই সূর্যাস্তের দিকে কোথায় যেন গিয়েছে। যাবে সে ওই ঢালু জমি পার হয়ে আরও দূরে ধূসর মাটির দিকে? যাবে?
সহসা একটা নিষিদ্ধ উত্তেজনা নীলাক্ষর সমস্ত শরীরে মনে যেন উদগ্র উন্মত্ততা এনে দিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল যে, সে ঘোড়াদের নিয়ম ভাঙতে চলেছে। কোথা থেকে ছোটো একটা ভয়ের কুণ্ডলী কাঁপছিল তার বুকের মধ্যে ধিরিধিরি ধিরিধিরি। একবার অসহিষ্ণুভাবে মাটিতে পা ঠুকে সে অকস্মাৎ ভয়ের কুণ্ডলীটাকে গিলে ফেলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বনের ভিতর থেকে।
তারপর শুধু দৌড়, দৌড় আর দৌড়। কত দূরে সে চলে যাচ্ছে! ওই দূরে যেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, ওইখানেই পৃথিবীটা শেষ হয়েছে নির্ঘাত। নীলাক্ষ ওখানেই যাবে, দেখে আসবে সে পৃথিবী কোথায় শেষ হয়। দুরন্ত উল্লাসে সে ছুটছিল ঝড়ের গতিতে। তার মুখ দিয়ে গলিত মুক্তার মতো উজ্জ্বল ফেনাস্রোত ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসছিল। ঘাড়ের উপর শুভ্র কাশগুচ্ছের মতো শ্বেত কেশর বারবার উড়ে উড়ে এসে আছড়ে পড়ছিল। তার ক্ষুরের ক্লপ্ ক্লপ্ শব্দে মুখর হয়ে উঠছিল নির্জন প্রান্তর। উষ্ণ বাতাস সোঁসোঁ করে বইছিল ঝড়ের মতো তার শরীরের দুপাশ দিয়ে। আকাশ হয়ে উঠেছিল তাম্রাভ নীল মাথার উপরে।
কিন্তু অনেক দৌড়েও সে পৃথিবী কোথায় শেষ হয়, দেখতে পেল না। যতদূর যায়, আরও আছে, আরও আছে অনন্ত বিস্তার। দিকচক্রবাল সরে গেছে দূরে, যার প্রান্ত চুম্বন করে সহসা কখন সূর্য ডুবে গেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। মাথার উপর সেই অন্তহীন মহানভে দীপ্তিময় নক্ষত্রেরা এক এক করে জেগে উঠে তাকিয়ে আছে ফিরৎপথগামী নীলাক্ষর দিকে।
এত সুন্দর, এত বিরাট এই পৃথিবী? বনের অন্ধকারে ডুবে থেকে তারা তো এসব জানতেই পারে না! হঠাৎ সমাসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারের ভিতর ফিরতে ফিরতে কারও একজনের ভালোবাসা পাওয়ার গভীর আবেগ জেগে উঠেছিল নীলাক্ষর সমস্ত শরীরে, মনে সেদিন। কিন্তু সে কোনও ঘোটকীর প্রণয়মধু নয়। কিংবা মায়ের স্নেহসুধাও নয়। এমন কেউ, যে এই আকাশের মতন বিরাট, বায়ুর মতন খরবেগবান, সূর্যের মতন ভাস্বর, নক্ষত্রের মতন তেজোময়, পৃথিবীর মতন অন্তহীন। কিংবা এমন কেউ, যার মধ্যে এই সমস্ত গুণ সমাহিত হয়ে আছে। তেমন কেউ কি আছে পৃথিবীতে? তেমন কেউ যদি নীলাক্ষকে বন্ধু হিসেবে ভালোবেসে ডাক দিত, ভৃত্য হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে; তাহলে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে এই জল-জঙ্গল-টিলাপাথর-মরুভূর ক্লান্ত, সংকীর্ণ জীবন ছেড়ে দিশাশূন্যপথে উধাও হয়ে যেত একখুনি।
ফিরে এসে পরের দিনই নীলাক্ষ বলেছিল তার এই নবীন আবিষ্কারের কথা তার সঙ্গীদের। বলেছিল রোহিতকে, সিতিগ্রীবকে। এই বনের বাইরে যে বিরাট পৃথিবীটা পড়ে রয়েছে, তারই কথা।
সব কথা শুনে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকাল ওরা। তারপর হাসির মতন একটা হুররর্ ফুররৎ শব্দ করে সিতিগ্রীব বলেছিল, ‘ধুর, এই সব তোর বানানো কথা। বনের বাইরে কিছু আছে নাকি? ওই নাবাল জমিটাই পৃথিবীর শেষ সীমা, ওখানেই সূর্য অস্ত যায়।’
রোহিতও সিতিগ্রীবের কথায় সায় দিয়ে যান্ত্রিকভাবে বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব তোর বানানো কথা… সব বানানো কথা। নাবাল জমিতেই পৃথিবী শেষ… নাবালেই পৃথিবী শেষ…’
প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল ওদের কথা শুনে। কিন্তু রাগটা তখনই প্রকাশ করল না নীলাক্ষ। পরিবর্তে সেদিন দুপুরে অন্য ঘোড়ারা যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, রোহিতকে আর সিতিগ্রীবকে নীলাক্ষ কথায় কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেল বনের প্রান্তে। নাবাল জমিটা দেখিয়ে ওদের বলল সে, ‘ওই দেখ ঢালু জমির পরেও অতটা মাঠ, তারপর পাহাড়, তার পেছনে আছে মরুভূমি। আমি যাচ্ছি, তোরাও আমার পিছু পিছু আয়।’
কিন্তু নীলাক্ষর এই কথা শুনেও ওরা আর এগোতে সাহস করল না। খালি আগুপিছু করে, খালি আগুপিছু করে। তারপর নীলাক্ষ যখন বেপরোয়া হয়ে লাফ দিয়ে বনের বাইরে বেরিয়ে সামনের দিকে ছুটে যেতে লাগল, তখন ওরাও আর থাকতে না পেরে, খানিকটা নীলাক্ষর টানেই ওর পেছন পেছন দৌড়তে লাগল। একটু পরেই আড় ভেঙে গেল সিতিগ্রীব আর রোহিতের। নীলাক্ষর পেছন পেছন দৌড়তে দৌড়তে ওরাও ওদের শিরায় ধমনীতে স্নায়ুতে অনুভব করতে লাগল ধাবমান অগ্নিস্রোত, স্বাধীন জীবনের প্রথম আস্বাদ।
এর পর থেকে দুয়েকদিন বাদে বাদেই ওরা নিয়ম ভাঙতে লাগল। মাঝে মাঝেই বনের সীমানা ছাড়িয়ে তিন যুবনাশ্ব বেরিয়ে পড়তে লাগল নিষিদ্ধ পৃথিবীর পথে।
২
কিন্তু এই করতে গিয়েই বিপদ হয়ে গেল একদিন।
সেদিন বিকেল হয়ে এসেছে। ধূসর প্রান্তর পার হয়ে তিনটি অবাধ্য অশ্ব আরেক বনভূমির মধ্যে প্রবেশ করেছিল। অবশ্য একে বনভূমি বলা বাতুলতা। কতগুলো কাঁটাঝোপে ঢাকা একটা অনুচ্চ টিলা বলাই ঠিক হবে। টিলার উপরটা কিন্তু সমতল আর সেই চ্যাটালো জায়গাটায় অপেক্ষাকৃত বৃহৎ বনস্পতির সমাবেশ। এবং সেই সমাবেশের মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ ঘাসে ঢাকা পথ। ওই পথটা দেখে সিতিগ্রীব, নীলাক্ষ আর রোহিতের ভারি আনন্দ হল। ওরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করল, কে এই পথটা দিয়ে আগে ছুটে টিলার অন্তিমবিন্দুতে খাদের মুখে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হবে।
যা ভাবা, তাই কাজ। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনজনেই পাশাপাশি ছুটতে আরম্ভ করল। নীলাক্ষ প্রথমে ইচ্ছে করেই পিছিয়ে ছিল। খানিক পরে সিতিগ্রীব আর রোহিত যখন সামান্য হাঁপিয়ে উঠেছে, তখনই বেগ বাড়াল নীলাক্ষ। তিরের মতো দুরন্ত বেগে রোহিত আর সিতিগ্রীবকে অতিক্রম করে সম্মুখে আরও সম্মুখে এগিয়ে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিতিগ্রীব আর রোহিতের থেকে হাত দশেক সামনে এগিয়ে গেল নীলাক্ষ।
কিন্তু এই ভাবে অগ্রসর হয়ে আরও কিছুটা যাওয়ার পরে নীলাক্ষর মনে হল, পায়ের নীচে মাটি যেন কেমন নরম আর ঝুরঝুরে। বন্ধুদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে তীব্র হ্রেষারবে ডেকে উঠল নীলাক্ষ।
ঠিক পরমুহূর্তেই সে বুঝতে পারল, সামনে লতাপাতাঢাকা একটা বৃহৎ বিবর আসছে। ব্যাপার কী বোঝার আগেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের নির্দেশে প্রচণ্ড শব্দ করে সে লাফ দিল বিবরটার উপর দিয়ে। উড়ে গিয়ে পড়ল সে বিবরের ওপাশে সমতলের উপর এক লহমায়।
কিন্তু, হায়! সিতিগ্রীব বা রোহিত—কেউই সতর্ক হওয়ার সময় পায়নি। হুড়মুড় করে ওরা দুজন সেই লতাপাতার আবরণ ভেদ করে গিয়ে পড়েছে বিবরের মধ্যে।
বিবরের ওদিকে সমতলের উপরে পড়েও বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি নীলাক্ষ। গতিজাড্যের কারণে সে আরও সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। আরেকটু এগোলেই সেই ব্যাদিত-আনন খাদ। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে নীলাক্ষ। আর ঠিক সেই সময়েই মাথার উপর দিয়ে কোথা থেকে একটা জাল উড়ে এসে নীলাক্ষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই কতগুলো মানুষের উচ্চকিত হাসির শব্দ আর তীক্ষ্ণ শিস ধেয়ে এল ওদের কানে।
এতক্ষণে বুঝতে পারল, নীলাক্ষ এখানে ঠিক কী হচ্ছে। রোহিত, সিতিগ্রীব বন্দী হয়ে পড়ে আছে সেই গর্তে। আর নীলাক্ষ ধরা পড়েছে জালে। তার মানে, কতগুলো মানুষ ওদের ধরবার জন্যেই এই নির্জন স্থানে ফাঁদ পেতেছে।
ভীষণভাবে দুই পা ছুঁড়ে, প্রাণপণে বলপ্রয়োগ করে সেই জালটাকে ছিঁড়তে চাইল নীলাক্ষ। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কতগুলো কালো কালো ধনুর্ধর মানুষ। তাদের হাতের তির ও ভল্লগুলো রোদ লেগে ঝকঝক করছিল।
অত্যন্ত সুকৌশলে শিকারি লোকগুলো ক্ষিপ্রবেগে ওদের তিনজনকে টিলা থেকে নামিয়ে এনে তিনটি শকটে তুলল বন্দী অবস্থায়। শকটের চারিদিকে লোহার বেড়া, বেড়ার গায়ে তালাবন্ধ দ্বারপথ। বহু চেষ্টা করেও, বারবার ধাক্কা দিয়েও নীলাক্ষ, সিতিগ্রীব, রোহিত সেই বেষ্টনীর বজ্রকঠিন লৌহশলাকা ভাঙতে পারল না।
শকট চলতে লাগল। লোকগুলো ওদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে। নীলাক্ষ লক্ষ করল, প্রতিটি শকট টানছে দুটি করে ঘোড়া! ওদের মতনই কতগুলো ঘোড়া! নীলাক্ষ অশ্বভাষায় সেই সব শকট-সংযুক্ত ঘোড়াদের উদ্দেশে বলে উঠল, ‘ভো বান্ধবাঃ! তোমরা নিজেরা ঘোড়া হয়ে স্বজাতীয় আমাদের এই সব ঘৃণ্য মানুষের হাতে বন্দী হতে সাহায্য করছ? ধিক তোমাদের অশ্বপরিচয়ে! এ কাজ তোমাদের মানায় না। এখনই মনুষ্যনির্দিষ্ট এই বাঁধা পথ ছেড়ে অনিয়মিত পথে এসব শকট অরণ্যে টেনে নিয়ে চলো, আমাদের মুক্ত হতে সাহায্য করো। নিজেরাও এই দাসত্ব থেকে মুক্ত হও! হ্যাঁ, এখনই।’
কিন্তু নীলাক্ষর কথাগুলো যেন ওই শকট-সংলগ্ন ঘোড়াগুলো শুনতেই পেল না। পেছনের শকট দুটি থেকে রোহিত আর সিতিগ্রীবও চেঁচাচ্ছিল। কোনোরকম আওয়াজ পেলে ঘোড়া তার কানদুটো উন্মুখ করে তোলে। অথচ এক্ষেত্রে নীলাক্ষদের অতখানি চিৎকারেও ভারবাহী দাস ঘোড়াগুলো কান পর্যন্ত খাড়া করল না। তাদের চোখে ঠুলি পরানো, সামনের জমিটুকু ছাড়া আশপাশের কোনো কিছুই দেখবার পর্যন্ত অধিকার নেই ওদের। দুলকি চালে মাথা নিচু করে ভারবাহী জন্তুগুলো নীলাক্ষদের টেনে নিয়ে চলল সেই দিকে, যেদিকে তাদের প্রভু মানুষেরা যেতে বলেছে।
৩
এখন নীলাক্ষদের চোখে মুক্তির আকাশ আর নেই। একটা দুর্গন্ধযুক্ত আস্তাবলে অন্য ঘোড়াদের সঙ্গে তারা বাঁধা থাকে সারা দিন। সকাল আর বিকেলের দিকে ঘোড়দৌড়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে ওদের দৌড় করানো হয়। কতগুলো লোক সমস্ত দিন চাবুক হাতে ওদের সহবৎ শেখায়। এই চাবুকধারী লোকগুলোর মোড়ল হচ্ছে কাল্লা ভীল। লোকটাকে সাক্ষাৎ যমদূত বললেও কম বলা হয়। সামান্যতম অবাধ্যতা দেখলেও কাল্লা ভীল ঘোড়ার একবেলার খাবার বন্ধ করে দেয়। কাঁটাওলা চাবুক দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ঘোড়ার পিঠ রুধিরপ্লুত করে দেয়।
রোহিত আর সিতিগ্রীব এই দুরবস্থা অনেকটাই মেনে নিয়েছে মুখ বুজে। তবে মনোবেদনার কারণে ওরা দুজন বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে দিন দিন। ওদের এই দুরবস্থার জন্যে নীলাক্ষ নিজেকেই অভিসম্পাত দেয়। কেন যে সে মরতে ওদের বনের বাইরে নিয়ে এসেছিল!
নিজের কথা ভাবে না সে। এমনিতেও বনের মধ্যে সে চিরকাল আবদ্ধ থাকতে পারত না। বেরিয়ে তাকে আসতে হতই। আজ নয় কাল। হ্যাঁ, স্বাধীনতার পথ কোনোদিনই মসৃণ নয়। সেকথা সে জানে। এখানকার আস্তাবলের নিয়মও সে মেনে নেয়নি একটিও। তাকে চাবুক মেরে মেরে রক্তাক্ত করেও কাল্লা ভীল বাগে আনতে পারেনি। খাওয়া বন্ধ করলেও ঘেঁচু। ওই তো খাবার! কতগুলো ছোলা আর দানাশস্য। ও খেলেও কী, আর না খেলেও কী। নীলাক্ষর শরীরে এত শক্তি আছে যে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ একাদিক্রমে না খেয়েও সে থাকতে পারে। এতটুকু অসোয়াস্তি বোধ করে না সে। তার শুধু চাই স্বাধীনতা। দুর্বার স্বাধীনতা।
এখন সে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছে। কোনো মানুষ তার কাছে এলেই সে অবিরত লাথি ছুঁড়তে থাকে। পেছনে এসে দাঁড়ালে চাট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। তার পিঠে সে আজও কাউকে বেশিক্ষণ উঠে বসতে দেয়নি। কেউ পিঠে উঠলেই সামনের দুই পা তুলে চরম হ্রেষারবে আকাশবাতাস আকুল করে তুলে সওয়ারিকে পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নয়তো প্রথমে দুলকি চালে চলে সওয়ারিকে সামনে নিয়ে যাওয়ার ভান করেছে। তারপর ছুটে গেছে নিচু নিচু ডালযুক্ত আমবাগানের মধ্য দিয়ে, যাতে সওয়ারির মাথা, গা, হাত, পা আম্রতরুর প্রসারিত বাহুসমূহে আহত হয়ে অচিরেই রক্তাপ্লুত হয়ে ওঠে। যাতে সুযোগ পেলেই ‘বাপ-বাপ’ বলে সওয়ারি তার পিঠ থেকে নেমে প্রাণে বাঁচে। পিঠে চড়বি তোরা? মাথা ফাটিয়ে দেব, মেরেই ফেলব সব ক-টাকে। এখানকার সবাই তাকে নাম দিয়েছে ‘রাক্ষস ঘোড়া’।
প্রতি শনিবার ভীলেরা ওদের নিয়ে ঘোড়ার হাটে যায়। সেখানে আসে অনেক ঘোড়ার ব্যাপারি। কখনও কখনওসখনও কোনো রাজাগজা লোক। কিংবা তাদের সামন্ত, অনুচর, সৈনিক। উপযুক্ত দাম পেলে কাল্লা ভীল ঘোড়া বেচে দেয় ওদের কাছে। নীলাক্ষ দেখেছে, ওদের আস্তাবলের অনেক ঘোড়া ওর চোখের সামনেই ব্যাপারি বা সৈনিকদের সঙ্গে চলে গেছে। এখন থেকে ওরা ব্যাপারি বা সৈনিককে পিঠে নিয়ে বইবে, নয়তো মোট বইবে মালিকের। দেখে দেখে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে নীলাক্ষ।
হয়তো দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে সিতিগ্রীব বা রোহিত এখনও অবধি বিক্রয় হয়নি। আর নীলাক্ষ তো বশই মানেনি কারও কাছে আজ অবধি। ক্রেতা সামনে এলে সে এমন অবাধ্য মূর্তি ধরে, তার সেই ভয়ংকর রূপ দেখে ক্রেতাকুল ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় দূরে। বলে, ‘বাপ্পা রে বাপ্পা! কী জংলি ঘোড়া! একে বাগ মানানো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। না হে কাল্লা ভীল, তুমি অন্য অশ্ব দেখাও!’
নীলাক্ষ এখনও অবধি কিছুটা কথা শোনে শুধু একজনের। সে হল কাল্লা ভীলের বারো-তেরো বছরের ছেলে এক্কা। কালো কষ্টিপাথরে যেন গড়া ছেলেটির শরীর, কাঁধ অবধি নেমে এসেছে তার কুঞ্চিত কেশদাম। ভারী সুন্দর ছেলেটি। এই এক্কার সঙ্গেই কথঞ্চিৎ ভাব হয়েছে নীলাক্ষর। অশ্বহট্টে যখন সে ভয়ানক অবাধ্যতা করতে থাকে, কারও কথা শোনে না, তখন কেবল এক্কাকেই নীলাক্ষ কাছে আসতে দেয়। এক্কা খুব সুন্দর করে নীলাক্ষর গায়ে হাত রাখে, মিষ্টি করে কথা বলে, ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগায়। কখনও কখনও এক্কাকে নিজের পিঠেও চাপতে দেয় নীলাক্ষ। গ্লপ্ গ্লপ্ শব্দ করে ছোটো ছোটো পদক্ষেপে এক্কাকে নিয়ে হাটখোলার বাইরের মাঠ থেকে ঘুরে আসে নীলাক্ষ কিছুক্ষণ। হয়তো এক্কার সঙ্গে নীলাক্ষর এই ভাব দেখেই কাল্লা ভীল নীলাক্ষকে এখনও মেরে ফেলেনি। তা না হলে যা বে-ইজ্জতি সে করেছে কাল্লা ভীলের!
যখন রাত্রি আসে, আস্তাবলের ঈষৎ-স্বচ্ছ আবরণের উপর নীল অন্ধকার থমকে থাকে, নিশার প্রগাঢ় অন্ধকার ভেদ করে আকাশের দুয়েকটি তারা এই সংকীর্ণ কারাগারের মধ্যেও তাদের ঋজু রশ্মিরেখা প্রেরণ করে, হুহু করে দীর্ঘশ্বাসের মতন বাতাস ওঠে, নীলাক্ষর মনে পড়ে তার মায়ের কথা, ফেলে আসা সেই বনভূমির কথা। সেখানে সমাজবদ্ধতা ছিল, কিন্তু এতদূর দাসত্ব ছিল না। কী জানি, তার মা কেমন আছে? তাকে ভুলে যায়নি তো? হয়তো কত খুঁজেছিল তাকে সেই দিন থেকে, যেদিন তারা শিকারির ফাঁদে ধরা পড়েছিল। রোহিতের মা, সিতিগ্রীবের মাও হয়তো বিফল অন্বেষণ করে ফিরেছে ওদের। আর কি কখনও নীলাক্ষরা তাদের সেই আদি বাসভূমি, সেই ছায়ানিবিড় বনভূমিতে ফিরে যেতে পারবে?
কিন্তু শুধু এই ভাবালুতায় ডুবে থেকে কেবল হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার জন্যেই নীলাক্ষ জন্মায়নি। পরাধীনতার বেদনাকে হৃদয় জুড়ে সে অনুভব করেছে, এখন সে বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো কার্যকর উপায় বের করার চেষ্টা করে চলেছে রাতের পর রাত ধরে; যাতে এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে পারে। শুধু একটা মতলব বুদ্ধি খাটিয়ে বের করাই নয়, পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে হবে তারপর; যাবতীয় ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে। স্বাধীনতা লাভের এই তিন শর্ত; বন্ধনের তীব্র অনুভব, বিচারশাণিত কার্যকর উপায়-নির্ধারণ, অদম্য ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। নীলাক্ষর গভীর বিশ্বাস, সে পারবে। আস্তাবলের এই দুর্গন্ধযুক্ত অন্ধকারেই তার জীবন অপক্ষয়িত হয়ে যেতে পারে না। এরও পরে উজ্জ্বল আশার আলোক।
সেই ‘আলোক’ এল তার মস্তিষ্কে একদিন মধ্যযামিনীতে। এক্কা। কাল্লা ভীলের ছেলে এক্কা ভীল! এক্কাই তার মুক্তির কার্যকর উপায়। নিশ্চিত নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা।
আগামী শনিবারেই আসবে তার মুক্তি। শুধু মুক্তিই নয়, একই সঙ্গে প্রতিশোধ। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নির্মম, ক্ষমাহীন প্রতিশোধ। পরিকল্পনাটা সে রোহিত বা সিতিগ্রীবকে বলল না তখনই।
এল সেই কাঙ্ক্ষিত শনিবার। প্রভাতেই কাল্লা ভীল এক্কা সহ অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে হাটে চলল। সঙ্গে তার বহুমূল্য পণ্যসম্ভার—শৃঙ্খলাবদ্ধ অশ্বযূথ। ঘোড়ার সেই কাতারে কাতারবন্দী হয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল নীলাক্ষ, রোহিত, সিতিগ্রীবও।
অশ্বের হাট জমে উঠেছে। ব্যাপারিরা আসছে ইতস্তত। ঘোড়া বিক্রয়ও চলছে কিছু কিছু। মাঝদুপুর থেকে নীলাক্ষ শুরু করল তার চরম পাগলামি। খুঁটির বাঁধন উপড়ে ফেলল সে সবলে। চারপায়ে লাফাচ্ছে, নাচছে, ঘাড়মাথা দোলাচ্ছে উন্মত্তের মতো, বিপুল হ্রেষারবে সচকিত করে তুলছে চারিদিক। দেখে মনে হচ্ছে, নীলাক্ষকে কেউ আহার্যের সঙ্গে সুরা পান করিয়ে দিয়েছে অথবা সে একেবারে বেহেড হয়ে পড়েছে। চাপা স্বরে একবার সে বলল পার্শ্ববর্তী রোহিত আর সিতিগ্রীবকে, ‘যতটা পারিস জোর প্রয়োগ করে এখনই খুঁটি উপড়ে রাখ। যথাসময়ে ইঙ্গিত দিলেই তোরা আমার পিছু পিছু দৌড়োবি। যদি বাঁচতে চাস, তবে এই কিন্তু শেষ সুযোগ!’
নীলাক্ষর এমন বেহেড অবস্থা দেখে কাল্লা ভীল প্রমাদ গণল। অন্যদিনও অভব্যতা করে, কিন্তু এতদূর কোনোদিনই করেনি। হাটের ক্রেতারাও কানাকানি করছিল, ‘কী একটা জংলি ঘোড়াকে নিয়ে এসেছে কাল্লা! হয় দানাপানি দেয়নি, নয়তো সহবতটুকুও শেখায়নি।’
ক্রমশই রেগে আগুন হয়ে উঠছিল কাল্লা ভীল। তবু একই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছিল, নীলাক্ষকে চাবুক মেরে শান্ত করা এখন দুরাশা। অবশেষে এক্কাকে ডেকে বলল কাল্লা, ‘বাপো রে! দেখত রে এ উদ্ভট জানোয়ারটাকে তুই শান্ত করতে পারিস কি না!’
কাল্লার কথামতো এক্কা এগিয়ে এল গুটি গুটি পায়ে নীলাক্ষর দিকে। এক্কাকে দেখে কিছুটা শান্ত হওয়ার অভিনয় করল নীলাক্ষ। এক্কা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিল, আদরভরে কেশর আঁচড়ে দিল হাড়ের কাঁকুই দিয়ে। মুখে মুখ রেখে আদর করে বলল, ‘কী হয়েছে রে তোর, স্যাঙাৎ? এত ছটপট করছিস কেন? আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবি না আজ তুই?’
হ্যাঁ, সেইটেই তো নীলাক্ষ চায়। এক্কাকে পিঠে চাপিয়ে হাটের সম্মুখবর্তী প্রান্তরে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে আর এ নরকে ফিরে আসবে না সে। এক্কাকেও চুরি করে নিয়ে যাবে। এতদূরে নিয়ে যাবে যে, এক্কা জীবনে আর এখানে ফিরে আসতে পারবে না। বুঝুক কাল্লা ভীল, কারও সন্তানকে কেড়ে নিলে তার মা কিংবা বাবার কত কষ্ট হয়। নিজের জীবন দিয়ে বুঝুক। প্রতিশোধ! চরম প্রতিশোধ!
এতক্ষণে আরও শান্ত, সুশীল হয়ে গেছে নীলাক্ষ। আড়চোখে একবার দেখে নিয়েছে, ছটপট করতে করতে রোহিত ও সিতিগ্রীবও খুঁটির বাঁধন সংগোপনে উপড়ে ফেলেছে। এবার শুধু এক্কাকে পিঠে তুলে নেওয়ার অপেক্ষা। তারপর হঠাৎ কেউ কিছু বুঝবার আগেই দৌড়, দৌড়, ঊর্ধ্বশ্বাস অন্তহীন দৌড়।
এক্কার প্রশ্নের উত্তরে ঘাড়টা একবার দোলালো নীলাক্ষ। জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এক্কা বুঝতে পারল, নীলাক্ষ রাজি হয়েছে তাকে পিঠে তুলতে। গলা ধরে ঝুলে পড়ে নীলাক্ষর পিঠের উপর সওয়ারি হল সে। নীলাক্ষ চোখে চোখে একবার চাইল সিতিগ্রীব আর রোহিতের দিকে। তীক্ষ্ণ ইশারা করল। তারপরই…
এক মুহূর্তে জ্যামুক্ত তিরের মতো সামনের দিকে ছুটে প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রমই করছিল নীলাক্ষ, রোহিত, সিতিগ্রীব। কিন্তু ঠিক তখনই…
ঠিক তখনই অশ্বপ্রাকারের প্রবেশদ্বারপথে এসে দাঁড়াল তিনজন মানুষ। ওই তিনটে লোককে ঠেলে ফেলে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে নীলাক্ষদের মতলব বড়ো বেশি তাড়াতাড়ি টের পেয়ে যাবে কাল্লা। তাতে পুনরায় বন্দী হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। লোক তিনটের দিকে তীক্ষ্ণ, সজাগ নজর রাখছিল নীলাক্ষ। ওরা ভিতরে এলেই নীলাক্ষরা বাইরে বেরিয়ে যাবে ক্ষিপ্রবেগে।
মাঝখানের লোকটা বেশ দীর্ঘাকার; সচরাচর অতখানি উচ্চতা দেখা যায় না। ঠিক সেই অনুপাতে লোকটির প্রসর। অথচ মানুষটির শরীরে যেন একবিন্দু মেদ নেই। পোশাকের উপর দিয়ে তার বাহু, কাঁধ ও বুকের পেশিগুলি যেন আভাসিত হিল্লোলিত হচ্ছে। পরনে উজ্জ্বল হরিদ্রাভ আঙরাখা ও পায়জামা। মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে বর্ম। হাতে একটা দীর্ঘ ও গুরুভার ভল্ল সে অক্লেশে বহন করছে।
মানুষটির ডানদিকে অর্ধমুণ্ডিত মস্তক ও ক্ষৌরিত মুখমণ্ডল এক ব্রাহ্মণ, শিরোদেশে সুপুষ্ট শিখা। এই লোকটি গোলগাল চেহারার হলেও শরীরটা একেবারে শিথিল নয়। পরনে ধুতি আর মেরজাই।
বামদিকের তৃতীয় ব্যক্তি সম্ভবত সৈনিক বা সেনানায়কগোছের কেউ হবে। সৈনিক সুলভ পরিচ্ছদ, বলিষ্ঠ গঠন।
এই তিন ব্যক্তিকে দেখামাত্রই কাল্লা ভীল সামনে এসে মধ্যবর্তী ব্যক্তিকে প্রণাম করে একেবারে যেন গলে গিয়ে বিনয়ের অবতার সেজে বলে উঠল, ‘এ কী সৌভাগ্য! স্বয়ং কুমারজী আমার বিপণিতে এসেছেন! আপনি কেন কষ্ট করে হাটে আসতে গেলেন, হুকুম? আমাকে এত্তেলা পাঠালে আমিই তো আমার ঘোড়া সব কাতারবন্দী করে প্রাসাদে নিয়ে যেতাম!’
মধ্যবর্তী ব্যক্তি হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ‘তোমাকে বিশ্বাস কী, কাল্লা? তুমি কী বলতে কী দেখাবে! আর আমি যা খুঁজছি, তা কি তুমি জানো?’ মানুষটার কণ্ঠস্বর ভারি জোরালো, যেন অনেক দূর থেকে ঝড় আসার নিশ্চিত শব্দ। কেমন ব্যক্তিত্বপূর্ণ কথাবার্তা!
কাল্লা ভীল হাত কচলে বলল, ‘বেশ তো! আপনি নিজেই তবে দেখে নিন না, হুকুম! সব ঘোড়া এখানেই তো বাঁধা আছে। … অ্যাই এক্কা, নাম, নাম, ওই উদ্দণ্ড ঘোড়ার পিঠ থেকে নাম!’
মধ্যবর্তী ব্যক্তির আয়ত চোখের দৃষ্টি এবার নীলাক্ষর দিকে ফিরল। একবার সেদিকে দেখে নিয়ে লোকটি পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির উদ্দেশে মৃদু হেসে বলল, ‘সব ঘোড়া কি বাঁধাই আছে, চক্রপাণি? আমি তো দেখছি, তিনটি ঘোড়া খুঁটির বাঁধন এরই মধ্যে উপড়ে ফেলেছে।’
পার্শ্ববর্তী চক্রপাণি-নামক ব্যক্তিটি সহাস্যে উত্তর দিল, ‘ঠিকই বলেছ, বাউজিরাজ! সাদা ঘোড়াটি বেশ তেজস্বান অশ্ব। অন্য দুটিও তাই। তা না হলে খুঁটি উৎপাটিত করতে পারত না। তবে লাল ও ধূসর অন্য দুটি অশ্ব কিছু বা অপুষ্ট ইদানীং।’
মধ্যবর্তী ব্যক্তি হাতের ভল্ল সেনানায়ক গোছের মানুষটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে নীলাক্ষর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল নিরস্ত্র। ততক্ষণে এক্কা নীলাক্ষর পিঠ থেকে নেমে দূরে সরে গেছে।
কাল্লা ভীল চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওদিকে যাবেন না, কুমারজী! ওটা একেবারে বেয়াদপ ঘোড়া। এখনই পাগলের মতো পা ছুঁড়বে।’
কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাতমাত্র না করে এদিকেই আসতে লাগল আগন্তুক। নীলাক্ষ ভাবছিল, আবার লাফালাফি করে উন্মাদনার প্রদর্শন করবে কি না। কিন্তু তার আগেই আগন্তুক ব্যক্তি নীলাক্ষর গলদেশে হাত দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে স্পর্শ করতে লাগল ওকে। দিব্য আরাম অনুভব হচ্ছিল নীলাক্ষর। এ লোকটা কী করে জানে, গলায় হাত বুলোলে তার আরাম হয়। বাধা না দিয়ে সেই স্পর্শসুখ অনুভব করতে লাগল নীলাক্ষ একেবারে স্থির হয়ে।
তারপরই নীলাক্ষর পিঠে চাবুক মারার দাগগুলো দেখে শিউরে উঠল সেই ব্যক্তি। সিংহের মতন ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটা রোষকষায়িত নেত্রে তাকাল কাল্লা ভীলের দিকে। চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এ কী, কাল্লা? মেবার-রাজ্যে অশ্বের উপর অত্যাচার সম্পূর্ণ নিষেধ, জানো না?’
কাল্লা ভীল দুই হাত দিয়ে কান ধরে উঠবোসের ভঙ্গি করে প্রায় কেঁদে উঠল, ‘ভীষণ অপরাধ হয়ে গেছে, কুমারজী! আর কখনও হবে না। আসলে এ ঘোড়াটা একেবারে বেপরোয়া, উদ্দণ্ড প্রকৃতির…’
কাল্লার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আগন্তুক ব্যক্তি নীলাক্ষকে বলতে লাগল নিম্ন স্বরে, ‘আমার অসীম অপরাধ ক্ষমা করো, বন্ধু। আমি এ রাজ্যের যুবরাজ হয়েও তোমাকে প্রতিরক্ষা দিতে পারিনি। আমার নাম কুমার প্রতাপসিংহ। তোমার নাম কী, বন্ধু? তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? আমি বড়ো একা। সম্মুখে ভয়ানক শত্রু। তুমি কি আমাকে সঙ্গ দেবে? আমাকে কি একটু সাহায্য করবে তুমি?’
লোকটির চোখ জলে ভিজে এল। এত শক্তিশালী লোক, অথচ এমন করুণ হৃদয়? ওর সব কথা নীলাক্ষ বুঝতে পারছিল না। তবে সঙ্গ চাইছে, সাহায্য প্রার্থনা করছে, বন্ধুত্বের সকাতর আবেদন জানাচ্ছে, এটুকু বুঝতে পারল নীলাক্ষ। হ্যাঁ, এমন লোকই তো তার চাই। যে তাকে আদেশ করবে না। বন্ধু হবে। তবেই তো সে স্বাধীনভাবে ভালোবাসতে পারবে, ভালোবাসা দিতে পারবে। যেখানে স্বাধীনতা নেই, সেখানে প্রেমও নেই যে!
কেমন এক অননুভূতপূর্ব অনুভব নীলাক্ষর স্নায়ুমণ্ডলীর ভিতর দিয়ে নদীতীরের সুস্নিগ্ধ বাতাসের মতো বয়ে যাচ্ছে যেন। এমন বন্ধুরই তো সাহচর্য চেয়েছে সে চিরকাল। এমন প্রেম, এমন স্বাধীনতা… হ্যাঁ, সে যাবে। এই ব্যক্তির সঙ্গেই সে চলে যাবে। একেই সহায়তা করবে শত্রুবিজয়ে।
সম্মুখের দুই পা ঊর্ধ্বে তুলে হঠাৎ চিঁ-হি-হি শব্দে নীলাক্ষ লোকটির আবেদনে অনুমোদন জানাল। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল কাল্লা, ‘দেখেছেন, হুকুম, কেমন বেয়াদপ! সরে আসুন, হুকুম, ও এখুনি লাথি ছুঁড়বে।’ চক্রপাণি-নামক ব্যক্তিটিও সোচ্চারে বলে উঠল, ‘সাবধান, বাউজিরাজ! এ একেবারে বন্য অশ্ব! অপ্রশিক্ষিত!’
ওদের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নীলাক্ষর পিঠের উপর অনায়াসে উঠে বসলেন কুমার প্রতাপসিংহ। সেই প্রভঞ্জনসদৃশ মন্দ্র স্বরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘না, না, এ অশ্ব আমার মিত্রতার আবেদন স্বীকার করছে। তাই আমাকে পিঠে উঠতে দিয়েছে। চক্রপাণি মিশ্র! দুদা সর্দার! তোমাদের কাছে যা অর্থ আছে, তা এই তিনটি অশ্বের মুক্তিপণ হিসেবে কাল্লা ভীলকে দিয়ে অন্য দুটি অশ্বকে মুক্ত করে নিয়ে উদয়পুর প্রাসাদে এস। আমি এই দুরন্ত বীর শ্বেতাশ্ব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। তোমরাও আমার অনুগমন করো।’
এই পর্যন্ত বলেই নতজানু কাল্লা ভীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই সাদা ঘোড়ার কী নাম রেখেছ, কাল্লা? নাম তো একটা আছে। কী বলে ডাকব একে?’
কাল্লা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বুনো ঘোড়ার কি নাম থাকে, হুজুর?’
অমনি ঘাড় উঁচু করে ‘স্ফুরৎ’-শব্দ করে উঠল নীলাক্ষ। বুঝি সে অশ্বভাষায় বলে উঠল, ‘আমার নাম নীলাক্ষ!’
কিন্তু তার সেই অশ্বভাষা বুঝতে পারলেন না কুমার প্রতাপ। হেসে উঠে বললেন, ‘বেশ। আমিই তবে এর নামকরণ করব। আজ থেকে আমার এই বন্ধুর নাম হবে—চেতক!’
আবার কুমার প্রতাপের কথায় তীব্র হ্রেষারবে সম্মতি জানাল নীলাক্ষ। নামটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে।
পরমুহূর্তেই সে কুমার প্রতাপসিংহকে পিঠে নিয়ে অশ্বপ্রাকার লাফ দিয়ে পার হয়ে যেন সুদূর ভাবীকালে লিখিত ইতিহাসের সমুজ্জ্বল পৃষ্ঠার দিকে দুরন্ত বাতাসের বেগে উধাও হয়ে গেল।
শেয়ার করুন :