নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
একে আমি ভৌতিক ঘটনা বলতে চাইনা। আমার জীবনের একটা অলৌকিক ঘটনার কথা বলব।
আমি তখন শান্তিনিকেতনে, সম্ভবত, উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবন রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে একটা ‘মাল্টিমিডিয়া’ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। সেই প্রকল্পে যে দু-চারজন ছাত্রকে নেওয়া হয়েছিল আমি ছিলাম তাদের একজন। নতুন নতুন সব যন্ত্রপাতি আসছে। বিচিত্রা বাড়ির ছাদে একটা বিরাট ছাতা লাগিয়ে সেই প্রথম ইন্টারনেট এলো রবীন্দ্রভবনে।
‘সিলিকন গ্রাফিক্স’-এর একটা কম্পিউটারে আমরা পালা করে কাজ করতাম। আমাদের বেশ রাত অবধি কাজ করতে হতো। আমাদের ঘরটা ছিল রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালার অপ্রদর্শিত ঐতিহাসিক জিনিসপত্রের ‘স্টোর রুম’-এর একটু দূরে একেবারে উল্টো দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠেই।
ওই ঘরের ভিতর, আমি শুনেছি, ঠাকুরবাড়ির অনেক কিছুর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের একটা টাইপরাইটার ছিল। অনেকের মুখে শোনা, রাত্রে যাঁরা কখনও কোনও কাজে রবীন্দ্রভবনের ওই এলাকায় গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই ওই ঘর থেকে খুব দ্রুত টাইপ করবার আওয়াজ শুনেছেন।
আমরা যখন ছাত্রাবস্থায় সেই ‘মাল্টিমিডিয়া’ প্রকল্পের ঘরটায় কাজ করতাম, তখন রবীন্দ্রভবন থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হয়নি। কজেই কর্মিদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস অথবা কোন আতঙ্ক বাসা বাঁধেনি। হাতে গোনা দু-চারজন নিরাপত্তারক্ষী গোটা উত্তরায়ণ পাহারা দিতেন। সন্ধেবেলা প্রায়দিনই আমাকে একলা কাজে বসিয়ে রেখে প্রকল্পের অন্যতম অধিকর্তা শান্তশঙ্কর দাশগুপ্ত অল্প সময়ের জন্য অদূরে হাতিপুকুরের পাশে আশ্রমমাঠের লাগোয়া অরবিন্দনিলয়ে প্রার্থনাসভায় যেতেন। তখন বেশিরভাগদিন ওই অট্টালিকার মূল দরজায় বাইরে থেকে তালা মেরে আমাকে একা রেখে রবীন্দ্রভবন কার্য্যালয়ের কর্মি রামবাহাদুর বোসেল আমাদের জন্য এক পঞ্জাবি আশ্রমিকের শুরু করা খাবারের দোকান ‘ভালোমন্দ’ থেকে আমাদের জন্য স্যান্ডুইচ আনতে যেতেন।
তখন বিশেষ করে সন্ধেবেলা শান্তিনিকেতনে ঘনঘন আলো চলে যেত। এরকম অনেকদিন হয়েছে, গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে শুনশান উত্তরায়ণের একটা জনমানবহীন ঘরে আমি একা বসে আছি। এতটাই নিস্তব্ধ, বাইরে গাছের পাতা খসার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। সন্ধের ওই সময়টা সাধারণত আমার একটু খিদে পেত। অন্ধকারে আলো আর চেনা মানুষ ফিরে আসার অপেক্ষা, তারই সঙ্গে একটা অনির্দিষ্ট আতঙ্ক আর খিদে মিলেমিশে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। আমি ভয় যে একেবারে পেতাম না তেমন নয়। রথীন্দ্রনাথের টাইপরাইটারের আওয়াজ যেন আমার কানে ভেসে না আসে তা নিশ্চিত করতে আমি এক্কেবারে উত্তরের কাঁচের জানলাটার কাছে গিয়ে যতদুর চোখ যায় ততদূর আমার মন ভাসিয়ে দিতাম। হাল্কা আলোয় দেখা যেত রথীন্দ্রনাথের গুহাঘর আর তার পাশে পম্পা সরোবর। তার জলে বড় বড় গাছের ছায়া।
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম, একটা আত্মার বলয় শান্তিনিকেতনে আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখে। সে আমাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবে। হয়ত মাঝে শুধু একটু কষ্ট হবে। টাইপরাইটারের আওয়াজ না শুনলেও আমি আশ্চর্য কিছু আওয়াজ শুনতে পেতাম। সেগুলো ঠিক কেমন আওয়াজ আমি হয়ত বোঝাতে পারবনা। ওই প্রকল্প একসময় শেষ হয়ে যায়। আমাদের কাজের মেয়াদও ফুরিয়ে আসে।
২
বহুবছর কেটে গেছে। নানা জায়গায় ঘোরার পর আমি কাজের সৃত্রে চাকরি নিয়ে ফিরে এসেছি সেই ছেলেবেলার রবীন্দ্রভবনে। কত পুরনো মুখ হারিয়ে গেছে কিন্তু রবীন্দ্রবনের ‘লিনোলিয়ম’-এর মেঝে আর পোকামাকড় দূর করতে ‘ন্যাপথলিন’ মেশানো গন্ধটা যেন একই রয়ে গেছে।
রবীন্দ্রভবনে ঢোকার মুখে যে পেল্লায় দরজাটা আগলে যে রামবাহাদুর বোসেল দাঁড়িয়ে থাকতেন, সেই বাহাদুরদা সেদিনও সেই পাকা সেগুন কাঠের পোক্ত দরজাটায় দাঁড়িয়ে।
এস্রাজ আর পিয়ানোর আওয়াজ আমার প্রিয়। রবীন্দ্রনাথকে ১৯৩০ এর দশকে মেরি ভ্যান এগহেন-এর উপহার দেওয়া একটা পিয়ানো অযত্নে উত্তরায়ণে পড়েছিল। সেটার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছূদিন রবীন্দ্রভবনের বিচিত্রায় আমার ঘরে পিয়ানোটা রেখে কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এসে সেটা মেরামতের ব্যবস্থা করেছিলাম। আমাকে তাঁরা বলেছিলেন, এটা মাঝেমাঝে না বাজালে আবার নষ্ট হবে। আমি পিয়ানো শিখিনি কিন্তু কয়েকটা গানের সুর নিজের নিয়মে অল্প বাজাতে পারি।আমি পিয়ানোটা মাঝে মাঝে খুব সাবধানতার সঙ্গে বাজাতাম। যারা সত্যি সত্যি পিয়ানো বাজাতে পারেন তাঁদের কাছে আমার পিয়ানো বাজানো যে একেবারে হাস্যকর আর অশিক্ষার ফল মনে হবে সে বিযয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার আঙুলের দিকে না তাকিয়ে, চোখ বুজে শুনলে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর হয়ত কিছুটা চেনা মনে হবে।
পিয়ানোটার মতোই আমি আমার ঘরে নিয়ে এসে রেখেছিলাম হেলায় ফেলে-রাখা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো পুরনো দিনে প্রিন্ট করা কবিপত্নী মৃণলিনীদেবীর বিরাট একটা পোর্টেট। তাঁর এই ফটোগ্রাফ খুবই পরিচিত। অনেক ছবি থাকে, যেখানে ছবি তোলার কায়দায় ছবির মানুষের দৃষ্টি আমাদের চোখের সঙ্গে সরে সরে যেতে থাকে। কিন্তু এই ছবিটা সেরকম নয়। এখানে কবিপত্নীর দৃষ্টি স্থির। তিনি কারও দিকে তাকিয়ে নেই।
শান্তিনিকেতনের রূপকারদের মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ আর রথীন্দ্রনাথ ছাড়া যাঁকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি তিনি মৃণালিণী।
একদিন বিকেলে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। কাজ শেষ। আমার মনের ভিতর একটা গান ঘুরে ঘুরে আসছে। বৃষ্টিতে আটকে রয়েছি। ঘরে ঢুকে পিয়ানোয় বাজাচ্ছি—“মোর হৃদয়ে লাগে দোলা, ফিরি আপনভোলা–/ মোর ভাবনা কোথায় হারা মেঘের মতন যায় চলে॥” হঠাৎ মনে হল, আমার আঙুলের ভিতর অন্য কেউ ঢুকেছে। আমার হাতটাকে অন্য কেউ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিয়ানোর আওয়াজটাও যেন অন্যদিনের থেকে অনেক ঝমঝমে আর জোরালো। কী একটা অস্বস্তি আমার ভিতরে কাজ করছিল। আমি চকিতে আমার ডানদিকে একটা দৃষ্টির উত্তাপ অনুভব করে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি ছবির মৃণালিনী আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। একটা শীতল স্রোত আমার শিরায় শিরায় খেলে গেল। শুনশান রবীন্দ্রভবনে আমার সহকর্মীদের বেশিরভাগই বৃষ্টির আশঙ্কায় বাড়ি ফিরে গেছেন। পিয়ানো বন্ধ করে বাইরে এলাম।দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির জল, গাছের ডালপালা আর খড়কুটো এলোমেলো উড়ে আসছে বারান্দায়।
শেয়ার করুন :