মুক্তাকাশের আলো -

ছবি- অনুপ রায়

মুক্তাকাশের আলো

এরকমই এক পয়লা বৈশাখের দিনে কনের সাজে….

অনিন্দিতা পাত্র

আজ অতসীর জীবনে বড় আনন্দের দিন। আজ অহনার বিয়ে ! অতসী আর দেবাশিসের একমাত্র মেয়ে অহনা। ছোট্ট মেয়েটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল ! আর মজার কথা হল তিরিশ বছর আগে এরকমই এক পয়লা বৈশাখের দিনে কনের সাজে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল অতসীও। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা। তিন বছরের মাথায় অহনা এল। সে কী আনন্দ সারা বাড়িতে! অতসীর নাওয়া খাওয়া সব মাথায় উঠল। দিনের বেলা মেয়ের মেলা কাজ নিয়ে অস্থির হয়ে থাকে মা, আর রাতের বেলা বাবার পালা। মেয়ে তো নয়, যেন রাতজাগা পাখি! সারা রাত জাগে, আর বিছানায় শুইয়ে দিলেই কান্না। তাকে নিয়ে সারারাত ঘর বার করে বেড়ায় দেবাশিস। “বউদি, ছেলের বাড়ি থেকে হলুদ এসে গেছে। এবার তো অনুকে স্নান করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।” কাকলির ডাকে চিন্তার রেশ কেটে যায় অতসীর। কাকলি অতসীর ননদ, ব্যাঙ্গালোরে থাকে। দিন পনের হল কলকাতায় এসেছে, বিয়ের ঝক্কি ঝামেলা সামলাতে। একমাত্র ভাইঝির বিয়ে বলে কথা। অতসীর সাথে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করেছে, হিসেব মিলিয়ে দেখে নিয়েছে কিছু বাদ গেল কিনা। ওর বর আর দুই ছেলেমেয়ে এল আজ সকালের ফ্লাইটে। তাদের অফিস, স্কুল চলছিল। অতসী বলল, “হ্যাঁ চলো। স্নানের সব ব্যবস্থা করেই রেখেছে মিতাদি। তুমি, তোমার দাদাকে একটু জিজ্ঞেস করো, অনুর ফুলের গয়নাগুলো কোথায় রেখেছে।”

দোতলায় অনুর ঘরে এসে ঢুকল অতসী। বড়দি অনুকে একটা লাল হলুদের ডুরে শাড়ি পরাচ্ছে। অতসীকে দেখেই বলল, “কিরে, ফুলের গয়না কই? আর তোদের ক্যামেরাম্যান কোথায়? ছবি টবি তুলবেনা?” অতসী অনুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “অনুর এসব পছন্দ নয়, তবুও ওর বাবাকে বলে ফুলের গয়না আনিয়েছি। আর বুবাই ওর ক্যামেরা নিয়ে এসেছে, ওতেই হয়ে যাবে।” বলতে বলতে অতসীর গলা দিয়ে অভিমান ঝরে পড়ল। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, কত আনন্দ করবে ভেবেছিল। কিন্তু অনু সবই নমঃ নমঃ করে সেরে দিতে চাইল। ওর এক কথা, “এত আড়ম্বর, এত লোক দেখানো জাঁকজমকের কোন প্রয়োজন নেই। পয়সা অপচয়ের কোন মানে হয় না। জানো আমাদের দেশের কত মানুষ দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না?” মেয়ের সাথে তর্কে যায়নি অতসী। কোথায় বেঁকে বসবে, বলবে অনুষ্ঠান করে বিয়েই করবো না! তাই অনুকে না জানিয়ে যতটা পারে নিজের মত করে আয়োজন করেছে। অতসীর কথা শুনে আঁতকে উঠল বড়দি, “অনুর পছন্দ নয় মানে? ওর পছন্দ নয় বলে তুই মা হয়ে সব মেনে নিলি? ও তো ছেলেমানুষ!” মুখ খুলল এবার অনু, “বড়মাসি, আমার আঠাশ বছর বয়স, আমি ছেলেমানুষ নই। এসব আমার ভালই লাগে না।” ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে, অনু এখন কলকাতারই একটা সরকারি হসপিটালে মেডিসিনের ডাক্তার। অল্প বয়স হলে কী হবে, কাজে বেশ সুনাম হয়েছে। অনুর কথা শুনে ঘরের সবাই চুপ। বড়মাসি ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়, বোনঝিকে ভালওবাসে খুব। বলল, “তা কি হয় রে মা? বিয়ে তো মেয়েদের জীবনে একবারই হয়! যেমন তেমন করে করলে পরে আফসোস হবে। তোর বাবারও তো বদনাম হবে।” অতসীর বুক দুরদুর্ করে, নিজের মেয়েকে সে চেনে! এমনিতে শান্ত। কিন্তু বাবার মত সোজাসাপ্টা, সমাজের নিয়মকানুনের ধার ধারে না। বলে, “যে নিয়মে সমাজের উপকার হয় না, সে নিয়ম কেন মানব?” এখন অনু কিছু বলে, তার আগেই ফুলের গয়না হাতে কাকলি এসে ঘরে ঢুকল। তাড়া দিয়ে বলল, “নাও, গয়নাগুলো পরাও, স্নানের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।” বুবাইও ততক্ষণে ক্যামেরা নিয়ে হাজির। অতসীর মেজদির ছেলে বুবাই, অনুর থেকে বছর দুয়েকের বড়। ঘরে ঢুকেই মজা করে অনুকে বলল, “তাহলে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করলি, কী বল!” সে কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল অনু। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অতসী! ঘর থেকে বেরিয়ে এল পায়ে পায়ে।

অহনা, নিলয়কে বলেছিল, “চল, ঝামেলা না করে, কোর্ট ম্যারেজ করে নিই। অনুষ্ঠান করতে গেলে মিনিমাম চারদিন ছুটি নিতেই হবে। আর দুজনের একসাথে ছুটি অ্যাডজাস্ট করাটাও মুশকিল।” নিলয়ের সাথে ইলেভেন থেকে অহনার প্রেম। একই স্কুলে পড়েছে দুজনে, তারপর মেডিকেল। নিলয় এখন কলকাতার একটা নামকরা নার্সিংহোমে সার্জেন। দু’বাড়ি থেকেই বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু পড়াশোনা, কাজকর্ম সামলে কিছুতেই সময় বের করতে পারছিল না দুজনেই। শেষমেশ প্রায় ধরেবেঁধেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়েছে। অহনার পিসি, পাঁজি দেখে পয়লা বৈশাখেই দিন ফেলেছে। বলেছিল, “নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই, নতুন জীবন শুরু করুক দুজনে।” নিলয়ের বাড়িতেও সবাই এক কথায় রাজি। এমনিতেই অহনাকে তাদের ভারী পছন্দ! আর সত্যিই তো, রূপে গুণে অহনার তুলনা পাওয়া মুশকিল। অহনা যেমন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, নিলয়ও তেমন। নিলয়ের বাবা মায়ের ইচ্ছে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবে। নিলয় অহনাকে বলেছিল, “দেখ, তুই কী চাইছিস বুঝতে পারছি, কিন্তু মায়ের দিকটাও ভাবতে হবে। বাবাকে ম্যানেজ করে নেব। কিন্তু মায়ের ওপর একটু প্রেসার আছে। মামারবাড়ির সাইডে সবাই বড় করে অনুষ্ঠান চাইছে।” অহনা বুঝতে পারেনি, এরপর নিলয়কে কী বলবে। আর তাছাড়া পিসিও বুঝিয়েছে, “তোর বাকি জীবন তো তোরই থাকল। বিয়ের ব্যাপারটায় না হয় বড়দের ওপর ছেড়ে দিলি!” ছোট থেকেই পিসির কথা শোনে অহনা। কঠিন কথাকে সহজ করে বলে দিতে পারে, তাই পিসিকে খুব ভরসা করে। আর সেই ভরসাতেই, বাবাকে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিয়েছিল অহনা। অবশ্য এখন এই লাল-হলুদ ডুরে শাড়ি, বাবা মায়ের উজ্জ্বল মুখ, ভাইবোনেদের আনন্দ, বাড়ি ভর্তি আত্মীয় সমাগম, লো-ভল্যুমে একটানা বেজে চলা সানাই…সব মিলিয়ে কেমন ঘোর ঘোর একটা ভাললাগায় ভেসে যাচ্ছে অহনা।   

বিয়ের সাজে রানীর মত দেখাচ্ছিল অহনাকে। লাল বেনারসি, কপালে চন্দনের ফোটা, পিসিচন্দ্রের হালকা সোনার গয়নায় অহনাকে দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। শুভদৃষ্টির সময় তো অহনার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না নিলয়। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিল! এই নিয়ে অহনার ভাই বোনেরা ছাদনাতলায় খুব হাসিমজা করল। ভালয় ভালয় মিটে গেছে বিয়ের পর্ব। আজ সকাল সকাল রওনা দিয়ে নিলয়দের বাড়ি এসে পৌঁছেছে অহনারা। আসার সময় মায়ের কান্নাকাটি কিছুতেই থামছিল না। বাবাও যে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে, বেশ বুঝতে পারছিল অহনা। সবার চোখেই জল, কিন্তু অহনা কিছুতেই সবার সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে পারে না। তবে প্রণাম করার সময় তারও চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিল। পিসি শুধু শান্ত ছিল। সকালে অহনাকে যখন সাজানো হচ্ছিল, কানে কানে বলেছিল, “ওখানে গিয়ে ওরা যা বলবে, চুপচাপ শুনিস। কাউকে মুখের ওপর কিছু বলিস না। আর নিলয় তো সাথেই রইল, কোন অসুবিধা হবে না।” না, তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। শুধু নিলয়ের বড় মামিমা যেন একটু বেশিই নিয়মকানুন পালন করালেন অহনাকে দিয়ে। তবে তাও এমন কিছু কঠিন নয়। নিলয় পরে বলল, ওর বড় মামিমা নাকি একটু সেকেলে। বারব্রত, ছোঁয়াছুঁয়ি মানেন খুব। নিলয়ের বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের সাথেও পরিচয় হল। নিলয়ের বাবা মা ঠাকুমা তো অহনাকে আগেই চিনত। কয়েকবার বন্ধুদের সাথে এ বাড়িতে সে এসেছে। সব নিয়মকানুন মিটে যেতে স্নান সেরে অহনা একটা লাল ঢাকাই শাড়ি পরে নিজের ঘরে বসেছিল। খুব খিদে পেয়েছে, সেই কোন সকালে অল্প একটু লুচি তরকারি খেয়ে বেরিয়েছিল! নিলয়ের মাসতুতো বোন দোয়েল এলো, “বউদি নীচে চলো, ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠান হবে।” কথাটা শুনে দুম করে একটা পুরনো কথা মনে পড়ে গেল অহনার! দোয়েলকে বলল, “যাচ্ছি, তার আগে তুমি তোমার নিলয় দাদাকে একবার ডেকে আনবে?” নিলয় আসতে অহনা জিজ্ঞেস করল, “ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান কী? যেখানে তুই আমার হাতে ভাতের থালা আর শাড়ি দিয়ে বলবি, ‘তোমার সারা জীবনের ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আমি নিলাম?” এ কথা শুনে নিলয় হাঁ করে তাকিয়ে থাকল, বোঝাই যাচ্ছে এমন কথা সে আগে শোনেনি। একটু চিন্তা করে বলল, “সম্ভবত। কেন?” অহনা বলল, “সম্ভবত না। এটাই সেটা! পল্লবী আমাকে ওর বিয়ের পর বলেছিল, এক বাড়ি নতুন লোকজনের সামনে কী এম্ব্যারাসিং সিচুয়েশনে পড়েছিল।” নিলয় চুপ করে থাকল। অহনা আবার বলল, “কিন্তু আমার পক্ষে এই অনুষ্ঠানটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। স্যরি!” নিলয় মৃদু গলায় প্রায় আকুতির স্বরে বলল, “ব্যাপারটাকে জাস্ট একটা রিচ্যুয়াল হিসাবে দেখ না।” অহনা চাপা গলায় বলল, “একটা ভুল রিচ্যুয়ালকে টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ কী? দুজনেই যখন সারা জীবন একে অপরের অনেক দায়িত্ব নেব, তখন সবার সামনে এমন ঘটা করে তুই বা এসব বলবি কেন?” ওদের কথপোকথনের খবর ইতিমধ্যে পৌঁছে গেল একতলায়। নিলয়ের মা চলে এসেছে। নিলয় মাকে বলল, “সকাল থেকে অনেক নিয়মকানুন হয়েছে, এবার সব বাদ দাও। অহেতুক আর কিছু করার দরকার নেই।” বড় মামিমা কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল ! বলল, “অহেতুক কী বলছিস? হিন্দু ঘরে এসব নিয়ম মেনে বিয়ে হয়ে আসছে সেই কোন যুগ থেকে! তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেসব না মানতে চাইলে চলবে কেন?” অহনা বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসেছিল। অনেকেই এখন ঘরের মধ্যে এসে জড়ো হয়েছে। সবার চোখে কৌতুহল। নিলয়ের মা নিচু গলায় অহনাকে বলল, “একটা দিনের ব্যাপার। সবাই দেখছে। তাছাড়া বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। চলো।” অহনা ধীরে ধীরে বলল, “সময়টা কথা নয়। এটা একটা ভুল প্রথা। কেন সেটাকে এত যত্ন করে বয়ে বেড়াতে হবে?” এবার বড় মামিমা গলা তুলল, “কেন? এ প্রথায় ভুল কোথায়?” অহনা সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। নিলয়ের নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বড় মামিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বউমা কী, অনেক টাকা ইনকাম কর ব’লে স্বামীর মুখ থেকে ও কথা শুনতে সম্মানে বাঁধছে?” মামিমার খোঁচাটা কারোর বুঝতে অসুবিধা হল না। নিলয়ের মা বলল, “থাক না বৌদি ওসব কথা।” অহনা এবার স্পষ্ট করে বলল, “যে বউমা ইনকাম করে না, সংসারে তারও অনেক কন্ট্রিবিউশন থাকে, তাকেও অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। তাই কারো পক্ষেই এমন কথা মেনে নেওয়া অসম্মানের।” মামিমা কিছু বলতে যাবে, তখনই দরজার বাইরে একটা ক্ষীণ গলা শোনা গেল, “নাতবৌমা যা বলছে ঠিকই বলছে।” সবাই দেখল, দোয়েলের হাত ধরে, ঠাকুমা কখন দোতলায় উঠে এসেছেন। নিলয় ঠাকুমাকে ঘরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। “একটা নতুন সংসারে এসে, বউ ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করলে, তবেই সেই সংসার সুখের হয়। প্রতিটা সংসারে ভাত কাপড়ের সাথে সাথে সুখেরও খুব প্রয়োজন। তাই সংসারকে ঠিকঠাক চালাতে স্বামী আর স্ত্রী দুজনকেই যখন দায়িত্ব নিতে হয়, তার কৃতিত্ব একজন কেন নেবে? তাই আজ থেকে এ বাড়িতে ও নিয়ম উঠে গেল! এবার সবাই যে যার কাজে যাও।” এই বলে থামলেন ঠাকুমা। অহনার মনে পড়ে গেল, তাই তো! নিলয় বলেছিল, ঠাকুমা স্কুলে বাংলার টিচার ছিলেন! তাই এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলে ফেললেন কথাগুলো। যাইহোক, ঠাকুমা আপাতত সবার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। নিলয় ঠাকুমাকে নিজের ঘরে পৌঁছে দিতে গেছে। ফিরে এলেই খেতে বসতে হবে। অহনার পেটে যে ছুঁচোয় ডন মারছে!

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *