অনিরুদ্ধ সরকার
মোঘল সম্রাট শাহজাহান প্রেমিক তো ছিলেনই, ছিলেন বেশ শৌখিনও। মোঘল সম্রাটদের মধ্যে তাঁকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় কারণ, তাঁর আমলেই গড়ে উঠেছিল ‘তাজ’। আর তাজ বাদ দিলে আরও একটি বিষয়ের জন্য তিনি বিশ্ব প্রসিদ্ধ। যা হল ময়ূর সিংহাসন। আসলে শাহজাহান মনে করতেন ধনরাশি ও রত্নাদি রাজকোষাগারে জমা রেখে কী লাভ। ধন সম্পদকে জনসম্মুখে জাহির করতে হবে, মোঘল জৌলুস দেখাতে হবে সারা বিশ্বকে। আর তা থেকেই ময়ূর সিংহাসন তৈরির সিদ্ধান্ত নেন শিল্প ও সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সম্রাট শাহজাহান। ময়ূর সিংহাসন তৈরি করতে ঠিক কত সময় লেগেছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন ৭ বছর, কেউ বলেন ৮ বছর। আর খরচ! শুনলে অবাক লাগতে পারে, ময়ূর সিংহাসন তৈরির খরচ ছিল তাজমহল তৈরির খরচের দ্বিগুণ। ময়ূর সিংহাসনের বর্ণনা অনেকেই দিয়েছেন, যার মধ্যে ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরি, এনায়েত খান, ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার এবং ফরাসি জহুরী তাভেরনিয়ারের লেখা উপাদান বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ। পারস্যের পঞ্জিকানুযায়ী ১০৪৪ সালে নওরোজ বা পারস্য বসন্ত উৎসবের দিন শাহজাহান ময়ূর সিংহাসনে বসেন। সেই দিনটি ছিল আরও একটি কারণে ছিল গুরুত্বপূর্ণ,সেদিন ছিল ‘ঈদ-উল-ফিতর’ । সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের সপ্তম বর্ষপূর্তির দিন শাহজাহান এই সিংহাসনটির উদ্বোধন করেন। সিংহাসনটিকে আগে তাখত-মুরাসা বা রত্নসজ্জিত সিংহাসন বলে ডাকা হতো। পরবর্তী সময়ে এর ওপরে ময়ূর থাকার জন্য এর নাম হয় ময়ূর সিংহাসন বা তাখত-এ-তাউস। সে সময়ের প্রায় এক কোটি, কেউ কেউ বলেন চার কোটি টাকার মণিমাণিক্য সিংহাসনটিকে সাজাতে ব্যবহৃত হয়েছিল। সিংহাসনটির মুখ্য স্বর্ণকারিগর ছিলেন সাইদ গিলানি। সম্রাট তাঁর কাজে খুশি হয়ে গিলানিকে ‘বিবাদাল খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘বিবাদাল খান’ যার অর্থ, ‘অতুলনীয় পন্ডিত’। শুধু তাই নয় সম্রাট গিলানিকে নিজ ওজনের সমান স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে সম্মানিত করেন।
এবার একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে পারস্যের সম্রাট আব্বাস তৎকালীন এক লক্ষ টাকা মূল্যের একটি হিরা বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে উপহার দেন। সম্রাট শাহজাহান পিতার সেই হীরেটিও সিংহাসনে বসিয়ে দেন। ইউরোপীয় পর্যটক টাভার্নিয়ার লিখছেন, শিল্পমণ্ডিত বহুমূল্য রত্নখচিত সিংহাসনটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল পাঁচ কোটি টাকার হীরা-মুক্তা-পান্না, প্রায় ৯০ লক্ষ টাকার জহরত, ২০ লক্ষ টাকা মূল্যের ১ লাখ তোলা ওজনের সোনা। টাভার্নিয়ারের বর্ণনা থেকে জানা যায় সিংহাসনের চতুর্ভুজাকার গম্বুজের ওপর একটিমাত্র বৃহৎ ময়ূর ছিল যার লেজটি ছিলো ছড়ানো এবং নীলকান্তমণি ও অন্যান্য রঙিন রত্ন বসানো। ময়ূরের শরীর ছিল সোনা দিয়ে তৈরি এবং তাতে মূল্যবান রত্ন খচিত ছিল।ময়ূরটির বুকে বসানো ছিল বৃহদাকৃতির একটি রুবি বা চুনি। এই চুনিটি থেকে একটি প্রায় ৫০ ক্যারেটের নাশপাতি আকৃতির বৃহৎ মুক্তো ঝুলতো। ময়ূরটির উভয়পার্শ্বে একটি করে স্বর্ণনির্মিত ফুলের তোড়া ছিল যাতে সোনা ও মূল্যবান রত্নপাথর সহযোগে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল নানা ফুল। তোড়া দুটি লম্বায় ময়ূরটির সমান ছিল।অন্যদিকে লাহোরির বর্ণনামতে সিংহাসনে আরোহনের সিঁড়ি ছিল তিনটি, আর সেই সিঁড়িগুলিও ছিল রত্নমণ্ডিত।আলো পড়লে চারিদিকে রত্নের রামধনুতে চারিদিক ছেয়ে যেত। যাকে কেউ কেউ অলৌকিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর একে একে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হন প্রথম বাহাদুর শাহ্, জাহানদার শাহ্, ফারুখশিয়র, রাফি-উদ-দারাজাত, দ্বিতীয় শাহ্জাহান। এদের পর শাসক হিসেবে মোঘল সিংহাসনে বসেন বাদশাহ মহাম্মাদ শাহ্। এই মহাম্মাদ শাহের কাছ থেকেই ময়ূর সিংহাসন লুঠ করে নিয়ে যান পারস্য সম্রাট নাদির শাহ। কারনালের যুদ্ধে মহাম্মাদ শাহকে পরাজিত করেন নাদির শাহ এবং সেবছর মে মাসে দেশে ফিরে যাবার পথে জয়ের নিদর্শনস্বরূপ অজস্র ধনরত্ন ও অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে ময়ূর সিংহাসনটিকেও সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। কেউ কেউ বলেন অনেকের মতে নাদির শাহ দিল্লিতে অবস্থানের সময় ময়ূর সিংহাসনের মতো আরেকটি সিংহাসন বানিয়েছিলেন। তবে যাওয়ার সময় তিনি দুটি সিংহাসনই নিয়ে যান নিজ দেশ পারস্যে। ময়ূর সিংহাসন ছাড়াও বিখ্যাত কোহিনূর হীরাও সঙ্গে নিয়ে চলে যায় নাদির শাহ। শোনা যায়, এই ময়ূর সিংহাসন আর কোহিনূর হীরার জন্য খুন হন নাদির শাহ। অনেক রাজার রাজত্বে হাত বদল হয়ে ময়ূর সিংহাসন শেষে কালের গর্ভে ধ্বংস হয়ে যায়। বিশ্বখ্যাত কোহিনূর হীরা ময়ূর সিংহাসনে বসানো ছিল বলেই জানা যায়। কিছু ঐতিহাসিক জানাচ্ছেন, ইংরেজ আমলে মাঝে মাঝে গুজব উঠতো ময়ূর সিংহাসনের সন্ধান মিলেছে।কাগজে খবর হত। তো লর্ড কার্জনের সময় একবার প্রবল গুঞ্জনের সৃষ্টি হল, ইরানশাহের খাজাঞ্চি খানায় ময়ূর সিংহাসন অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। ইংরেজ শাসকদের তখন ব্যবসা সারা পৃথিবী জুড়ে। খোঁজ শুরু করল ব্রিটিশরা কিন্তু শেষ অবধি খুঁজে পাওয়া গেলনা ময়ূর সিংহাসন। শেষে লর্ড কার্জন জানালেন, “না, ময়ুর সিংহাসন নেই। নাদির শাহ খুন হওয়ার পর, ময়ূর সিংহাসনকে টুকরা টুকরো করে ছড়িয়ে ফেলা হয়।” ময়ূর সিংহাসন আছে কি নেই সেটা যতটা না গুরুত্বপুর্ন, তার থেকেও বড় কথা এত বছর পরেও ময়ূর সিংহাসনের স্মৃতি এখনো জাগরুক। কবিতা, মহাকাব্য, গল্প, উপকথা ও গানে আজও টিকে রয়েছে ময়ূর সিংহাসন। শাহজাহানের স্বপ্নের ময়ূর সিংহাসন আজ মিথ।
ঋণঃ
ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস- মধ্যযুগ, মোগল পর্ব – এ কে এম শাহনাওয়াজ
ময়ূর সিংহাসন- শাহিন আখতার
The peacock throne- waldemar hansen
Emperors of the Peacock throne- Abraham Eraly
শেয়ার করুন :