কলকাতার ব্যস্ত ট্র্যাফিক থেকে শুরু করে সুদূর পাহাড়ের নির্জন রাস্তা, আজকাল অনেক মেয়েই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন একা। ‘একা মেয়ের বেড়ানো’ শব্দটি এখনও সমাজে সমাদৃত নয়,বরং বাড়ির বিধিনিষেধ কাটানোই একটা চ্যালেঞ্জ এর ওপর সংবাদ ও সমাজমাধ্যমে নিয়মিত মেয়েদের ওপর ঘটে চলা অন্যায় অত্যাচার সুরক্ষিত থাকার সংকটের মধ্যেও এইসবের মধ্যেও এখন অনেক মেয়ে দুর্নিবার সাহস আর উদ্যমে এক বেড়াতে যাচ্ছেন সেটা সাবধানী রক্ষণশীলদের কাছে আশ্চর্যের আর আতঙ্কের হলেও এই মেয়েদের কাছে বিস্ময়ের কারণ নয়, বরং সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। অনেকেই ভাবেন, একা পথ চলা মানেই বুঝি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, কিন্তু একটি একা মেয়ে,একটি সাহসী আত্মপ্রত্যয়ী মেয়ে এই বিপদসংকূল পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে জানেন এই ঝুঁকিপূর্ণ পথচলা হলো বিপদ আর ভয়,অনিশ্চিয়তাকে জয় করে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের এক সুযোগ। নিজের ইচ্ছেমতো গন্তব্য বাছা, অচেনা সংস্কৃতিকে কাছ থেকে জানা আর নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনে নেওয়ার সেই অ্যাডভেঞ্চার। এই সংখ্যায়, আমরা কথা বলব সেই সব স্বাধীনচেতা মেয়েদের সঙ্গে, যারা ভয়কে জয় করে বেরিয়ে পড়েছেন মুক্তির খোঁজে। পড়ুন, কীভাবে একা বেড়ানো শুধু ভ্রমণ নয়, হয়ে উঠছে জীবনযাপনের এক নতুন দর্শন।

চেরিল মুখার্জি – অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি স্নাতক
ভ্রমণ মূলত ব্যক্তিগত এক অভিজ্ঞতা,এটা কোনও সামাজিক বাঁধা বা নিয়মে আটকে থাকা উচিত নয়।
আমি প্রথমবার একা ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম উনিশ বছর বয়সে। যে জায়গায় যেতে চাই, সে বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজখবর না নেওয়া পর্যন্ত আমি বাবা-মাকে কিছুই বলিনি। কিন্তু বাঙালি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ ছিল সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প আর আমার পরিচিত বাস্তবতার বাইরে এক অন্যরকম নস্ট্যালজিয়ার জায়গা। আমি কখনও কলকাতায় বড় হইনি, তবু একেবারে ‘স্টেরিওটাইপিক্যাল’ বাঙালি সন্তানের মতোই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখে, ছড়া-গানের সঙ্গে গুনগুন করেই বড় হয়েছি।ডাক্তারি পরিবার থেকে এসেছি, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তই মাপা হয় যুক্তি-তর্ক, লাভ-ক্ষতির খাতায়। তাই বাড়িতে প্রতিদিনই ছোট ছোট আলোচনা চলত, ধীরে ধীরে মানসিক প্রস্তুতি করে নেওয়ার জন্য, যাতে বিষয়টা কেউই ধাক্কা হিসেবে না নেয়। আমি ছেলে হলেও একইরকম করতাম।
এর আগে আমি শুধুই বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরেছি আর সেগুলো ছিল ছোট্ট ছোট্ট ট্রিপ, সমস্ত আরাম-আয়েশ হাতের মুঠোয়। আমার একা ভ্রমণ তার সম্পূর্ণ বিপরীত অভিজ্ঞতা। দু’মাস পর্যন্ত লম্বা চলতে পারে, প্রয়োজনমতো সরঞ্জাম, স্বাস্থ্যকর আর সস্তা খাবার, কোনও কড়াকড়ি সফরসূচি নয়; খরচ বাঁচাতে বেশি হাঁটি বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করি, নিজের কাপড় নিজেই ধোওয়ার জন্য সাবান নিয়ে চলি। আর সবচেয়ে বড় কথা কারও সঙ্গে পরিকল্পনা মিলছে কি না, সেটা ভাবতে হয় না। পরিবার-নির্ভর ভ্রমণ থেকে একা ভ্রমণে যাওয়ার পর আমার জন্য সবকিছুই বদলে গিয়েছিল।
আপনি কি পুরুষ ভ্রমণকারীদের মতো সমান সুযোগ পেয়েছেন?
অনেক সময় মনে হয়েছে যেশুধু আমি একা নারী ভ্রমণকারী বলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। অনেক জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস নারী অংশগ্রহণকারীদের জন্য বেশি খরচসাপেক্ষ, কারণ “ওদের বেশি সাহায্য” বা “বেশি নজরদারি” লাগে। অনেক ধর্মীয় স্থানে নারী হিসেবে আমার প্রবেশাধিকার ছিল না। ট্রাভেল এজেন্টরা নারীদের একা ভ্রমণের ঝুঁকি লিখিতভাবে নিতে চায় না। একা নারী ভ্রমণকারীদের জন্য সময়সীমা, হোস্টেলে রিপোর্ট করার নিয়ম,সবকিছুই বেশি কঠোর; নানারকম অনুমতি ও কাগজপত্রের ঝামেলা তো আছেই। এ তো কেবল কয়েকটি উদাহরণ। পুরুষদের এসব নিয়ে ভাবতে হয় না। কিন্তু বৃহত্তর সমস্যাটি হলো,নারী একা ভ্রমণের প্রতি সামাজিক ট্যাবু, যেসব বিষয় নিয়ে পুরুষদের টিকিট কাটার আগেই ভাবতে হয় না।
আমি উপদেশ দিতে পারদর্শী নই, কিন্তু একজন নারী হিসেবে বলতে পারি একা ভ্রমণ একজনকে যেমন সচেতন করে তোলে, তেমনই শক্তিশালীও করে। নিজের দুর্বলতা আর শক্তির দিকগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে জানা যায়। কেউ ভালোবাসার অপেক্ষায় না থেকে নিজেকে ভালোবাসতে শেখা যায়। আর এখানেই পুরো পার্থক্যটা তৈরি হয়।

ঝুমকা বন্দোপাধ্যায় ,পঞ্চাশোর্ধ।২০১৫ থেকে একা বেড়ান
ঝুমকা বন্দোপাধ্যায়ের বেড়াতে ভালো লাগে,কিশোর বয়েসে বাবার সঙ্গে কিছু জায়গায় বেড়িয়েছিলেন কিন্তু তার পর বেশ দীর্ঘদিন আর বেড়াতে যেতে পারেন নি,এখন যখন ওনার নিজের কোথায় সামাজিক পারিবারিক দায়িত্ব অনেক কমে যাওয়ার ফলে বেড়ানোর তাগিদ আবার অনুভব করেন।প্রথমে ভেবেছিলেন কোনো ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে বেড়াবেন কিন্তু বেশ কিছুবার সেই প্রয়াস কার্যকরী হয়নি আর মধ্যবিত্ত ঝুমকার কাছে ভালো ট্র্যাভেল এজেন্সির খরচও বেশ বেশি লাগে উনি ঠিক করেন যে একা বেড়াতে যাবেন।প্রথমবারের একা উত্তরাখন্ড বেড়াতে যাওয়ার আগে মনে একরাশ দ্বন্দ্ব,উদ্বেগ আশংকা ছিল কিন্তু বেড়িয়ে আসার পর ওপর আনন্দ ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন ,তার পর আর পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি।
উনি জানিয়েছেন, ‘এখন আমি নিজেই আমার ট্যুর প্ল্যান ঠিক করি, বাজেট, সময়, সফরের মেয়াদ,সবকিছুই আমার পছন্দ ও সুবিধামতো। হিমালয়ের অন্তর্লীন অঞ্চলে ঘুরতে আমার অত্যন্ত ভালো লাগে, যেসব স্থানে অধিকাংশ মানুষ খুব একটা যাতায়াত করে না।
আমি যেহেতু বেশ পরিণত বয়সে ভ্রমণ শুরু করেছি এবং বহুদিন ধরেই আমার বাকেট লিস্টে অসংখ্য জায়গার নাম ছিল, তাই গন্তব্য নির্ধারণ করতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না।
আমার পক্ষে ঘন ঘন ছোট ছোট ট্রিপ করা কঠিন। তাই আমি সাধারণত একবারে কয়েকটি জায়গা মিলিয়েই ঘুরি। যেমন, যখন কল্পেশ্বর ও তুঙ্গনাথ গিয়েছিলাম, তখনই ভ্রমণসূচিতে দেউরিয়া তাল ও কার্তিক স্বামী মন্দিরও যুক্ত করেছিলাম।একাই ভ্রমণ করলে যাতায়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে মনে রাখতে হবে যেসব স্থানে স্থানীয় মানুষের নিজস্ব গাড়ি নেই, সেখানেও তাঁদের জন্য সবসময়ই কোনও না কোনও ধরনের গণপরিবহন চলাচল করে।
ভ্রমণের পথে হয়তো ‘খুব বিদগ্ধ, রুচিশীল’ সহযাত্রী নাও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু আন্তরিক ও সাহায্য করতে ইচ্ছুক কয়েকজন মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে।আমার প্রথম দুই-তিনটি ভ্রমণে কলকাতা থেকেই সরকারি ট্যুরিস্ট লজে থাকার জায়গা বুক করতাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, এটি বেশ ঝামেলাপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, এই লজগুলি স্থানীয় বাস বা জিপস্ট্যান্ড থেকে বেশ দূরে থাকে।এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে না পারলে অগ্রিম টাকার ক্ষতির চাপও থাকে। তাই এখন আমি স্পট বুকিংই করি। বাস বা জিপস্ট্যান্ডের কাছাকাছি থাকা আমার বেশি পছন্দ।
অল্প-অল্প দরকষাকষি করতেও শিখেছি, কারণ আমি বেশিরভাগ সময়ই পর্যটন মরসুম শুরুর আগের বা পরের সময়ে ভ্রমণ করি। মরসুমে চাহিদা বেশি থাকায় ছাড় পাওয়া সত্যিই কঠিন।
অনেকের কাছেই শুনেছি, ভ্রমণে গেলে খাবার নিয়ে তাঁদের নানা রকম সমস্যা হয়। কিন্তু আমার বিশেষ কোনও খাবারের বাছবিচার নেই,শুধু ঠিকমতো রান্না করা ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিবেশন হলেই আমি নিশ্চিন্তে খেতে পারি।নিরামিষ যেমন খাই, তেমনই আমিষও। স্থানীয় রান্না চেখে দেখতেও আমার খুব ভালো লাগে। ব্যাকআপ খাবার হিসেবে আমি সবসময় কয়েক প্যাকেট বাদাম-চিক্কি রাখি। বাদাম খুব পুষ্টিকর এবং গুড় শরীরে তৎক্ষণাৎ শক্তি জোগায়।
যতদিন শরীর সায় দেবে, ততদিন আমি ভ্রমণ চালিয়ে যেতে চাই,তবে সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও করতে হবে। এখন আমি সাধারণত ১০–১২ দিনের ভ্রমণসূচি তৈরি করি, যাতে একবারে কয়েকটি জায়গা দেখা যায়। বয়স আরও বাড়লে এবং আগের মতো চলাফেরা করতে না পারলে, তখন এক জায়গায় গিয়ে সেখানকার প্রকৃতি উপভোগ করেই সময় কাটাব।‘

স্বাতী জৈন
ভারতের ২০টি রাজ্য, ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং প্রায় ১৩০টি শহর একা ব্যাকপ্যাক করে ঘুরে বেড়ানোর পর স্বাতী জৈনের ভ্রমণযাত্রা বারবার ভেঙে দিয়েছে এই ধারণা যে ভারত নারীদের জন্য অনিরাপদ। দুর্গম কোনও দূরবর্তী গ্রাম হোক বা নারীদের জন্য ‘অসুরক্ষিত’ বলে চিহ্নিত কোনও শহরসব জায়গায় স্বাতী নিজের সাহস, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তায় ভেঙে ফেলেছেন সব ধরনের পূর্বধারণা।
স্বাতীর বিশ্বাস, ছত্তিশগড়ের অন্তর্গত বাস্তার অঞ্চলে ৯৬ ঘণ্টা কাটিয়ে প্রায় ১,৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পরই তিনি প্রথমবার প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলেন। সেখানে কেউ তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি, স্পর্শ পর্যন্ত করেনি, এমনকি অস্বাভাবিকভাবে তাকিয়েও দেখেনি।হাটবাজারে মহুয়া বিক্রি করা সেই ‘বিন্দাস’ মহিলাকে, দক্ষিণে দন্তেশ্বরী মন্দিরের সিঁড়িতে ফুল বেচা বৃদ্ধাকে, আর এক আদিবাসী শিকারিকে কাছ থেকে দেখে তিনি অনুভব করেছিলেন শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি যে ভাবে তাঁদের বিচার করে, তাতে কোনও এক জায়গায় ভয়াবহ ভুল থেকে যাচ্ছে।
ভ্রমণের জন্য সঞ্চয় ভেঙে ফেলা কখনই তাঁর কাছে বিকল্প ছিল না—এ ব্যাপারে স্বাতী শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিলেন। তাই চলতে চলতেই উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে তিনি পিআর কনসালট্যান্ট হিসেবে ফ্রিল্যান্স কাজ শুরু করেন, কিন্তু দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের কারণে কাজ সামলানো কঠিন হয়ে উঠেছিল।
এরপর তিনি নিজের অভিযানের অর্থ জোগাড়ের জন্য অন্য পথ বেছে নেন—খোলেন নিজের ব্লগ buoyantfeet.com, শুরু করেন ব্র্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা, আর ফ্রিল্যান্স ট্রাভেল রাইটার হিসেবেও কাজ করতে থাকেন!
তবে প্রথম পদক্ষেপটাই সাধারণত সবচেয়ে দুঃসাহসিক হয়, আর সেটিই দাবি করে সর্বোচ্চ সাহস। স্বাভাবিকভাবেই স্বাতীকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল বহু চ্যালেঞ্জ আর তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল স্বয়ং তিনি নিজেই। নিজের মনকে যখন তিনি পথচলার অনুমতি দিতে রাজি করাতে পেরেছিলেন, তখনই যথেষ্ট প্রেরণা পেয়েছিলেন পরিবারের মতো ঐতিহ্যনিষ্ঠ মানুষদেরও বোঝাতে।
তবে এতেই পথ সহজ হয়ে যায়নি। তাঁর সামনে সবচেয়ে ঘনঘন যে চ্যালেঞ্জটি এসেছে, তা হলো পরিবারের উদ্বেগ সামলানো এবং সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে লড়াই করা। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস, কেউ যদি সত্যিই মন-প্রাণ দিয়ে কোনও স্বপ্নের পিছনে ছুটতে চায়, তবে পরিস্থিতি নিজে থেকেই অনুকূল হয়ে ওঠে যেমন আজ তাঁর পরিবারই সমর্থন করছে তাঁর নিয়মিত, কঠোর ভ্রমণ-জীবনকে।
তিনজন নারী,যাঁরা সব ঝুঁকি নিয়েছেন, ভেঙেছেন একা ভ্রমণ নিয়ে সমাজের সব বিধিনিষেধ প্রচলিত সাবধানবাণী। নিজেদের স্বপ্নকে শুধু পূরণই করেননি, বরং সেই পথচলা তাঁদের জীবনকে করেছে আরও সমৃদ্ধ, আরও গভীর। তাঁদের সাহস, দৃঢ়তা ও মুক্তির অন্বেষা নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা জোগাবে সেই সব নারীকে, যাঁরা এক বেড়াতে যাওয়ার প্রথম পা নেওয়ার ইচ্ছেতে উন্মুখ হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্র -হোমগ্রোন ডট কো ডট ইন,ট্র্যাভেলস্কেপ ডট ইন,ট্র্যাভেলট্রায়াঙ্গেল ডট কম।
শেয়ার করুন :





