গত ২৪শে নভেম্বর গিরিশ মঞ্চে নাট্যশালা নাট্যগোষ্ঠীর নতুন সাড়া জাগানো নাটক ‘জোড়া -সাঁকো ‘ মঞ্চস্থ হলো রানা বসুর নির্দেশনায় এই নাটক ইতিহাসের পাতা থেকে এক নারীর দৃপ্ত সুদৃঢ় অবস্থানের কথা বলে।বাংলাদেশের ইতিহাসে উপেক্ষিতা অন্যতম দীপ্তিময়ী নারী দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী।
যে সময় নারীকে মনুবাদের মতে শূদ্র বা পুরুষের মালিকানাধীন ভাবা হত, স্বামীর কোনও আদেশ অমান্য করা তো দূরের কথা, মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার অধিকারও ছিলনা, সেই সময় এক নারী তার অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, অর্থবান স্বামীর মুখে মুখে বিতর্ক শুধু নয়, সরাসরি বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারে এ যেন কল্পজগতের কথা। কিন্তু বাস্তবিক সত্যি ঘটনা। দিগম্বরী। রবি ঠাকুরের ঠাকুমা।
জোড়া-সাঁকো নাটকের অন্যতম মুন্সিয়ানা বাঙালি মনীষীদের ব্যাক্তিপুজো নয় বরং রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তাঁদের দোষ গুণ নির্মোহ দৃষ্টিতে উপস্থাপনা করা যার প্রধান কেন্দ্রে এক অন্তপুরবাসিনী নারী। অরূপশঙ্কর মৈত্রের নাট্যরূপ ,সংলাপ , গৌতম ঘোষের সঙ্গীত, মঞ্চ, প্রক্ষেপণ এই নাটককে সমৃদ্ধ করেছে।এমন বেশ কিছু মুহূর্ত আছে যেখানে সেই সময়ের নিরিখে দাঁড়িয়ে (যদিও এই নাটক বর্তমানের কথা ভেবে প্রয়োজনে ইতিহাসের স্থান কাল সময়ের কিছুটা বিনির্মাণ করেছেন ) যখন ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা,সতীদাহ,নীলচাষ, এমনকি দাস প্রথা নিয়ে সংলাপে দুপক্ষের শানিত যুক্তিজালে (দ্বারকানাথের সঙ্গে দিগম্বরী,আত্মীয় সভায় রাজা রামমোহন ) দর্শকদের মন ভরে যায়।
দিগম্বরীর বিরোধিতার মূল প্রেরণা ছিল তার স্বাধীনতাবোধ। দ্বারকানাথ একদিকে দিগম্বরী অন্যদিকে আধুনিক ভাবনার নয়া রূপকার রামমোহনের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। এরমধ্যে বিদেশী সাহেব অ্যাডাম, মেম লেডি বেন্টিংক আছেন। দিগম্বরীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দ্বারকানাথের মা বিধবা অলকানন্দা। এছাড়াও দ্বারকানাথের এক পাগলি নেড়া পিসি যিনি অনেক আগেই মারা গেছেন তিনি মাঝে মাঝে কল্পনায় মঞ্চে চলে আসে।
ঠাকুরবাড়িতে নানা কাজের লোক, নায়েব গোমস্তা, পিসি মাসি আছে। রামমোহনের মজলিসে আডাম, লেডি ছাড়াও আরো সাহেব, মেম, বাবু আছে। আছে নিকি বাঈজী। আছে সেই সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী জুলিয়েট। আছে ফ্রান্সের সাংবাদিক সোফিয়া।
শেষে যখন দিগম্বরী জেনে ফেলে যে দ্বারকানাথ এক বিদেশিনীর সঙ্গে প্রেমে উন্মত্ত, তখন তিনি বিবাহবিচ্ছেদের দাবি করেন। যেহেতু সেই যুগে বিবাহবিচ্ছেদের ব্যবস্থা ছিল না, তাই শাশুড়ি অলকার সমর্থনে দ্বারকানাথকে গৃহত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরীর চরিত্রে দেবযানী সিনহা অসামান্য অভিনয় করেছেন।কঠোরভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ,ইংরেজ শাসনের পাশ্চাত্য আধুনিক ভাবনা,দ্বারকানাথ রামমোহন এবং প্রথমদিকে নিজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাশুড়ির বিরুদ্ধে তার সপ্রতিভ,সতেজতা নাটককে ঋদ্ধ করেছে।
দ্বারকানাথের চরিত্রে তথাগত চৌধুরী,রামমোহনের চরিত্রে শুভ গুপ্তভায়ার শক্তিশালী অভিনয় ভালো লেগেছে,বিশেষত রাজা রামমোহনকে ছবি থেকে উঠে আসা জ্যান্ত মনে হওয়ায় চমকে যেতে হয়।
একটি নাটকের সার্থকতা শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেতা অভিনেত্রীই নন ,পার্শ্ব চরিত্রদের সুনিপুণ সঙ্গত নাটককে সমৃদ্ধ করেছে।এক্ষেত্রে অলোকা- অনুসূয়া দে,জুলিয়েট -ঈপ্সিতা কুন্ডু, দয়া -সোহিনী সাঁতরা,মায়া- সম্পিয়া কর,অতীতদিনের মৃত ন্যাড়াপিসি নয়না,উইলিয়াম অ্যাডাম ডঃ শুভাশিস গাঙ্গুলি,বাবু বিভাস ব্যানার্জি,হেনরি পৌলম ব্যানার্জি,জন -শুভরাজ মল্লিক,হাবিব-অমর্ত্য চক্রবর্তী,লেডি দেবলীনা সিংহ,নিকি এবং আজিমার ভূমিকায় শ্রেয়সী রায়,সোফিয়া শ্রেয়া বিশ্বাস,মাধব-তরুণ চক্রবর্তী,পন্ডিত অনিন্দ্য ভট্টাচার্য্য,গঙ্গা দেবাঞ্জলি হালদার সবাই নিজ চরিত্রে সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন।
জোড়া সাঁকো নাটক আলো ফেলেছে যে বিষয়ে তা হল নবজাগরণ বা উন্নয়নের মুখ্য মুখ ছিলেন রামমোহন। আর এই নতুন ভাবনার ঠিক বিপরীত অবস্থান ছিল দিগম্বরীর। দিগম্বরীর বিরোধিতার মূল প্রেরণা ছিল তার স্বাধীনতাবোধ। দ্বারকানাথ একদিকে দিগম্বরী অন্যদিকে আধুনিক ভাবনার নয়া রূপকার রামমোহনের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন।
নাট্যপ্রেমী সবাই নাট্যশালার এই ‘জোড়া সাঁকো’ নাটকের পরবর্তী অভিনয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে আঠেরো শতকের এক অন্তপুরবাসিনীর সেই সময়ের শত বাধা বিপত্তির সঙ্গে যুদ্ধ করার এই দৃপ্ত উন্মেষের সাক্ষী থাকতে পারেন।
শেয়ার করুন :