পৌষ সংক্রান্তি কথা -

ছবি- কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ ইন্ডিয়া

পৌষ সংক্রান্তি  কথা 

বাংলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পৌষ সংক্রান্তি বাঙালির জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। এই দিনটি সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের মাধ্যমে শীত ঋতুর শেষে বসন্তের আগমনের সূচনা করে। পৌষ সংক্রান্তি বাংলার কৃষিজীবী সমাজে মূলত ফসল তোলার আনন্দে উদযাপিত একটি উৎসব। প্রাচীন কাল থেকে এটি বাংলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পৌষ সংক্রান্তির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

পৌষ সংক্রান্তির উৎপত্তি মূলত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে। সূর্য যখন মকর রাশিতে প্রবেশ করে, তখন এটি খারিফ ফসল কাটার ঋতুর সমাপ্তি এবং রবি ফসল বপনের সূচনা নির্দেশ করে। কৃষি-নির্ভর বাংলার মানুষের কাছে এটি নতুন বছর শুরুর মতো। ভৌগোলিকভাবে, এই সময়ে দিন বড় হতে শুরু করে এবং প্রকৃতিতে আলোর আধিক্য বাড়ে।

প্রাচীন আর্য যুগে সূর্য পূজার মাধ্যমে এই উৎসব উদযাপিত হতো। হিন্দু ধর্মে সূর্যের গুরুত্ব স্বীকৃত, এবং পৌষ সংক্রান্তি এই ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। মধ্যযুগে বাংলার গ্রামীণ জনপদে নবান্ন উৎসব এবং পৌষ সংক্রান্তি একত্রে পালিত হত।

আচারঅনুষ্ঠান বৈচিত্র্য

পৌষ সংক্রান্তি বাংলার গ্রামীণ জীবনে বিশেষ আনন্দময়। উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পিঠে-পুলির অনুষ্ঠান। নতুন চাল, নারকেল এবং খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পিঠে, যেমন পাটিসাপটা, দুধপুলি, স্নানপুলি।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, এই দিন গঙ্গাস্নান এবং পুণ্যলাভের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই উৎসবের ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়, যেমন উত্তর ভারতে এটি মাঘী, দক্ষিণে পঙ্গাল এবং মহারাষ্ট্রে তিলগুড় উৎসব নামে পরিচিত।

পৌষ মেলা

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালের ৮ই মার্চ (১২৯৪ বঙ্গাব্দের ২৬ ফাল্গুন)শান্তিনিকেতন আশ্রমের জন্য প্রণীত করা ‘ট্রাস্ট ডিড’ বা অছিপত্রে শান্তিনিকেতনে একটি মেলা বসাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।তাতে লেখা হয় :

‘নিরাকার এক ব্রহ্মের উপাসনা ব্যতিত কোন সম্প্রদায় বিশেষের অভীষ্ট দেবতা বা পশু,পক্ষী ,মনুষ্যের বা মূর্তির বা চিত্রের বা কোন চিহ্নের পূজা বা হোম যজ্ঞাদি ঐ শান্তিনিকেতনে হইবে না।—ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাস্টিগণ বর্ষে বর্ষে একটি মেলা বসিবার চেষ্টা ও উদ্যোগ করিবেন।এই মেলাতে সকল ধর্ম – বিচার ও ধর্মালাপ করিতে পারিবেন।….’

এই ডিড অনুসারে এবং মহর্ষির ইচ্ছার প্রতি সন্মান জ্ঞাপন করে শান্তিনিকেতন ট্রাস্টি ১৮৯৪ সাল থেকে এই মেলা করে আসছে।একদম শুরুর দিকে তখনকার আদিবাসী সাঁওতালরা কতৃপক্ষকে অনুরোধ করে এই মেলা প্রাঙ্গনে তাদের হস্তশিল্প বিক্রি করতে দেওয়ার,তখন থেকে পৌষ মেলায় স্থানীয় শিল্প সামগ্রী কেনা বেচার শুরু।১৮৯৪ সাল থেকে এই মেলার শুরু ,যা ১৯৪৩ সালে মন্বন্তর এবং ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণে আর এই হাল আমলে ২০১৯ থেকে মেলা বন্ধ থাকার পর এই বছর থেকে আবার সাড়ম্বরে পৌষ মেলা শুরু হয়েছে যা অত্যন্ত আনন্দের।কিন্তু ২০১৮ র হিসেবে অনুযায়ী ১৪০০ স্টল বসেছিল যার অধিকাংশই ভোগ্যপণ্যের আর আমোদ প্রমোদের যার ফলে পৌষ মেলার সাবেকি ঐতিহ্য ও চরিত্র বহুলাংশে ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে আশ্রমিকদের অভিযোগ,মেলার মূল চরিত্র ছাতিমতলায় ৭ই পৌষের উপাসনা,পরলোকগত আশ্রমিকদের স্মৃতিবাসর,পাঠভবন শিক্ষাসত্রের সমাবর্তন, ঐতিহ্যশালী বাউলের আখড়া,  এবং মেলায় গ্রামীণ হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পের দুস্থ শিল্পীদের বিক্রিবাট্টার সুযোগ এই বিষয়গুলি যেন আমোদ প্রমোদের আড়ালে গৌণ না হয় সেটি নিশ্চিত করা উচিত।তবে এ বছর থেকে যে আবার পূর্ণ কলেবরে পোষ মেলা সুসম্পন্ন হল এটি খুব স্বস্তির।              

পরিশেষে

পৌষ সংক্রান্তি শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়; এটি বাংলার সংস্কৃতি, কৃষিজীবী মানুষের আত্মপরিচয় এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি নতুন ফসলের আনন্দে মানুষের মেলবন্ধন ঘটায়। হাজার বছরের ঐতিহ্যের এই উৎসব প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালির সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও এর প্রাসঙ্গিকতা অমলিন থাকবে।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *