কমলেন্দু সরকার
সেসব অনেকদিন আগের কথা। তখন লিলি চক্রবর্তীর বয়স মাত্র ১৮। দেশভাগের আগেই মায়ের হাত ধরে চলে এসেছিলেন কলকাতা। বাবা কেশবনাথ চক্রবর্তী ঢাকার বিক্রমপুরে বিশাল সাবান ব্যবসার সবকিছু ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন তার একবছর আগেই। কলকাতা এসে কঠিন লড়াই চলেছিল কেশবনাথের। তাঁর সংসারও ছিল বড়। তিন পুত্র, ছ’কন্যা নিয়ে তাঁর পরিবার। একদিন লিলিরা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন মধ্যপ্রদেশ। বড় মামার কাছে। উনি ছিলেন কয়লাখনির সার্ভেয়ার।
এখানেই লিলির অভিনয়ের হাতেখড়ি। লিলি বলছেন, “ওখানে মা আমাদের নিয়ে নাটক, নাচ-গান করাতেন। এইসব করতে করতে আমার মধ্যে ঢুকে পড়ে অভিনয়ের বীজ। ওখানে প্রতি মাসে দুটো করে সিনেমা দেখাত। ছোট থেকেই আমার সিনেমা দেখার প্রতি খুব ঝোঁক৷ সিনেমা দেখতাম আর ভাবতাম, আমিও যদি ওইরকমভাবে সিনেমার পর্দায় নেচে-গেয়ে, হেঁটে-চলে বেড়াতে পারতাম, তাহলে বেশ মজা হত। কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হত! একটা ঘোরের ভেতর চলে যেতাম। হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে দেব আনন্দের ফ্যান হয়ে গেলাম।”
একদিন মধ্যপ্রদেশের পাট চুকিয়ে ফের কলকাতা চলে আসা। সেইসময় লিলিরা থাকতেন উল্টোডাঙায় মুরারীপুকুর রোডে। লিলি চক্রবর্তী তখন কিশোরী। মেজদি নাটক করছেন ‘নবনাট্যম’-এ। গ্রুপের রিহার্সাল হত চোরবাগানের এক বড় বাড়িতে। একদিন মেজদির সঙ্গে লিলি গেলেন রিহার্সালে। সেইসময় চলছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তর ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এর মহড়া। পরিচালক দেবব্রত সুরচৌধুরী। পরিচালকের হঠাৎই নজর পড়ে লিলির প্রতি। তিনি বললেন, “খুকি, তুমি একটা পার্ট করে দেবে?”
খুকি বলাতে বিরক্ত লিলি মুখে কিছু না-বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেন। “ওই নাটক এক রবিবার সকালে মঞ্চস্থ হল নিউ এম্পায়ারে। সেই আমার প্রথম বড় মঞ্চে অভিনয়!” ভূমিকা ছোট, মঞ্চ বৃহৎ। কিন্তু ভবিষ্যতের লিলি চক্রবর্তীর জন্য বড় ক্ষেত্র, বড় ভূমিকার ময়দান, প্রস্তুতির মহড়া হল সেই রবিবার সকালে নিউ এম্পায়ারে। টালিগঞ্জের বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মিষ্টি এই অভিনেত্রীর অপেক্ষায় রইল।
শুরু হল লিলির অভিনয়জীবন। এই অভিনয় থেকেই অফিস ক্লাবের নাটকে অভিনয় করার ডাক এলো। সেইসময় বাণিজ্যিক নাটকের পাশাপাশি অফিস ক্লাবের নাটকের একটা জায়গা ছিল কলকাতার সাংস্কৃতিক মহলে। লিলি বাবার কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। বাবা কেশবনাথ বললেন, “মা বকবে না তো?” লিলি বললেন, “দ্যাখো বাবা, মেজদি তো অনেকটাই সাহায্য করছে সংসারে, আমিও যদি কিছুটা করতে পারি। পড়াশোনা বাড়িতে করব। আমাদের অবস্থা তেমন ভাল নয়। বাবা সবকিছু ছেড়ে প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় কলকাতা এসেছেন। এ-শহরে এসে তেমন কিছু করতে পারেননি। হয়তো সেইকারণে, বাবা আর ‘না’ করেননি।
সেইসময় প্রায় সব অফিস ক্লাবেরই নাটক হত। সবগুলোই নামীদামি অফিস। অনেকসময় নাটকের পরিচালক হতেন নামী কোনও পেশাদারি নাট্য পরিচালক। আবার অনেকসময় দেখা যেত অফিসেরই কাউকে পরিচালকের ভূমিকায়। যাক গে সেসব কথা। মোদ্দা কথা হল লিলি চক্রবর্তী হয়ে উঠেছিলেন অফিস ক্লাব নাটকের নিয়মিত অভিনেত্রী। সেইসময় নাটক পিছু লিলি চক্রবর্তী নিতেন ৫০ টাকা। সেইসময় ৫০ টাকাটা নেহাত মন্দ ছিল না। অনেক টাকা। ৫০ টাকার সঙ্গে পাওয়া যেত গাড়িভাড়াও।
“একদিন হয়েছে কি, পার্ক স্ট্রিটের এক অফিস ক্লাবের নাটকের রিহার্সালে গেছি। সেই নাটকের পরিচালক ছিলেন কুনাল মুখোপাধ্যায়। তিনি সিনেমা পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়ের ভাই৷ হঠাৎই তিনি দুম করে বললেন, ‘বুড়ি তুই সিনেমায় অভিনয় করবি?’ বললাম, করব। তখন কুনালদা বললেন, ‘তাহলে তুই আগামী কালই চলে যাবি রাধা স্টুডিয়োতে। দাদার সঙ্গে দেখা করে বলবি আমার কথা। আর আমি দাদাকে বলে রাখব তুই যাবি।’ বললাম, ঠিক আছে। সঙ্গেসঙ্গে আমার মনে পড়ল সেই ভদ্রলোকের ভবিষ্যদ্বাণী, ‘দেখবে, বড় হয়ে তুমি অভিনেত্রী হবে। জনপ্রিয় অভিনেত্রী হবে। তখন আমরা বড় মামার কাছে মধ্যপ্রদেশ থাকতাম।” লিলি জানালেন তাঁর অভিনেত্রী হওয়ার গোড়ার কথা, ১৯৫৮-র কথা। রাধা স্টুডিয়োয় পৌঁছে লিলি চক্রবর্তী বিস্ফারিত চোখে দেখেন শুটিং করছেন– ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কমল মিত্র, জহর রায়-এর মতো বাঘা বাঘা অভিনেতা। “আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে সটান কনক মুখোপাধ্যায়কে বললাম, আমি লিলি চক্রবর্তী। কুনালদার কথামতো এসেছি। উনি আর কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে বললেন, ‘শুটিং কিন্তু আজই করতে হবে। পারবে তো। এঁদের সঙ্গে অভিনয় করতে হবে!’ তখন আমার কাছে কে ভানু, কে জহর, কে কমল মিত্র! আমি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে বললাম, পারব। এমনকী স্টুডিয়োর পরিবেশ, সেট দেখেও কিছুই মনে হয়নি! সটান বলে দিলাম, হ্যাঁ। তারপর মেক-আপ নিলাম মেক-আপম্যানের কাছে। সপাটে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলাম ওঁদের সঙ্গে। আজ ৮২ বছর বয়সেও কোনও কাজ করতে ঘাবড়াই না, ভয়ও পাই না। একইরকম আছি। সেদিন সকলেই তারিফ করেছিলেন আমার অভিনয়ের! ওঁরা বলেছিলেন, ‘একেবারে আনকোরা নতুন মেয়েটি কী অভিনয়টা না করে গেল!’ আমার ভূমিকা ছিল এক টাইপিস্টের।”
লিলি চক্রবর্তী অভিনীত প্রথম ছবির নাম ছিল ‘ভানু পেল লটারি’। পরদিন ছিল পার্ক স্ট্রিটের সেই অফিস ক্লাবের নাটকের রিহার্সাল। নাটকের মহড়ায় ঢুকতে গিয়েই পরিচালক কুনাল মুখোপাধ্যায়ের উড়ে আসা একটি কথায় হোঁচট খেলাম, “লিলি, তুমি কাল কি করেছ?’ আমি চমকে উঠলাম! সেটের সবাই তো বললেন, ‘দারুণ হয়েছে।’ শেষমেশ রহস্য না করে কুনাল মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘না না, অত চমকে ওঠার কারণ নেই কোনও। দাদা বললেন, ‘লিলি, দারুণ অভিনয় করেছেন। যদি আগে পেতাম তাহলে ওকেই ছবির নায়িকা করতাম। ওর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। খুব ভাল অভিনেত্রী।’ এবার আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম!’
আবার নতুন আর একটি ছবির খবর এলো লিলির কাছে। তার মাঝে ঘটে গেছে এক ভয়ংকর ঘটনা। সত্যজিৎ রায় সেইসময় ‘অপুর সংসার’ করবেন ঠিক করেছেন। ” একদিন ভানু ঘোষ আমাদের বাড়ি এলেন। ভানুবাবু বললেন, ‘আপনাকে মানিকদা, মানে সত্যজিৎ রায় একবার দেখা করতে বলেছেন।’ আমি তো অবাক হয়ে ভানু ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না! উনি চলে যাওয়ার পরও ঘোর কাটেনি আমার। তা যাইহোক, বাবার সঙ্গে একদিন সত্যজিৎ রায়ের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে গেলাম। ঘরে ঢুকে দেখি উনি কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাদের বসতে বললেন। ওঁদের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় আমাকে বললেন, ‘আমি ‘অপুর সংসার’ ছবিটা করব। তোমাকে অপর্ণার চরিত্রে কেমন লাগে, তা দেখার জন্য ডেকেছি।’
এইসব কথার হওয়ার পর উনি আর বউদি (বিজয়া রায়) আমাকে সাজিয়ে দিলেন। সাজগোজ করতে বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিল। সত্যজিৎ রায় আমাকে দেখে খুব খুশি। উনি বললেন, ‘তোমাকে দেখে নিলাম। ঠিক আছে। তবে একজনকে আমি নির্বাচন করে রেখেছি। তার একটু অসুবিধা আছে বলেছে। সে যদি না করে, তাহলে তুমি অপর্ণার রোলটা করবে। নাহলে, সেই করবে। তুমি বাদ পড়লে কিছু মনে কোরো না।’ আমি বললাম, না, না, মনে করব কেন। ঠিক আছে। তারপর তো সকলেরই জানা শর্মিলা ঠাকুর করলেন। শর্মিলা না করলে আমিই হতাম ‘অপুর সংসার’-এর অপর্ণা। তবে পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করেছি। ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৫) আর ‘শাখা প্রশাখা’য় (১৯৯০)।”
এটি লিলি চক্রবর্তীর কাছে প্রথম ছবির অফার ছিল না। তার আগে ছবি তো তিনি করেছেন। আবার সেই অফিস ক্লাবের রিহার্সাল। লিলি চক্রবর্তী নাটকের মহড়া দিচ্ছেন, এমন সময় প্রবেশ ক্যামেরাম্যান অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অনিল এবং লিলি পরস্পরের পরিচিত। তিনি লিলি চক্রবর্তীকে বললেন, ‘অভি ভট্টাচার্য একটা ছবি করবেন। পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায়। ওঁরা একজন নতুন মেয়ে খুঁজছেন। ওঁদের তোমার কথা বলেছি। ওঁরা বলেছেন তোমাকে একবার দেখা করতে।”
লিলি চক্রবর্তী গেলেন একদিন। ছবির নাম ‘মধ্যরাতের তারা’। “পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায় বললেন আমাকে, ‘তোমাকে অভিনয় করতে হবে ছবি বিশ্বাসের বড় মেয়ের ভূমিকায়। পারবে তো?’ বললাম, পারব। বাড়িতে ফিরে সেই কথা সবাইকে জানালাম। সকলেরই এক কথা, ‘তুই কী পারবি ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে অভিনয় করতে! উনি বিশাল বড় অভিনেতা। জানিস?’ আমি তো তেমনভাবে জানতাম না। তবে ভয়ও ছিল না। পরে জেনেছিলাম উনি কত বড় শিল্পী ছিলেন। প্রথমদিনের শুটিংয়ে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যা আজও স্মরণে আছে। শুটিং করছিলাম একটি দৃশ্যের। পরিচালক বললেন, ‘ও কে।’ কিন্তু ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘না হয়নি। আরও একটা শট নাও। ছবি বিশ্বাসের ওপর কথা বলার সাহস কারওরই ছিল না। পরিচালক বললেন, ‘ঠিক আছে।’ আমি তো ভয় পেয়ে গেছি। ভয়টা ভাঙিয়ে দিলেন ছবি বিশ্বাসই। বললেন, ‘লিলি তো নতুন। ও লাইট ঠিকমতো নিতে পারেনি।’ তারপর উনি আমাকে বুঝিয়ে দেন কীভাবে আলো নিতে হয়, নিতে হবে। ছবি বিশ্বাসের কথামতো শট নেওয়া হল। ওঁর কথা অমান্য করার মতো কেউ ছিলেন না তখন।”
পরে লিলি চক্রবর্তীকে শ্যামবাজারের পেশাদারি মঞ্চে নিয়ে আসেন ছবি বিশ্বাসই। নাটকের নাম ‘শ্রেয়সী’। এরই মাঝে লিলি চক্রবর্তীর জীবনে আসেন এক পুরুষ। হঠাৎই বিয়ে করেন লিলি। “এক ভদ্রলোক একদিন আমাদের বাড়ি এলেন। তাঁর নাম অজিত ঘোষ। ব্যবসা করেন। তিনি ছবি করবেন। নায়িকা আমি। এইসূত্রে তিনি যাতায়াত করতেন বাড়িতে। একসময় বাড়ির সকলের সঙ্গে মিশে গেলেন। কিছুদিন পর সবাইকে চমকে দিয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বাবা ‘না’ করেননি। বললেন, ‘ছেলেটা ভাল। আপত্তি কোথায়?’ আমাদের বিয়েটা হল, ছবিটি হল না। এই বিয়ে ছিল আমার জীবনের আশীর্বাদ। আমাকে খুবই সাহায্য করেছে সারাজীবন ধরে।”
আবার ফিরে আসি লিলি চক্রবর্তীর নাটকের অভিনয়জীবনে। স্টার থিয়েটারে ৩০০ টাকা মাসমাইনেতে ঢুকলেন লিলি চক্রবর্তী। পরে বেড়ে ৬০০ টাকা হয়। ‘শ্রেয়সী’ নাটকেও লিলির বাবার ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস। ছিলেন সব বাঘা বাঘা শিল্পী— তুলসী চক্রবর্তী, কমল মিত্র, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, সুখেন দাশ প্রমুখ। “আমাকে কেউ বুঝতেই দেননি আমি মঞ্চে একেবারেই আনকোরা। ‘শ্রেয়সী’ করে আমার প্রচুর নাম হল। বহু ছবির অফারও পেলাম। ওঁদের জন্যই আজ আমি এখানে পৌঁছেছি।”
নাটক করতে করতেই সুযোগ এল পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘আহবান’-এ। এই ছবিতে ছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়। লিলি চক্রবর্তী ছিলেন দ্বিতীয় নায়িকা। এরপর পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তীর ‘শেষ চিহ্ন’। “শুটিং করছিলাম নিউ থিয়েটার্স-দু’নম্বরে। এখানে তপন সিংহের অফিস ছিল। একদিন শুটিং করছি, উনি ডেকে পাঠালেন। সামান্য হলেও বিস্মিত হই। গেলাম ওঁর অফিসে। তপনদা আমাকে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ‘আমি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ নিয়ে ছবি করছি। আপনাকে নসুবালার চরিত্রে ভেবেছি। করবেন? আউটডোর হবে বীরভূমে। পারবেন?’ তপন সিংহের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে৷ ‘শ্রেয়সী’ তখন রীতিমতো জমে গেছে। কোনও ছুটি পাওয়া যাবে না। বীরভূমে আউটডোর ছিল প্রথম দফায় সাতদিন, পরের দফায় আরও পনেরো দিন। ‘শ্রেয়সী’ নাটকে আমার ভূমিকায় একজনকে তৈরি করে চলে গেলাম আউটডোরে। সাতদিন বাদে ফিরে দেখি, আমাকে উকিলের চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমি চারটে শো করতে পারিনি তাই আমাকে দিতে হবে চারহাজার টাকা ক্ষতিপূরণ। এত টাকা কোথায় পাব! শরণাপন্ন হলাম ছবি বিশ্বাসের। ওঁকে ব্যাপারটা সব খুলে বলি। তারপর ছবি বিশ্বাস পুরো ব্যাপারটি সামলে ছিলেন। এরপর থেকে ছুটি নিয়ে আরও কোনওরকম ঝামেলা ছিল না। চাইলেই পাওয়া যেত।
আউটডোর শুটিংয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা লিলি চক্রবর্তীর। “একবার পরিচালক বলাই সেনের ‘কেদার রাজা’র আউটডোর ছিল হরিদ্বার হয়ে দেবপ্রয়াগে। ওখানে গিয়ে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ কোনওরকমে জায়গা পাওয়া গেল। ঠিক হল মেয়েরা ঘরে থাকবে। আর ছেলেরা ছাদে। হঠাৎ সকলের খেয়াল পড়ল ছায়া দেবী নেই। তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই দুশ্চিন্তায়। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি চলছে ছায়া দেবীর! হঠাৎই আবিষ্কার করা গেল তাঁকে। দেখা গেল, উনি স্থানীয় একজনকে ম্যানেজ করে তাঁর বাড়ি থেকে গেছেন।
একদিন ‘কেদার রাজা’র শুটিং করছিলাম টেকনিশিয়ান দুইয়ে। ঠিক আমাদের পাশের ফ্লোরে শুটিং করছিলেন উত্তমকুমার। হঠাৎই দুজনেই মুখোমুখি। উত্তমদা বললেন, ‘কোন দোকানের চাল খাও বউঠান? এখনও চেহারাটা একইরকম রেখেছ!’ ‘দেয়ানেয়া’র সময় থেকে আমাকে বউঠান বলে ডাকতেন উত্তমদা। ‘দেয়ানেয়া’ আর ‘কেদার রাজা’র মাঝে চার বছর কেটে গেছে। এই ‘দেয়ানেয়া’র সেটেরই ঘটনা। আমি, বুড়োদা (তরুণকুমার) আর উত্তমদা বসে বসে মুড়ি খাব, এই দৃশ্যটির শুটিং হবে।
আমরা বসে বসে গল্প করছি। কখন যে আমরা ছবির দৃশ্যে ঢুকে পড়েছি বুঝতে পারিনি! খেয়াল হতেই উত্তমদাকে বললাম, আমরা কি রিহার্সাল দিচ্ছি। উত্তমদা বললেন, ‘হ্যাঁ’, বউঠান। এইভাবে ন্যাচারাল অভিনয় করতে হবে। তা হলেই ভাল লাগবে।’ উনি কাজ ছাড়া অন্যকিছুই ভাবতে পারতেন না। অভিনয়ের প্রতি ওইরকম ভালবাসা আর নিবেদিত প্রাণ কারওর মধ্যে দেখিনি।
শুটিং করতে করতে মজাও করতেন উত্তমদা। একটা মজার ঘটনা ঘটে পরিচালক পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভোলা ময়রা’র সেটে। উত্তমদার সঙ্গে আমার একটা অন্তরঙ্গ দৃশ্য ছিল। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। সেটের মধ্যেই উত্তমদা বিড়বিড় করে বলছেন, ‘সারা জীবন এইভাবে অভিনয় করিনি। এবার কী হয়।’ আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না। আমাকে চেপে ধরলেন। আমি বললাম, বেণুদি কিন্তু বসে আছেন। বলে দেব। উত্তমদা বললেন, ‘থাকুক বেণু। এবার কী করো দেখি।’ আমি বেণুদিকে বললাম, দেখছ তো বেণুদি উত্তমদা কেমন করছেন। বেণুদি জানতেন, উত্তমদা ওরকম মজা করেন। তখন কাজ করে মজা ছিল অনেক বেশি।”
ষাটের দশক ছিল লিলি চক্রবর্তীর অভিনয়জীবনের উত্তরণ, আর সত্তরের দশক সোনার দশক। সত্তরের দশকে তিনি বাংলা ছবির গণ্ডি টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে মলয়ালম ছবির জন্য চেন্নাই, হিন্দি ছবির জন্য মুম্বই যাত্রাও করেন। চেন্নাইয়ে আরও ছবি করার অফার থাকলেও তাঁকে চলে আসতে হয় পারিবারিক কারণ। কলকাতা ফিরে আবার সিনেমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট, প্রথম বসন্ত, মহাকবি কৃত্তিবাস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ইত্যাদি ছবি করেন। এ-থেকে বোঝা যায়, লিলি চক্রবর্তীর বরাবরই একটা জায়গা ছিল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিটি করার সময় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভীষণ ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে লিলির। সে-কথা নিজেই বলেছেন লিলি চক্রবর্তী। “এই ছবিটি করতে করতে দারুণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল ভানুদার সঙ্গে। যদিও এর আগে ভানুদার সঙ্গে ছবি করেছিলাম। আমাকে উনি খুবই ভালবাসতেন। শেষে সম্পর্কটা খুব সুন্দর একটা জায়গায় দাঁড়ায়। আমার সঙ্গে দেখা হলেই গাল বাড়িয়ে দিতেন। তার অর্থ একটা চুমু দিতে হবে। তাঁর গালে হালকা করে একটা চুমু দিতে হত। কী সুন্দর দিনগুলো ছিল! মানুষগুলোও ছিলেন ঠিক তেমনই!”
অশান্ত সত্তরের দশক। টালিগঞ্জে কাজ কমল। লিলি চক্রবর্তী পাড়ি দিলেন মুম্বই। হিন্দি ছবির সাম্রাজ্যে। এর আগেও বার কয়েক ঘুরে এসেছিলেন। প্রথমবার ১৯৬৫। ছবি ‘অগ্নিসংস্কার’-এর রিমেক ‘আনহোনি’। এই ছবির বিপরীতে ছিলেন দাদামণি অশোককুমার আর প্রদীপকুমার। দিন সাত শুটিংয়ের পর বন্ধ হয়ে যায়। ছবিটি শেষ আর হল না। করলেন পৌরাণিক ছবি ‘সম্পূর্ণ বিষ্ণু পুরাণ’।
সত্তরের দশকে টালিগঞ্জে কাজ কমলে লিলি চক্রবর্তী মুম্বইয়ের বাসিন্দা হলেন। ফ্ল্যাট নিলেন জুহুর আনন্দনগরে। সঙ্গে স্বামী অজিত ঘোষ। ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে অজন্তা প্যালেস হোটেল। ওই হোটেলে এসে উঠলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। তিনি একদিন ডাকলেন লিলি চক্রবর্তীকে। বললেন, ‘আমি ‘ফুলেশ্বরী’ করছি তোমাকে একটা চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। চলে এসো। মুকুল দত্তও আসবেন। উনি গান লিখবেন। তোমাকে আর ওঁকে একসঙ্গে চিত্রনাট্যও পড়িয়ে দেব।’
“চলে গেলাম। মুকুল দত্তের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন তনুদা। মুকুল দত্ত বললেন, ‘আপনি এখানে এসেছেন বলেননি!’ আমি অবাক! কাকে বলব! আমি তো এখানে কাউকে চিনি না। মুকুল দত্ত বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনাকে আমি খবর দিয়ে দেব।’ এরপর কেটে গেল দিন তিন-চার। সপ্তাহখানেক পর মুকুলদা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন বাড়িতে। উনি থাকতেন খার-এ। মুকুলদার স্ত্রী চাঁদ উসমানি। তিনিই দরজা খুললেন। উনি হিন্দি ছবির নামী অভিনেত্রী। পঞ্চাশের দশক থেকে হিন্দি ছবিতে কাজ করছেন। মুকুলদা বললেন, ‘এসো, ভিতরে এসো। দ্যাখো, গুলজার একটি নতুন মেয়ে খুঁজছেন। তুমি করবে?’ আমার তো না-করার কিছু নেই। হিন্দি ছবিতে কাজ করব বলেই তো মুম্বই এসেছি। এরপর সঙ্গেসঙ্গে ফোন করলেন গুলজারজিকে।
গুলজারজি কিছুক্ষণ পর গাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমরা গেলাম গুলজারজির বাড়ি। একটা ঘরে বসলাম। ঘরে ঢালাও বিছানা পাতা। একটু পর গুলজারজি ঘরে ঢুকলেন। বললেন, ‘দেয়ানেয়া’ দেখেছি। ভাল লেগেছে। আপনার ছবি আছে?’ উনি পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছিলেন। ওঠার সময় বললেন, ‘আপনার হিন্দি কেমন আসে, সেটাই তো জানা হল না!’ এরপর কিছুটা হিন্দিতে কথা হল। হাসতে হাসতে উনি বললেন, ‘আরে আপনি তো জয়াজির (বচ্চন) মতো হিন্দি বলেন!’ বললাম, আমিও তো জয়াজির মতো মধ্যপ্রদেশে বড় হয়েছি।”
এর দিন পনেরো পর গুলজারের লোক এসে লিলি চক্রবর্তীর ব্লাউজের মাপ, শাড়ি পছন্দ করতে আসেন।লিলি চক্রবর্তী বললেন, “কি শাড়ি পরব না-পরব, সে তো পরিচালক বলবেন, ঠিক করবেন। যাইহোক, ছবির শুটিং শুরু হল। ছবির নাম ‘অচানক’। নায়ক বিনোদ খান্না। উনি আমাকে খুব সাহায্য করেন। গুলজারজির কথা তো একেবারেই ভিন্ন। ওঁর মতো পরিচালক, ভদ্রলোক খুব কম আছে। আমার কখনওই মনে হয়নি আমি নতুন। কিংবা বলা ভাল আমাকে ওঁরা মনে করতে দেননি! একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আমার সঙ্গে কোনও চুক্তিই হয়নি, তাই টাকাও পাইনি! কাউকে কিছু বলতেও পারিনি!”
একদিন দাদারে রূপতারা স্টুডিয়োতে শুটিং করছেন লিলি চক্রবর্তী। সেইসময় একজন বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে সিপ্পিস্যর ডাকছেন। “দেখি, ঢাউস একটা গাড়িতে সিপ্পিজি এসেছেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি লিলি, তোমার টাকাপয়সার দরকার নেই? ছবি করলে টাকা নিলে না! কত দিতে হবে?’ আমি কী বলব! আপনি যা দেবেন, নেব। সিপ্পিজি বললেন, ‘তুমি খুব বুদ্ধিমতী। আমার দিকে বলটা ঠেলে দিলে। ঠিক আছে।’ আমার চেকটা উনি লিখেই এনেছিলেন। আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে তো?’ চেকের অঙ্ক দেখে মনে মনে বলি, ভাবতেই পারিনি এত টাকা পাব। বাংলা ছবিতে তো এত টাকা জীবনে চোখেই দেখিনি!
এরপর যে-কথাটি বললেন সিপ্পিজি তার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না আমার। বললেন, ‘বাঙালি খানা বানাতে পারো?’ বললাম, সব বাঙালি মেয়েই রান্না করতে পারে। ‘তাহলে তুমি একদিন আমাদের বাড়িতে এসো। আমার স্ত্রীর বাঙালি খাবার খুব পছন্দ, ভালওবাসে। বিশেষ করে, ইলিশ মাছ।’ দেওয়ালির দিন সিপ্পিজি আমার বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে দেন। ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি বিশাল সাইজের একটা ইলিশ আর ইয়া বড় বড় গলদা চিংড়ি কিনে রেখেছেন। ইলিশ পাতুরি আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি বানালাম। বাড়ির সবাই চেটেপুটে খেলেন। সিপ্পিজির স্ত্রী বেজায় খুশি। বাড়ি ফেরার সময় আমার হাতে উপহার তুলে দেন মিষ্টি আর অত্যন্ত একটা দামি শাড়ি। আমি মজা করে বললাম, এগুলো কি রান্নার জন্য। সিপ্পিজি আর ভাবিজি ভীষণ লজ্জা পেলেন। বললেন, ‘আমার বাড়িতে আমার মেয়ে এসেছে তাকে কী খালি হাতে ফেরানো যায় না ফেরাতে আছে।’ সত্যিই এরপর ওঁদের বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠি।
পরে এর ফল পাই। ফ্ল্যাট নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে গণ্ডগোল হচ্ছিল। তাই আমি আগে থেকেই দু’কামরার একটা ফ্ল্যাট দেখে রেখেছিলাম জুহুতেই সুজাতা অ্যাপার্টমেন্টে। দাম ৩৫০০০ হাজার টাকা। সেইসময় এটা অনেকটাই। পাব কোথায়! একদিন কপাল ঠুকে সিপ্পিজিকে ফোন করলাম। পুরো ঘটনাটা জানিয়ে বলি, যদি টাকাটা ধার দিতেন। সঙ্গেসঙ্গে উনি বললেন, ‘ধার কি বলছ! তুমি টাকাটা নিয়ে যাও। আমার পরের ছবি ‘চুপকে চুপকে’-তে কাজ করবে তার অগ্রিম দিলাম।’ এমনটা আমার কাছে ছিল কল্পনাতীত!
ফ্ল্যাট কিনলাম। শুরু হল ‘ফুলেশ্বরী’র কাজ। তখন প্রায় নিত্যযাত্রী ছিলাম মুম্বই-কলকাতা, কলকাতা-মুম্বইয়ের। ‘ফুলেশ্বরী’ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল, হয়েছিল দর্শক-ধন্য। লিলি চক্রবর্তীর অভিনয়ের প্রচণ্ড সুখ্যাতি হয়। “তনুদা বলেছিলেন, ‘তোর পুরস্কার কেউ আটকাতে পারবে না। এর আগেও ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ আর ‘কাচ কাটা হিরে’ ছবিতেও অভিনয়ের প্রশংসা হয়। শুনেছিলাম পুরস্কার পাওয়ার কথা। না, পাইনি।”
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘চুপকে চুপকে’ ছবি করেও বিস্তর খ্যাতি হয় লিলি চক্রবর্তীর। ‘আলাপ’ করেও। ‘আলাপ’-এ ছবির অনেকটা অংশ জুড়েই ছিলেন অমিতাভ বচ্চন-লিলি চক্রবর্তী। এবং ছবি শেষ হওয়ার পর হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন লিলি চক্রবর্তীকে, ‘আলাপ’ রিলিজ হলে দেখবে তোমার বাড়ির সামনে লাইন লেগে যাবে।’ পরিচালকের এই ভবিষ্যদ্বাণী খুব একটা ভুল ছিল না লিলি চক্রবর্তীর অভিনয়জীবনে। ‘আলাপ’ করতে করতেই কলকাতা এসে করেছিলেন পরিচালক পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভোলা ময়রা’। এই ছবিটি করার জন্য বিশেষ অনুরোধ ছিল ‘উত্তমকুমারের।
“আলাপ’ করার বছর দুই আগে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে করি ‘চুপকে চুপকে’। তা ‘আলাপ’-এর প্রথম দিন হৃষীদা বললেন, ‘তোমার মেক-আপ হয়ে গেলে আমাকে একবার দেখিয়ে নিয়ো।’ তা আমি হৃষীদাকে মেক-আপ দেখাতে যাচ্ছি, দেখি হৃষীদা একজনের সঙ্গে বসে দাবা খেলছেন। আর অমিতাভ বচ্চন দাঁড়িয়ে কোনও একজনের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি ভাবলাম, ‘চুপকে চুপকে’ করেছি দু’ বছর হয়ে গেল উনি কী আর চিনতে পারবেন! তা আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি। অমিতাভ বচ্চন আওয়াজ দিলেন, ‘কী লিলিজি একসঙ্গে ছবি করলাম, ক’দিন টানা শুটিংও করলাম, আর এখন পাত্তা না দিয়ে কথা না বলে চলে যাচ্ছেন! না হয়, আপনি ভাল অভিনেত্রী, তা বলে কী কথা বলতে নেই! এমনকী ‘হ্যালো’ও বলতে নেই!’ আমি ভাবতেও পারিনি অমিতাভ বচ্চনের মতো অতবড় একজন অভিনেতা এমনভাবে বলবেন! আমি লজ্জায় কোনওরকমে বলি, আমি দেখলাম আপনি একজনের সঙ্গে কথা বলছেন তাই আর…। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অমিতাভ বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে! একটু কি কথা বলতে পারতাম না।’ এরপর খুব ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল। ওঁর সঙ্গে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা খুব ভাল। মুম্বাইয়ের সকলেই ভীষণই প্রোফেশনাল। কাজের বাইরে কেউই খুব বেশি কথা বলেন না। তবে, অমিতাভ বচ্চন সেটে খুবই সাহায্য করেন সহশিল্পীদের। আমাকেও করেছেন। তাছাড়া ভীষণই ভদ্র।”
একদিন শুটিং করে মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে ফিরেছেন লিলি। দ্যাখেন তাঁর টেবিলে দু’টি চিঠি। একটি বাড়ির, অন্যটি সত্যজিৎ রায়ের। “প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের চিঠি খুললাম। উনি লিখেছেন, ‘আমি তোমার ‘ফুলেশ্বরী’ দেখেছি। খুব ভাল লেগেছে। আমি শঙ্করের ‘জন অরণ্য’ নিয়ে ছবি করব। কমলা বউদির চরিত্রটা তুমি করবে। ওখানকার অ্যাসাইনমেন্ট কী আছে আমাকে জানাও’। আমার সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল! বাসু ভট্টাচার্যকে ফোন করে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির ঠিকানা নিলাম। আমি তাঁকে চিঠিতে লিখলাম, আমার যত কাজই থাকুক আপনার ছবি করছিই।
সত্যজিৎ রায়ের প্রোডাকশন থেকে ফ্লাইটের দুটো টিকিট পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি ফিরে ফোন করেছিলাম অনিল চৌধুরী এসে আমাকে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।”
মুম্বই ছেড়ে আবার কলকাতা ফেরা। এবার যত না ছবি করার অফার এলো, তার চেয়ে বেশি এলো নাটকের। তার কারণ, “কলকাতা আসতেই জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, বীরু মুখোপাধ্যায়, হরিদাস সান্যালেরা বললেন, ‘তুমি কলকাতা থেকে যাও। নাটক করো। ভাল নাটক হলে, হিট হলে বহু পরিবার বেঁচে যাবে।’ একসময় নাটকই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। নাটকের পোকা বহুদিন ধরেই ছিল আমার মাথায়। মাধবীদি (মুখোপাধ্যায়) তখন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘না’ করছিলেন। তিনি শারীরিক কারণে ছুটি নেওয়াতে ওঁর চরিত্রটা আমি করেছিলাম। তারপর আবার মুম্বই ফিরে যাব যাব ভাবছি, ঠিক সেইসময় জহর রায় এসে বললেন, ‘রঙমহল’-এ আমি ‘অপরিচিত’ করছি, করবে?’ করলাম। এমন সময় একদিন মুম্বই থেকে সিপ্পিজি ফোন করলেন একদিন, ‘আমার ছেলে রাজ প্রথম ছবি করছে ‘ইনকার’। করবে?’ করলাম ‘ইনকার’। আমি অভিনয় করেছিলাম শ্রীরাম লাগুর স্ত্রীর ভূমিকায়।
সিপ্পিদের ছবি করে আবার কলকাতা ফিরলেন লিলি। ” এবারের নাটক ‘রাজদ্রোহী’। এবার বুঝতে পারছি বয়স হচ্ছে, মোটা হচ্ছি। ছবির কাজ কমতির দিকে, নাটকের কাজ আসছে। এরই মধ্যে ছবি করলাম উত্তমদার সঙ্গে ‘দুই পুরুষ’। প্রভাত রায়ের প্রথম ছবি ‘প্রতিদান’ও করি। নাটক আর ছবির কাজ একইসঙ্গে চলছে। ‘সুখের ঠিকানা’ নাটকটি করছিলাম তখন। সেদিন ছিল ১৫ অগাস্ট, স্বাধীনতা দিবস। ছুটির দিন নাটকের থাকত ডাবল শো। রাত তখন দশটা, ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। আবার এলো। ফোন তুলতেই উল্টো দিক থেকে একজন বললেন, ‘নির্মাল্য আচার্য বলছি। আপনার সঙ্গে মানিকবাবু কথা বলবেন।’ আমি তো রীতিমতো অবাক! এত রাতে সত্যজিৎ রায়ের ফোন! ভেসে এলো সত্যজিৎ রায়ের সেই ভারী কণ্ঠ, ‘লিলি, অনেকদিন তোমাকে দেখিনি। তোমাকে একটু দেখতে চাই। কবে আসবে?’
তারপর একদিন ছেঁড়া তার-এ নাটকের রিহার্সাল শেষে চলে গেলাম বিশপ লেফ্রয় রোডে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি। দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘আরে, এসো এসো। ঘরে এসে বসলাম। সেদিন তিনি একাই ছিলেন ঘরে। ‘তুমি নাকি মোটা হয়ে গেছ?’ বললাম, কতদিন পর দেখছেন বলুন তো। সেই ‘জন অরণ্য’র সময়। তারপর পনেরোটা বছর কেটে গেছে। মানিকদা বললেন, ‘হা ভগবান, সময়টা কেমন কেটে যায়! তুমি একটু বোসো। বউদি তোমাকে দেখবে। বাবু ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ করছে, সেখানে গেছে। তুমি একটু রোগা হতে পারবে? ছবি শুরু হতে এখনও চার মাস বাকি আছে। পারবে না?’ আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, ‘চা খাবে?’ বলেই নিজে চলে গেলেন বাড়ির ভিতরে। কাজের লোককে চা নিয়ে আসার কথা বলতে। কিছুক্ষণ পর বউদি (বিজয়া রায়) এলেন। বসলেন। বললেন, ‘সেদিন টিভিতে ‘গোরা’ দেখছিলাম একটু মোটা লাগছিল৷ আজকে তো দেখছি ঠিকই আছ।’ মানিকদা বললেন, ‘এরকম থাকলেও চলবে। তবুও দেখো যদি একটু রোগা হতে পারো। আচ্ছা, তোমার নিটিং আসে। মানে, সোয়েটার বুনতে পারো?’ আমি খুব ভাল পারি না। তবে জানি। তাই ঘাড় নেড়ে দিয়েছিলাম। বেরোবো বলে উঠলাম। উনিও এলেন। দরজা খুলে দিলেন। বললেন, ‘এক দিন অচানক’-এ তোমাকে মোটা লাগল। এখন তো মোটা লাগছে না। ঠিক আছে এরকম থাকলেও চলবে। আর একদিন এসো।’ এরপর অনেককিছু খাওয়া ছাড়লাম রোগা হওয়ার জন্য। শুটিং শুরু হল ‘শাখা প্রশাখা’র। উত্তরবঙ্গের সুকনার জঙ্গলে টানা পঁচিশ দিনের শুটিং। মানিকদার এতদিন আউটডোরে কাজ করা আমার সারা অভিনয়জীবনের একটা অভিজ্ঞতা।
ছবির চেয়ে নাটকের কাজ বাড়ল লিলি চক্রবর্তীর। ‘বিলকিস বেগম’ দারুণ জনপ্রিয় হল। হাজারেরও রজনী পার হল নাটকের। আরও কত নাটক— নাম জীবন, খোকা গুন্ডা, মানিকচাঁদ, বৈশাখী ঝড়, ন্যায়মূর্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সিরিয়ালেও। এখনও নিয়মিত সিরিয়াল করে চলেছেন লিলি চক্রবর্তী। এইসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘নিম ফুলের মধু’র দত্ত পরিবারের কর্ত্রীর ভূমিকায় লিলিকে দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। লিলি চক্রবর্তীর প্রথম ধারাবাহিক ‘হালকা হাসি চোখের জল’। তিনি মনে করেন ধারাবাহিকে তাঁর সেরা চরিত্র এবং অভিনয় “একক দশক শতক’-এর পদ্মরানি। রেড লাইট এলাকার এক মাসির ভূমিকা। ছিল পদ্মরানিকে বিড়ি খেতে হবে। খেয়েছিলাম চরিত্রের প্রয়োজনে। যদিও আমি সিগারেট-বিড়ির গন্ধ সহ্য করতে পারি না। মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করেছিলাম। এরকম চরিত্র ছবিতেও করিনি। কেউ আমাকে দেয়ওনি পদ্মরানির মতো চরিত্র।”
টলিউড, বলিউড মিলিয়ে কয়েক শো ছবিতে কাজ করেছেন লিলি চক্রবর্তী। বেশকিছু ছবিতে নায়িকাও ছিলেন। তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় অভিনেত্রী। এখনও তাঁর জনপ্রিয়তা অটুট। লিলির অভিনয় দক্ষতা, সৌন্দর্য সিনেমাপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। মুম্বইতে হিন্দি ছবির জগতেও পরিচালক-সহ সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের কাছেই তাঁর অভিনয় এবং সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল। সকলেই তাঁকে পছন্দ করতেন। বাংলা ছবিতে প্রথম সারির একাধিক নায়িকার থেকেও তিনি ছিলেন সুন্দরী, তারিফ হয়েছিল তাঁর অভিনয় দক্ষতার। তবুও লিলি চক্রবর্তী নায়িকাদের সেই জায়গাটা পাননি। তবে অভিনয় ক্ষমতা, দক্ষতা কথা কেউই অস্বীকার করেন না সিনেমার লোকজন তো বটেই, দর্শকেরাও খুবই পছন্দ করেন লিলি চক্রবর্তীকে। আজও তিনি দর্শকের চোখে ভাল অভিনেত্রী।
নায়িকা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নিজেকে গ্রুম করতে হয়। গ্ল্যামারাস করে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে হয়। মনে হয়, সেসব দিকে কোনওদিনই মন দেননি। শুধু অভিনয়ই করে গেছেন। “আমি তো নায়িকা হতে চাইনি, চেয়েছিলাম অভিনেত্রী হতে, হয়েছি। দর্শকদের খুশি করেছি। তাঁরা আনন্দ পেয়েছেন আমার অভিনয়ে, আজও পান। আমার একান্ত ইচ্ছা, আমি চাই যেদিন মারা যাব সেদিনও যেন অভিনয় করে বাড়ি ফিরি। সবচেয়ে বড় পুণ্যের কাজ হবে, যদি অভিনয় করতে করতে মারা যাই।”
বিরাশি বছরেরও বেশি বয়সেও লিলি চক্রবর্তী ভীষণভাবে আধুনিক। তাই ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও দেখা গেছে লিলি চক্রবর্তীকে। ‘কন্যাকুমারী’ এবং প্রদীপ সরকারের ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ’-এ। দু’টি ছবিও কয়েক মাস আগে মুক্তি পায় একটি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধাঙ্গিনী’ আর মৈনাক ভৌমিকের ‘চিনি টু’। আরও কয়েকটি আছে মুক্তির অপেক্ষায়। কথা চলছে কয়েকটি নতুন ছবির। ৮২ বছরেরও বেশি বয়সে এখনও সচল লিলি চক্রবর্তী। সিনেমা, সিরিয়াল সবরকম মাধ্যমেই তিনি সমানভাবে, সমানতালে সক্রিয়। তাই প্রায় প্রতিদিনই উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটে চলেছেন লিলি চক্রবর্তী।
শেয়ার করুন :