নরম গরম ধরম -

ছবি- ফার্স্ট পোস্ট

নরম গরম ধরম

‘ওঁর ভদ্রতা ছিল স্বাভাবিক,পরিশীলিত’-শর্মিলা ঠাকুর।

ভারতের অন্যতম কিংবদন্তি বর্ষীয়ান অভিনেতা ধর্মেন্দ্র গত ২৪শে নভেম্বর  ৮৯ বছর বয়সে , ৮ই ডিসেম্বর নিজের আসন্ন  ৯০তম জন্মদিনের কিছুদিন আগে চলে গেলেন।ভারতীয় সিনেমা জগতে এই মহাপ্রয়াণ ইন্দ্রপতন সম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিনেতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, তাঁর প্রয়াণ “ভারতীয় সিনেমার এক যুগের অবসান”।

ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম মহীরুহ ধর্মেন্দ্র নিজেকে প্রায়শই “একজন সাধারণ মানুষ” বলে পরিচয় দিতে দীর্ঘ ৭০ বছর অমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আর আশ্চর্য সুন্দর অভিনয় দক্ষতা স্বত্তেও মাটিতে পা রাখা অসম্ভব মার্জিত ধর্মেন্দ্র ছিলেন লক্ষ-কোটি ভক্তের অফুরন্ত ভালোবাসা ও আনুগত্যের মালিক যে ভালোবাসা কোনও প্রচেষ্টায় নয়,স্বভাবজাত মাধুর্যে তিনি অর্জন করেছিলেন।

ছবি- নববর্ষা

 সাত দশকের কর্মজীবনে ৩০০–র বেশি ছবিতে অভিনয় করে কয়েক প্রজন্মের দর্শকদের তিনি মুগ্ধ করেছেন।তাঁকে ঘিরে অসংখ্য গানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া, আর হেমা মালিনীর সঙ্গে তাঁর প্রেম ও বিয়ে একসময় ছিল সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম।“বলিউডের অরিজিনাল হি-ম্যান” কিংবা “গরম ধরম”এইসব উপাধিতে ভূষিত ধর্মেন্দ্র বহু আন্তর্জাতিক তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন “দুনিয়ার সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষদের একজন”হিসেবে।

বলিউড তারকারাও তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে নতজানু। মাধুরী দিক্ষিত বলেছিলেন তিনি “পর্দায় দেখা সবচেয়ে সুদর্শন মানুষদের একজন”; সলমান খান তাঁকে বলেছেন “সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ”; জয়া বচ্চন তাঁকে তুলনা করেছেন “গ্রীক গড”-এর সঙ্গে।ধর্মেন্দ্র অবশ্য এসব প্রশংসায় খানিক লজ্জাই পেতেন। বলতেন, “এ সবই প্রকৃতি, আমার বাবা-মা আর আমার জিনের দান।”

১৯৩৫ সালের ৮ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার নসরালি গ্রামে মধ্যবিত্ত জাট-শিখ পরিবারে জন্ম তাঁর। স্কুলশিক্ষক বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন ধর্ম সিং দেওল।২০১৮ সালে বিবিসি হিন্দিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাবা পড়াশোনাতে জোর দিতেন, কিন্তু তিনি ছোটবেলাতেই সিনেমার প্রেমে পড়ে যান। উনি বলেছিলেন “নবম শ্রেণিতে প্রথম সিনেমা দেখি আর থমকে যাই। মনে হলো,এ কোন স্বর্গ, যেখানে এত সুন্দর মানুষ থাকে? মনে হলো ওরা আমার, আমিও ওদেরই।”

পরিবারে সিনেমায় আভিনেতা হওয়ার ইচ্ছের কথা জানাতেই প্রবল আপত্তি ওঠে।ওনার কথায়,“মা বললেন, ‘তুই বড় ছেলে, সংসারের দায়িত্ব আছে।’ খুব মন খারাপ হয়েছিল। পরে ফিল্মফেয়ারের ‘অল ইন্ডিয়া ট্যালেন্ট কনটেস্ট’-এর কথা শুনে মা মজা করে বললেন, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দে আবেদনটা।‘ভাবিনি নির্বাচিত হব।”কিন্তু ভাগ্য সেখানেই পথ দেখায়-ধর্মেন্দ্র প্রতিযোগিতায় জিতে বোম্বে (বর্তমান মুম্বই) চলে আসেন। বাকিটা ইতিহাস।

ছবি- আর্ট হাউস সিনেমা

১৯৬০ সালে দিল ভি তেরা, হুম ভি তেরে দিয়ে শুরু। পরের তিন দশক তিনি প্রায় রাজত্ব করেছেন বলিউডে,বছরে বহু হিট ছবি উপহার দিয়ে।বিমল রায়ের বন্দিনী (১৯৬৩) তাঁকে প্রথম বড় পরিচিতি দেয়,এক বন্দি নারীর প্রতি আকৃষ্ট চিকিৎসকের চরিত্রে তাঁর ‘নরম অথচ নীরব’ অভিনয় দর্শক-সমালোচককে মুগ্ধ করে।এর পরই রোম্যান্টিক নায়কের রূপে উত্থান,নূতন, মীনা কুমারী, মালা সিনহা, সায়রা বানুর মতো তারকাদের সঙ্গে একের পর এক সাফল্য।১৯৬৬ সালে ফুল ঔর পত্থর–এ প্রথম অ্যাকশন-অবতারে দেখা যায় তাঁকে। তবে ১৯৭১-এর ব্লকবাস্টার মেরা গাঁও মেরা দেশ–ই তাঁকে পাকাপাকিভাবে অ্যাকশন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। চওড়া বুক, সুঠাম দেহ,বেশিরভাগ অ্যাকশন দৃশ্য তিনি নিজেই করতেন, ঝুঁকি নিয়েই।রোম্যান্স ও অ্যাকশনের বাইরেও থ্রিলার, কমেডি,সব ধারাতেই তাঁর সুনিপুণ দক্ষতা লক্ষণীয়। চুপকে চুপকে–তে  তাঁর নিখুঁত কমিক টাইমিং আজও সমালোচকদের প্রিয় উদাহরণ।কিন্তু তাঁর সেরা অনস্ক্রিন জুটি নিঃসন্দেহে হেমা মালিনী। ১৯৬৫ সালে এক প্রিমিয়ারে প্রথম দেখা। হেমা মালিনী পরে তাঁর জীবনীতে লিখেছিলেন,সেদিনই তিনি শুনেছিলেন ধর্মেন্দ্র শশী কপূরকে পাঞ্জাবিতে বলছেন, “কুড়ি বড়ি চঙ্গি হ্যায়”-মেয়েটি বেশ সুন্দর।

অভিনেতা-প্রযোজক ধর্মেন্দ্র রাজনীতিতেও পা রেখেছিলেন,২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত রাজস্থানের বিকানির থেকে বিজেপির সাংসদ। তবে সংসদে উপস্থিতি কম থাকায় সমালোচিত হন। পরে এক টিভি অনুষ্ঠানে স্বীকারও করেন“রাজনীতি নরম মানুষের জায়গা নয়, শক্ত চামড়ার লোকের জন্য।”

জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন,ছেলে সানি ও ববি দেওলের সঙ্গে অভিনয়, রিয়ালিটি শো বিচার, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের সঙ্গে আলাপচারিতা,সবই সমানে চলছিল।সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন,ওনার খামারবাড়িতে প্রকৃতির মাঝে দিনযাপনের মধুর স্মৃতি এখনও সতেজ।ধর্মেন্দ্রর প্রয়াণের  পর সম্ভবত সবচেয়ে মর্মস্পর্শী স্মৃতিমেদুর শ্রদ্ধাঞ্জলি শর্মিলা ঠাকুরের।হিন্দু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর লেকের কিছু অংশ –

ছবি- স্ক্রিনগ্র্যাব

“ধর্মেন্দ্রর হাসিটা মনে পড়লে আজও মনটা আলোয় ভরে ওঠে”,নীরব অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন শর্মিলা। তাঁদের একসঙ্গে কাজ করা বহু ছবির স্মৃতি যেন শর্মিলার কথায় এক নরম আলো হয়ে ফুটে উঠছিল।“ওঁর সঙ্গে কাজ করতে গেলে কখনও মনে হয়নি আমি এক সুপারস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর আচরণে এক অদ্ভুত কোমলতা ছিল,’টেনশন’শব্দটা যেন ওঁকে স্পর্শ করত না।”

‘এক মুসাফির এক হসিনা–র রাতের শুটিং, ‘অন্যায় অর ইনসাফ’-এর কঠিন অ্যাকশন দৃশ্য,শর্মিলার স্মৃতির খাতা থেকে যেন একের পর এক দৃশ্য বেরিয়ে এল।“ধরমজি সহ-অভিনেতা হিসেবেও তেমনই ছিলেন,মেকআপ রুম থেকে সেট পর্যন্ত সবার নাম ধরে খোঁজ-খবর নিতেন। ওঁর ভদ্রতা ছিল স্বাভাবিক, পরিশীলিত।“আমার দেখা সবচেয়ে অকপট, নিরহংকার নায়ক ছিলেন ধর্মেন্দ্র। পর্দায় কঠিন মানুষ, কিন্তু ভিতরে ছিলেন এক আশ্চর্য নরম মানুষ।”

 আজকের প্রজন্ম ধর্মেন্দ্রর থেকে দুটি জিনিস শেখার মতো,বিনয়,এবং পরিশ্রমের প্রতি অপরিমেয় শ্রদ্ধা।“এমন মানুষ চিরকাল থাকে। তাঁদের চলে যাওয়া মানে কেবল শারীরিক অনুপস্থিতি; উপস্থিতি থেকে যায় গল্পে, ছবিতে, মানুষে।একবার মেরে হামদম মেরে দোস্ত ছবির শুটিং ,এদিকে পরের দিন আমার কলকাতায় যাওয়ার কথা কারণ টাইগারের শুধু টেস্ট খেলা নয় ,ঐদিন আবার ওর জন্মদিন থাকায় আমি ধরমজিকে অনুরোধ করেছিলাম যদি দয়া করে উনি সারারাত শুটিং করেন তবে আমি পরের দিন সকাল ৭টার কলকাতা ফ্লাইট ধরতে পারব,কতটা মহানুভব হলে স্টারডমের শীর্ষে থাকা অতবড় একজন অভিনেতা সারা রাত আমার সুবিধের জন্য শুটিং করেছিলেন যা আমি জীবনে ভুলবোনা।” 

‘শোলে’তে জয়ের পাশে বীরুর দৃঢ়তা আজও কিংবদন্তি। অমিতাভ লিখলেন,“ওঁর মতো সময়নিষ্ঠ, সংযত ও নিষ্ঠাবান নায়ক বলিউডে হাতে-গোনা।ধরমজি  শক্তির প্রতীক ছিলেন, কিন্তু সেই শক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল সরলতা,যা তাঁকে আলাদা মর্যাদা দিত।”

হেমা মালিনী: “ওঁর ভালোবাসা, ওঁর স্নেহ—আমাকে আজও আগলে রাখে।ধরমজি  ছিলেন আমার জীবনের নীরব শক্তি। পরিবারের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অবিচল।তিনি জানান, ধর্মেন্দ্রর হাসি, গদ্যভঙ্গি, সহজ আচরণ—সব কিছুই তাঁকে আজও গভীরভাবে স্পর্শ করে।

সানি ও ববি দেওল লিখেছেন—“বাবা আমাদের শিখিয়েছেন, শক্তি মানে দয়া; খ্যাতি মানে নম্রতা; আর সফলতা মানে পরিশ্রম।”

জিতেন্দ্র বলেছেন,“ধর্মেন্দ্র এমন বন্ধু ছিলেন, যাঁর কাছে যেকোনও সময়ে পৌঁছোনো যেত। ওঁর মতো বড় মনের মানুষ কম দেখি।”

রেখার মতে,“অভিনয়ের বাইরেও তাঁর রসবোধ ও আন্তরিকতা তাঁকে আলাদা পরিচয় দিয়েছিল।”

শাহরুখ খান: ‘ধরমজি সেই মানুষ, যাঁকে দেখে আমরা বড় হয়েছি। ভদ্রতা শেখার প্রথম পাঠ তিনি।”

বাংলার সঙ্গে এক নীরব প্রেম

মমতা ছবির দৃশ্য

ধর্মেন্দ্রর প্রতি কলকাতার এবং বাংলার মানুষের আকর্ষণ ছিল অন্যরকম। বাঙালি দর্শক, যারা সাধারণত সংবেদনশীল এবং ‘ভদ্রলোক’ চরিত্র পছন্দ করেন, তাঁরা ধর্মেন্দ্রর রোমান্টিক এবং সংযত চরিত্রগুলি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর চেহারায় পৌরুষ থাকলেও, সেই পৌরুষের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত মাধুর্য। কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলিতে চুপকে চুপকে বা শিকার (১৯৬৮)-এর মতো ছবিগুলি যে বিপুল সাফল্য পেয়েছিল, তা থেকেই বোঝা যায় তাঁর আবেদন। টোটা রায়চৌধুরী রকি অউর রানী ছবির শুটিং চলাকালীন ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে সাক্ষাতে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে উনি বাধা দিয়ে বলেন কখনো কারুর পায়ে হাত দেবে না,হাতজোড় করে নমস্কার করবে।বাঙালি জেনে বলেছিলেন আমাকে তো বাঙালিরাই অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিল,হৃষিদা ,বিমল রায়,আমার এতো সুন্দরী বাঙালি নায়িকারা। মমতা ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন যা বাংলা ছবি ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র হিন্দি রিমেক ছিল।

ধর্মেন্দ্রর লিপে আমাদের পছন্দের ১০টি সেরা গান –

ইয়ে দোস্তি – শোলে

হুই শাম উন্কা খয়াল আয়া -মেরে হামদম মেরে দোস্ত

ইয়া দিল কি শুনো – অনুপমা

পল পল দিল কে পাস – ব্ল্যাকমেল

রহে না রহে হাম -মমতা

গর তুম ভুলে না দেনা – ইয়াকিন

হাম বেওয়াফা – শালিমার   

আজ মৌসম বড়া বেইমান – লোফার 

ড্রিম গার্ল -ড্রিম গার্ল

তুম পুকারলো -খামোশি   

তবে ধর্মেন্দ্র সমাজ মাধ্যমে আগেই মারা গিয়েছিলেন,শুধু তৃতীয় শ্রেণীর সমাজ মাধ্যমে লাইক কমেন্ট আর ভিউ বাড়াবার জন্য ওনাকে আগেই মেরে ফেলা হয়েছিল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বেশ কিছু প্রসিদ্ধ সংবাদ মাধ্যমও এই দুষ্কার্যে সামিল ছিল। 

ধর্মেন্দ্রর জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়,পাঞ্জাবের ধুলোবালির সরলতা থেকে মুম্বইয়ের আড়ম্বর, প্রেম থেকে সংগ্রাম, অ্যাকশন থেকে কবিতা। তাঁর প্রতিটি চরিত্রে ছিল মানুষের গন্ধ—হাসির, অশ্রুর, বিশ্বাসের।

তাঁর দর্শন, তাঁর সততা, দীর্ঘকাল ধরে একের পর এক ছবিতে অতুলনীয় অসামান্য অভিনয়,তাঁর সবই রয়ে যাবে আগামীর অভিনেতাদের পথ দেখানোর আলো হয়ে।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *