সুমন্ত্র মিত্র
“আমি নারী বলে আমাকে ভয় করো না? বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন।”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাতঙ্গিনী হাজরা (১৮৬৯-১৯৪২)
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক চিরস্মরণীয় নেত্রী।১৯৪২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার সামনে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।১৯০৫ সালে প্রতক্ষ্য ভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন,১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন,লবন আইন অমান্য করে গ্রেফতার হন,পরে মুক্তি পান।আবার কারারুদ্ধ,বহরমপুরে ৬ মাস,হিজলি বন্দি নিবাসে বন্দি।মুক্তির পর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে সক্রিয় সদস্যপদ ,নিজে হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড় বানাতেন তাই ‘গান্ধীবুড়ি’ নাম পরিচিত ছিলেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেস সদস্যরা মেদিনীপুর জেলার সব থানা ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয় দখল করার পরিকল্পনা করেন।এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে এখানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা।প্রধানত মহিলা স্বেচ্ছাসেবক সহ ৬০০০ সমর্থক তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে মিছিল বের হয়।মিছিলের নেতৃত্বে মাতঙ্গিনী হাজরা।শহরের উপকণ্ঠে মিছিল পৌঁছলে রাজপুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।কিন্তু সেই আদেশ অমান্য করে মাতঙ্গিনী অগ্রসর হলে তাকে পুলিশ গুলি করে,গুলি খেয়েও মাতঙ্গিনী এগিয়ে চলেন আর পুলিশের কাছে আবেদন করেন জনতার ওপর গুলি না চালাতে।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের মুখপত্র ‘বিপ্লবী’ পত্রিকার বর্ণনা অনুযায়ী ফৌজদারি আদালত ভবনের উত্তর দিক থেকে মাতঙ্গিনী একটি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করলে তিনি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের পেছনে রেখে নিজেই এগিয়ে যান।পুলিশ তিনবার তাঁকে গুলি করে।গুলি লাগে তার কপালে আর দুই হাতে তবুও তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন।এরপর বারংবার তার ওপর গুলি চালালে কংগ্রেসের পতাকা উঁচিয়ে ধরে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ৫ মে ১৯১১ – ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২
বেথুন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশন নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন।ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্যতমা প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহিদ।তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং শহিদ হন।১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখল করতে তিনি ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দলকে নেতৃত্ব দেন।প্রীতিলতার দল ক্লাব আক্রমণ করে এবং পরে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে গেলে গ্রেপ্তারি এড়াতে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামের পলাতকা’ শিরোনামে লেখা হয় ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতি প্রীতি ওয়াদ্দেদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন।তাহার বয়েস ১৯ বৎসর।পুলিশ তাহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত।
বেঙ্গল পুলিশের সি আই ডি কতৃক প্রকাশিত নোটিশঃ
‘Description – Miss Prithi Waddadar, daughter of Jagabandhu Waddadar (Baidya by caste),of Dhalghat , Patiya and Jamalkhana ,Chittagong town, aged 20/21 (looks younger than her age) ,dark,medium build,short,ugly in appearance.’A Special ‘Look Out’ should be kept for her and when traced ,the IB ,CID Bengal,Calcutta should be informed by wire. A close though unobstrusive surveillance should at the same time be kept on her movements.
স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির দেওয়া ‘ঝাঁসির রানী’ বই পড়ার সময় রানী লক্ষীবাঈয়ের তার মনে গভীর রেখাপাত করে।নিকট আত্মীয় পূর্ণেন্দু সরকার বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখলে তিনি লুকিয়ে ‘দেশের কথা’,’বাঘা যতীন’,’ক্ষুদিরাম’, ‘কানাইলাল’ বই পড়ে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে লাঠি ও ছোরা খেলা শিখে মাস্টারদার যোগ্য সহযোগী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন।মাস্টারদা সূর্য্য সেন প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্তের সঙ্গে পরিচয়ের পরেই বুঝেছিলেন এঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লবের কাজ করতে পারবে।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ
Dogs and Indians not allowed লেখা থাকত ক্লাবের গেটে।মাস্টারদা ঐ ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনাকালে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত গ্রেফতার হলে প্রীতিলতাকে নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয়।পাঞ্জাবি পুলিশের ছদ্মবেশে সঙ্গীদের নিয়ে রাত্রি ১০.৪৫ মিনিটে ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণ করেন।পুলিশের গুলিতে জখম হয়েও লড়াই চালাতে গিয়ে পুলিশ ঘিরে ফেললে সায়ানাইড খেতে শহীদ হন।
বীণা দাস ২৪ অগস্ট ১৯১১-২৬ ডিসেম্বর ১৯৮৬
বীণা দাসের নিজের কথায়ঃ
‘রক্ত বিপ্লবের পথে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের সাধনায় বাংলার মেয়েদের দানও তুচ্ছ নয়।অমারাত্রির অন্ধকার অন্তরে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই প্রাণ দেওয়া নেওয়ার দুর্গম পথে ও পরীক্ষায় বাংলার মেয়েরাও বেরিয়ে এসেছিল।মুক্তিযজ্ঞের হোমাগ্নিতে সর্বপ্রিয় বস্তুকে ইন্ধন করে আত্মদানের পুণ্যাহুতি দ্বারা ব্রত সঙ্গে করার সাধনায় তারা কোনওদিনই পিছিয়ে পড়ে থাকেনি।’
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের আর এক অগ্নিকন্যা।ছাত্রাবস্থায় যুগান্তর দলের সদস্যদের সান্নিধ্যে আসেন।১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলনে অংশগ্রহণ,১৯৩০ সালে ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গ্রেপ্তার।ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র দলের নেত্রী,১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যা র চেষ্টায় ৯ বছর কারাবরণ।১৯৪১-১৯৪৫ পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের সম্পাদিকা আর ১৯৪৬ – ১৯৫১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন।নোয়াখালি দাঙ্গার পরে সেখানে রিলিফের কাজ করতেন।স্বাধীনতার পরেও সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে নিজেকে ব্যাপ্ত রাখেন।মরিচঝাঁপি গণহত্যায় প্রতিবাদী হন।বীণা দাসের শেষজীবন মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক।স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি হরিদ্বার চলে যান।১৯৮৬ সালে ২৬ ডিসেম্বর হৃষিকেশে সহায় সম্বলহীন হয়ে পথপ্রান্তে তাঁর মৃত্যু হয়।
ননীবালা দেবী (১৮৮৮-১৯৬৭)
১৬ বছর বয়েসে স্বামীহারা। ভাইপো বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির কাছে বিপ্লবের শিক্ষা।বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী সেজে জেলে গ্রেপ্তার রামচন্দ্রর কাছ থেকে লুকোনো পিস্তলের হদিশ জেনে আসেন যা সেই সময়ে ইংরেজ পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে একটি মেয়ের কাজ হিসেবে অবিশ্বাস্য আর কল্পনাতীত ছিল।১৯১৫ সালে রিষড়ায় গৃহকত্রী সেজে বিপ্লবীদের আশ্রয়দান,পুলিশের চোখ এড়িয়ে পেশোয়ার চলে যান।পেশোয়ারে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করছে তখন কলেরায় আক্রান্ত।
জেলে বীভৎস,নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছেন,তাঁর সারা শরীরে লঙ্কা গুঁড়ো মাখিয়ে ফেলে রাখা হয়েছিল কিন্তু তাতেও ইংরেজ পুলিশ তাঁর কাছ থেকে বিপ্লবীদের কোনও গুপ্ত তথ্য বের করতে পারেনি।হাল ছেড়ে তাকে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হলে সেখানে আই বি সুপারিন্টেন্ডেন্ট গোল্ডি তাঁর আবেদন পত্র ছিঁড়ে ফেলায় তাঁর কাছে সজোরে থাপ্পড় খান।সহবন্দি দুকড়িবালা দেবীর হাড়ভাঙ্গা খাটনির প্রতিবাদে অনশন করেন।ইংরেজ পুলিশ তাঁর দাবি মানতে বাধ্য হন।
১৯১১ সালে জেনারেল অ্যামনেস্টি আইনে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে কোথাও আশ্রয় পান নি কারণ পুলিশের ভয়ে তাঁর নির্লজ্ব স্বার্থপর আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী,বন্ধু কেউ তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয় নি।
এই অগ্নিকন্যা এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে একটি আধা ঘুপচি ঘর ভাড়া নিয়ে পরম দারিদ্রে কিন্তু পূর্ণ মর্যাদা ও সগৌরবে বাকি জীবন কাটান।
কনকলতা বরুয়া (২২ ডিসেম্বর ১৯২৪-২০সেপ্টেম্বর ১৯৪২) :
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় এই কিশোরী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনিই ভারতের অন্যতম প্রথম নারী শহিদ।
১৭ বছরের এক সংগ্রামী কিশোরী কনকলতা জন্মেছিলেন ভারতের তৎকালীন আসামের অবিভক্ত দারাং জেলায়।সমস্ত ভারতীয় সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও প্রাণিত করেছিলেন।অল্প বয়সেই বিপ্লবী কনকলতা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলে্ন ১৯৪২ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক অবিভক্ত ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় আসামের মাটিতেও সমান বেগে আছড়ে পড়ে এবং কনকলতা ‘মৃত্যু বাহিনী’ দলে যোগ দেন।
১৯৪২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আসামের গহপুরের বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নেয় গহপুরের পুলিশ স্টেশনে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করবে।বিপ্লবী কনকলতা বড়ুয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা মিছিল নিয়ে রওনা হয়।পুলিশ স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছালে ব্রিটিশ পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু বিপ্লবীরা সব বাধা উপেক্ষা করে কনকলতার নেতৃত্বে সামনে এগোচ্ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ে তখন পুলিশ তখন গুলি চালালে গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে,হাতে আর মাথায়।লুটিয়ে পড়লেও হাতে তখনো পতাকা ধরা ছিল।
ওনার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানে ইন্ডিয়ান কোস্ট গার্ড তাদের ফাস্ট পেট্রল ভেসেল ওনার নাম নামাঙ্করিত করে এবং ২০১১ য় আসামের গৌরীপুরে ওনার পূর্ণাবয়ব মূর্তি স্থাপিত হয়।কনকলতার জীবন নিয়ে দুটি চলচিত্র তৈরী হয় যার দুটিরই নির্দেশক চন্দ্র মুদই।অহমিয়া ভাষায় ‘এপা ফুলিল এপা সরিল’ আর হিন্দিতে ‘পুরব কি আওয়াজ’।
তথ্যসূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী -কমলা দাসগুপ্ত,উওমেন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া -জেরাল্ডাইন ফোর্বস,সেকালের কথা-আশালতা সেন,মেয়েদের স্মৃতিকথা -চিত্রিতা বন্দোপাধ্যায়, আসামিজ উওমেন ইন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনসেন্স মুভমেন্ট -গুপ্তজিৎ পাঠক
শেয়ার করুন :