সন্মাত্রানন্দ
দরজা ঠেলে সাধনদা ঘরে ঢুকতেই আমরা একসঙ্গে হৈ হৈ করে উঠলাম। আমরা পাঁচজন—অর্থাৎ আমি, মধু, পঞ্চা, সৌমাভ আর সুপ্রভাত। পাঁচজনেরই দৃষ্টি সাধনদার হাতের ঝোঝুল্যমান শালপাতার ঠোঙাটির দিকে। সেই ঠোঙা থেকে ফুলকপির সিঙাড়ার স্বর্গীয় সুবাস মেসবাড়ির ঘরখানার বাতাসে যেন ম-ম করছে। সাধনদা হাসতে হাসতে উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে বললেন, ‘বারোটা সিঙাড়া আর একটা ফাউ! আনলাকি থার্টিন আজ কে হবে?’
‘আমি আনলাকি, আমি আনলাকি!’ বলতে বলতে আমাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।
তিরিশ বছর আগের সে এক শীতের সন্ধ্যা। তখন আমরা সোনারপুরে মেস করে থাকি। কেউ কলেজে পড়ি, কেউ বা ইউনিভার্সিটিতে। রোজ দশটায় সোনারপুর স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেন ধরি। সন্ধের দিকে মেসে ফিরে গুলতানি করি। প্রাণটা যেন গড়ের মাঠের এক্কাগাড়ির মতন মুক্ত, নির্ভার। সামান্য ফুলকপির সিঙাড়া! তাই নিয়ে কী আনন্দটাই না করতে পারতাম আমরা তখন! আমার কথা বাদের খাতায়, সেদিনের মেসবালকেরা আজ প্রত্যেকেই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে-খবর রাখি। কিন্তু সেদিনের শীতের সন্ধ্যায় ফুলকপির সিঙাড়ার মতন তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমরা যে অনাবিল আনন্দ করতে পারতাম, আজ কি তেমন আনন্দ কেউ করতে পারি? পারি না। তাহলে অমন প্রতিষ্ঠার মানেটাই বা কী, আর ওর দরকারটাই বা কী? অমন প্রতিষ্ঠার মুখে আগুন!
কথা তেতো হয়ে যাচ্ছে, তার চেয়ে বরং ফুলকপির স্বাদিষ্টতায় ফিরি। ঘরের মেঝেতে সকালের বাসি খবরকাগজ মেলে, তাতে স্তূপীকৃত সিঙাড়া থুয়ে চারিদিকে গোল হয়ে বসে খাচ্ছি। ঘরের জানালার বাইরে উনিশশো চুরানব্বইয়ের ডিসেম্বরের সন্ধ্যা শীত আর কুয়াশা মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সাধনদাই ছিলেন আমাদের লিডার। আমাদের আনন্দে রেখেই তাঁর আনন্দ ছিল। মেধাবী ছাত্র সাধনদা; তখন সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ ডক্টরেট করছেন। পুরো নাম সাধন জানা। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের এক গণ্ডগ্রামে। চেহারাটি শক্তপোক্ত, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ভারী কাঁচের পেছনে তাঁর দুটো উজ্জ্বল চোখ সব সময়েই যেন আনন্দপ্রোজ্জ্বল। অত বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান ছাত্র সাধনদা; কিন্তু তাঁকে দেখে তা বোঝা দুষ্কর ছিল। কোনো কায়ক্লেশকর কর্মেই তাঁর উৎসাহের অভাব ছিল না। রান্না করা, বাসন মাজা, বাজারহাট করা, ঘর পরিষ্কার রাখা, মেসে হিসেবপত্র সামলানো—কোনো কাজেই অপারগতা দেখিনি। সৌমাভ বলত, এক সাধনদার মধ্যে অনেকগুলো সাধনদা আছেন। তার মধ্যে একটা সাহা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী, অন্যগুলো খুদা-ই-খিদমদগার!
বস্তুত, সাধনদার মধ্যে এই যে বৈশিষ্ট্য, এ আমি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মানুষদের মধ্যে প্রায়শই দেখেছি। দুয়েকবছর আগেকার পরিসংখ্যান জানি, সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত মানুষের হার পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটিতেই। শুনেছি, ভাবা অ্যাটমিকস-এ গরিষ্ঠ সংখ্যক বাঙালি বিজ্ঞানী এসেছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকেই। অথচ আশ্চর্য, কৃষিপ্রধান এই জেলার বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষ চাষবাসে ফিরে গেছেন স্বেচ্ছায়। আমি উচ্চশিক্ষিত হয়েছি বলেই শ্রমসাধ্য শারীরিক কর্ম আমার জন্যে নয়—এমন ধারণা তাঁরা পোষণ করেন না। সাধনদা এই মনোভাবের একটা উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন।
সিঙাড়া খেতে খেতে সাধনদা বললেন, ‘তেলটা ভালো করে গরম না করেই সিঙাড়া কড়ায় ছেড়ে দিয়েছে। ওই জন্যেই কাঁচা কাঁচা রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। দাঁড়াও, একদিন মেসেই ফুলকপির সিঙাড়া ভেজে খাওয়াব তোমাদের।’
সৌমাভ একমুঠো মুড়ি মুখে ফেলে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, সাধনদা! এত সব রান্নাবান্না তুমি শিখলে কবে?’
সাধনদা স্তিমিত হেসে উত্তর দিলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় যে-হস্টেলে ছিলাম, সেখানে রাঁধুনি ছিল না। আমরাই পালা করে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতাম। সেই থেকেই…’
পঞ্চা বলল, ‘তুমি জানো না, এমন কোন কাজটা আছে, সাধনদা?’
মধু মাঝখান থেকে গাজন জমানোর জন্যে হেঁড়ে গলায় আবৃত্তির ঢঙে বলে উঠল, ‘আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে, চেয়ে থাকি বসি তীরে…’
আমি বললাম, ‘মধু! তুমি কী বলতে চাইছ আসলে? সাধনদা নৌকা বাইতে জানে না?’
কবিতার লাইনটা সিঙাড়ার টুকরোর সঙ্গে গিলে নিয়ে মধু উত্তর দিল, ‘ঠিক তাই!’
সুপ্রভাত অমনি ধাঁ করে বলে বসল, ‘ঠিকমতো না জেনেই বেমক্কা কিছু একটা বলে দেওয়ার রোগটা কিন্তু তোর একটু বেশিই বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন, মধু। তুই কী করে জানলি, সাধনদা নৌকা চালাতে জানে কি জানে না?’
সাধনদা কিছু বলছিলেন না প্রথমে। শান্ত মনে সিঙাড়া সহযোগে মুড়ি চিবোচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের বকাবাদ্য ক্রমশই বেড়ে উঠছে দেখে ধীরে ধীরে মুখ খুললেন। বললেন, ‘এমন কোনো মানুষই পৃথিবীতে নেই, যিনি সব কাজ পারেন। তবে নৌকা বাওয়ার কথা যদি বলো মধু, তাহলে বলব, নৌকা বাইতে আমি পারি। আমাদের অঞ্চলের প্রায় সকলেই পারেন। নারী, পুরুষ, ছেলে, বুড়ো—সক্কলেই। ভুলে যেও না, আমাদের সেই রাক্ষুসী কেলেঘাই নদীর কথা, যার বন্যায় ফি-বছর নাকানিচোবানি খেতে হয় আমাদের!’
আরও পড়ুন:
মধু ছাড়া আমরা বাকি চারজন অমনি, ‘অ্যাইত্তো!’ বলে হুল্লোড় করে উঠলাম। বেচারা মধু অপ্রতিভ মুখে আমাদের দিকে চেয়ে রইল।
কিন্তু আমাদের সে-হুল্লোড় হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে সাধনদা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, ‘তবে এখন আর নৌকা বাই না, বুঝলে? নৌকা বাওয়া আমার জীবনে চিরতরে শেষই হয়ে গেছে, বলতে পারো।’
সাধনদার গলায় কী যেন একটা ছিল, আমরা সবাই একসঙ্গে চুপ করে যেতে বাধ্য হলাম। সেই কণ্ঠস্বরে বিষাদ মিশে ছিল অনেকটা; কিন্তু সেই বিষাদের সঙ্গে মিশে ছিল যেন একটা অগাধ বিস্ময়! খোলা জানালার ওদিকে জমে থাকা অন্ধকারের পানে গভীর বিষাদ ও অনেকটা বিস্ময়মাখা চোখে সাধনদা অপলক চেয়ে রইলেন।
আমি সেই অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুরুই হল কবে? আর শেষই বা হল কীভাবে?’
আমার প্রশ্নে সাধনদা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে হাসলেন। এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দিলেন, ‘শুরুটা তো বললামই খুবই স্বাভাবিক আমাদের গাঁয়ের ভৌগোলিক কারণে। আমাদের গাঁ—চন্দনহাটির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে নদী। কেলেঘাই নয়। কেলেঘাইয়ের শাখানদী বলতে পারো। সে-নদীকে আমরা তিতাপানি বলে ডাকি। তো শ্রাবণ ভাদ্র মাসে এই সরু জলধারা এমন ফুলে উঠে উথালপাথাল হত যে, চন্দনহাটির পথঘাট যেত ডুবে। এপাড়া থেকে ওপাড়ায় যেতে হলেও লাগত হয় ডোঙা, নয় কলার ভেলা, নয়তো নৌকা। এই জন্যেই চন্দনহাটির প্রত্যেকটা বাচ্চাও একটু-আধটু নৌকা বাইতে পারত। সেভাবেই আমিও শিখেছিলাম। তবে নৌকা চালানোয় দক্ষ হয়ে উঠি আরেকটু বড়ো বয়সে। তখন আমি ক্লাস সেভেনে উঠেছি। তিতাপানি দিয়ে নৌকা বেয়ে এক স্যারের বাড়ি যেতাম পড়তে। আমাদের গ্রাম থেকে দেড় মাইল পরে তিতাপানি একটা জায়গায় বাঁক নিয়েছে। ওই জায়গাটাই লোকের মুখে মুখে তিতাপানির বাঁক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ওই তিতাপানির বাঁক পেরিয়ে ময়নাঠুঁটিতে স্যারের বাড়ি পড়তে যেতাম হপ্তায় দু-দিন। যদিও আমার মা ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ করতেন না। মাকে একরকম লুকিয়েই যেতে হত।’
মধু জিজ্ঞেস করল, ‘আপত্তি করতেন কেন? নৌকা ডুবে যেতে পারে বলে? নাকি অন্য কোনো বিপদ?’
সাধনদা জবাব দিলেন, ‘আমিও প্রথম প্রথম তোমার মতই ভাবতাম, নাও ডুবে যাওয়ার ভয়েই মা অমন আপত্তি করতেন। কিন্তু বারণ করার আসল কারণটা যে কী, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে, আরও অনেকটা বড়ো হওয়ার পর। একটা ঘটনা, অথবা দুর্ঘটনাও বলতে পারো। সে-ঘটনা আমার জীবনে না ঘটলে, সত্যিই কেন আমাকে মা ছোটোবেলায় পই পই করে নৌকা বাইতে বারণ করতেন, সে-কথা বুঝতেই পারতাম না আমি! আর অমন অভিজ্ঞতা না হলে আমার জীবন থেকে নৌকা বাওয়াও চিরতরে বাদ পড়ত না।’
মধু অমনি বলে উঠল, ‘তা কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটাই খোলসা করে বলছ না কেন?’
সাধনদা কেমন থতিয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে আবার সংযত করে নিয়ে বললেন, ‘না-না, আজ না হয় সেসব থাক। রাত হয়ে যাচ্ছে।’
সৌমাভ আর সুপ্রভাত কিন্তু একসঙ্গে নাছোড়বান্দার মতো বলতে লাগল, ‘ওসব শুনছি না। কী হয়েছিল, বলতেই হবে তোমাকে!’
সাধনদা বললেন, ‘জ্বালালে তোমরা! আমি নিজেই ঠিক শিওর হতে পারিনি ও ব্যাপারে এখনও!’
সাধনদার কথায় কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম যেন। বললাম, ‘তা হোক, তুমি বলো তো, সাধনদা, কী হয়েছিল!’
তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, বেশ। বলছি। কিন্তু তার জন্যে আরও এক প্রস্থ চা চাই। সৌমাভ আর সুপ্রভাতই যাক চা করতে। ওদেরই সব চেয়ে বেশি শোনার ইচ্ছে যখন…’
দ্বিরুক্তি না করে ওরা দুজন উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা বানিয়ে নিয়ে এল আমাদের সবার জন্যে সৌমাভ আর সুপ্রভাত। সঙ্গে পাঁপড়ভাজা।
সেদিন চা খেতে খেতে বড়ো আশ্চর্য একটা ঘটনা বলেছিলেন সাধনদা। এমন অবিশ্বাস্য রুদ্ধশ্বাস ঘটনা এর আগেপরে কখনই শুনিনি আমি জীবনে আর। সাধনদা সেদিন আমাদের যা বলেছিলেন, সেসব কথা সাধনদার জবানিতেই আনুপূর্বিক নীচে তুলে দিলাম।
দুই
“পউষের শীত। বছর সাতেক আগের কথা। আমি তখন প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্স অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। থাকি হিন্দু হস্টেলে। কী কারণে এখন আর মনে নেই, কলেজ ছুটি ছিল ক-টা দিনের জন্য। মাথায় খেয়াল চাপল, বাড়ি যাব। এ সময় ময়নাঠুঁটিতে একটা মেলা বসে নদীর চরে। তুলসিমঞ্জরীর মেলা নামে লোকমুখে প্রচারিত। নানা গ্রাম থেকে নানা প্রজাতির তুলসিচারা তো আসেই সে-মেলাতে, তা ছাড়াও যেকোনো মেলায় যা যা আসে, এখানেও তার কোনো কমতি হয় না। সে-মেলা আমি কোনো দিন দেখিনি। মানে, যাওয়াই হয়ে ওঠেনি আর কী! ভাবলাম, এই ক-টা দিনের ছুটি, কলেজ বন্ধ, হস্টেলও একরকম বন্ধই, যাই, বাড়ি যাই। চন্দনহাটিতে ক-দিন ঘরের ভাত খেয়ে, ময়নাঠুঁটিতে মেলা দেখে, বেড়িয়ে-টেড়িয়ে সাত দিন পরে ফিরে আসব।
যা ভাবা, তাই কাজ। ধর্মতলা থেকে সকালে বাস ধরে, খানিকটা পথ ভ্যান-রিকশায়, খানিকটা পথ পায়ে হেঁটে বাড়িতে যখন পৌঁছোলাম, তখন বেলা পড়ে এসেছে। আমার অপ্রত্যাশিত আগমনে মা-দাদা-কাকারা; বাড়ির সবাই বেজায় খুশি। ছোটোকাকা তখনই জাল নিয়ে বেরিয়ে গেল, যদি মাছ পাওয়া যায় পুকুরে।
বাড়িতে সহজ ছন্দেই কাটছিল ক-টা দিন। দিন তিনেক পরে শাকম্ভরী পূর্ণিমা। শাকম্ভরী পূর্ণিমা কাকে বলে, জানো তো? পৌষ মাসের পূর্ণিমাকে বলে শাকম্ভরী পূর্ণিমা। শাকম্ভরী হচ্ছে মা দুর্গার বহু প্রাচীন নাম। মানুষের বিশ্বাস, এই শাকম্ভরী পূর্ণিমাতেই দেবী মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। লতাগুল্ম, শাকপাতা, সমস্ত উদ্ভিদের মধ্যে ওই দিন দেবীর বিশেষ উপস্থিতি বলে মানা হয়। আসলে আমাদের দেশটা তো কৃষিপ্রধান দেশ। তাই উদ্ভিদ-লতা-গুল্মের ভিতর মাতৃ-উপাসনা এ দেশের নাড়িতে। ওভাবেই যাবতীয় লোকশ্রুতির জন্ম হয়। পরিবেশ-প্রকৃতির বিরাট ভূমিকা আছে যেকোনো দেশের লোকায়ত বিশ্বাসের পেছনে। যাক সেসব কথা।
ওই শাকম্ভরী পূর্ণিমার দিনেই তুলসিমঞ্জরীর মেলা আরম্ভ হয় ময়নাঠুঁটিতে। বাড়িতে সকাল সকাল ভাতটাত খেয়ে নিয়ে মনোগত অভিপ্রায়টি ব্যক্ত করলাম। যাব আমি ময়নাঠুঁটি—তুলসিমঞ্জরীর মেলাতে। পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায় ঘুরপথে, কিংবা ভ্যানরিকশাতেও, কিন্তু আমার ইচ্ছে তিতাপানি দিয়ে নৌকা বেয়ে যাওয়ার। কথাটা শুনেই বাড়ির সকলে হাঁ-হাঁ করে উঠল। কেউ চায় না, আমি জলপথে ময়নাঠুঁটির মেলায় যাই। তাদের সম্মিলিত আপত্তির ঠেলায় আমার মেলায় যাওয়া যখন প্রায় ভেস্তে যেতে বসেছে, তখন এই অকূলে কূল দিতে এগিয়ে এল কুহু।
কুহু কে? কুহু হচ্ছে আমার ছোটোকাকার ছোটো মেয়ে। ছোটোবেলা থেকেই কুহু আমার বিশেষ ন্যাওটা। তার যত আদর-আবদার-আড়ি-ভাব, সবই আমার সঙ্গে। তখন কুহু ক্লাস নাইনে উঠেছে। একটু একটু ঝগড়া করতে শিখেছে। সবাই যখন আমাকে নদী বেয়ে ময়নাঠুঁটি যেতে বারণ করছিল, কুহু তখন কোমরে আঁচলটা জড়িয়ে বলতে লাগল, ‘তোমরা যে কখন কী বলো না, জেঠিমা, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ছোড়দা এখন বড়ো হয়ে গেছে। কলকাতায় হস্টেলে থেকে কলেজে পড়ে। নৌকা তো ছোড়দা কত আগে থেকেই চালাতে জানে! ময়নাঠুঁটিতে মাস্টারের বাড়ি যেত নৌকা বেয়ে পড়তে। আর এখন হচ্ছে পোষ মাস; শীতকাল। তিতাপানি এখন তো চুপচাপ। কীসের বিপদ হবে ছোড়দা ময়নাঠুঁটিতে মেলায় গেলে?’
কুহুর সালিসির ফলে বাড়ির সবাইকে অবশেষে আমার ইচ্ছেতেই সায় দিতে হল। কিন্তু আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল। প্রত্যেকবার কলকাতা থেকে কুহুর জন্যে এটা ওটা উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরি। এবার ‘ধর তকতা মার পেরেক’-করে হঠাতই কলকাতা ছেড়েছি পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। তাই এবার আর কুহুর জন্যে কিছু নিয়ে আসা হয়নি। তাই নিয়ে কুহুর অভিমান; বাড়ি আসা ইস্তক এ-কদিন আমার সঙ্গে ভালোমতো কথাও বলছিল না কুহু। তাহলে হঠাৎ করে আমার পক্ষ নিয়ে সে ওকালতি করছে কেন?
কারণটা যে কী, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারলাম। সকলের অনুমতি পেয়ে আমি যখন মেলার জন্যে তৈরি হয়ে নৌকাঘাটের দিকে যাচ্ছি, দেখি, গোরুর বাথানের কাছে কুহু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছে। আমি বললাম, ‘কী রে?’
আমার দিকে কিল মারার ভঙ্গি করে উঠে কুহু বলল, ‘ময়নাঠুঁটি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার জন্যে তাঁতের শাড়ি যদি না এনেছ, তাহলে তোমারই একদিন, নয়তো আমারই একদিন!’
বুঝলাম, উকিলের ফি দিতেই হবে। বললাম, ‘কী রঙের? কেমন সুতো? কী রঙে তোকে মানাবে রে?’
কুহু চোখ ঘুরিয়ে মুখ ভেঙিয়ে আমার গলা নকল করে বলে উঠল, ‘কী রঙে তোকে মানাবে রে? জানি না, যাও! এত বড়ো ছেলে এখনও রং চেনে না!’
নৌকাঘাট থেকে যখন নাও খুলে রওনা হলাম, তখন দুপুর। অথচ তিতাপানির উপরের আকাশে কেমন যেন মনখারাপিয়া মেঘ। দেখে একটু অবাক হলাম। এখন পউষ মাস, শীতের দিন। এসময় তো বাদল করার কথা নয়। বৃষ্টি হবে নাকি?
বৃষ্টি অবশ্য হল না। মেঘ থমকে রইল এক কোণে। এ নদীপথ আমার চেনা ছোটোবেলা থেকেই। তিতাপানির বাঁক পেরিয়ে ময়নাঠুঁটি পৌঁছোতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল।
ময়নাঠুঁটিতে তুলসিমঞ্জরীর মেলা—নাম শোনা ছিল, কিন্তু কখনও এ মেলায় আসিনি আগে। এবার এসে বুঝলাম, কেন এর নাম এমনতরো। কত দূর দূর গ্রাম থেকে মেয়েরা এসেছে নানা প্রজাতির তুলসিচারা নিয়ে; বেশির ভাগ মেয়েরাই সধবা। তুলসিতরুর সঙ্গে সতীত্বের ভাবনা জড়িয়ে আছে কি না, তাই। বিস্তীর্ণ নদীচর জুড়ে মেলা বসেছে, তুলসি ছাড়াও অন্যান্য মেলায় যা যা থাকে, এখানেও সবই রয়েছে। তবে প্রধান বিশেষত্ব হল তুলো। বড়ো বড়ো দোকানে তুলো কেনাবেচার ধুম। মাটির হাঁড়ি-কলসি, মাটির তৈরি সংকীর্তনের খোল—যার আওয়াজ কী মিঠে, কী মিঠে! চাষবাসের উপযোগী লোহার সামগ্রী—সেসবও আছে। সবং, পটাশপুর, নারায়ণগড় থেকে এসেছে সরু কাঠির সুন্দর মাদুর, অমর্ষি বাগমারি থেকে এসেছে নানা আকারের সুদৃশ্য বড়ো বড়ো শাঁখ। ফলমিষ্টির দোকান, সোনারুপোর দোকান, ভাতের হোটেল, মায় চুলকাটার সেলুনও এসে বসেছে দেখলাম মেলায়। সেসব সেলুনে ‘অমিতাভকাট, মিঠুনকাট, রাজবব্বরকাট চুল কাটা হয়’-বলে সাইনবোর্ডও ঝোলানো রয়েছে দিব্বি! বেআইনিভাবে পাখি বিক্রিও চলছে দেখে কষ্ট পেলাম। তবে সে-কষ্ট খানিক হালকা হল নাগরদোলা কিংবা ম্যাজিক শো-র তাঁবুর কাছে গিয়ে। কয়েক পাক নাগরদোলাও চড়ে নিলাম। তারপর কুহুর তাঁতের শাড়ি!
এদিককার তাঁতের শাড়ি সারা বাংলায় বিখ্যাত; এসেছেও হরেক রকম। সেই শাড়ির অরণ্যে দিশেহারা হয়ে শেষ পর্যন্ত বেছেবুছে কিনলাম একটা। কুহু বেশ ফরসা মেয়ে, তো তার জন্যে মানানসই নকশিপাড় খয়েরি রঙের শাড়িই একটি নিলাম। কাপড়ের দোকানের কাছেই দেখলাম, এক বৈষ্ণব বাবাজির অতি প্রাচীন সমাধিস্থল। বহু মানুষ মানসিক শোধ করতে এসেছে, পুজো দিচ্ছে। জনশ্রুতি এই, এই ঠাকুরের পুজো দিলে নাকি হাঁটুর রোগ, পায়ের গোদ ইত্যাদি ভালো হয়ে যায়। সেই সমাধিতে প্রণাম করে ফিরব স্থির করলাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নদীঘাটের দিকে ফিরে এলাম, যেখানে আমার নৌকাটা বাঁধা আছে। কিন্তু নৌকার কাছে এসে দেখি, আমার নৌকায় তিনজন মেলাফেরত মানুষ উঠে বসেছে। কী ব্যাপার?
দুজন পুরুষ—একজন বেশ বৃদ্ধ, আরেকজন জোয়ান। আরেকটি কমবয়েসি ঘোমটাটানা বউ। তারা যাবে তিতাপানির বাঁক পেরিয়ে মুকুন্দপুরে। মুকুন্দপুর আমাদের চন্দনহাটির আগের গ্রাম। কিন্তু আমি তো আর খেয়ানৌকার মাঝি না যে, তাদের নিয়ে যাব। আমি নৌকা নিয়ে এসেছি শখ করে। কিন্তু সেকথা যতই বলি, তারা মোট্টে শুনতে চায় না। অন্য নৌকা পায়নি, সব নাও ছেড়ে চলে গেছে, এখন এরা আমারটাতেই উঠে বসেছে। যা টাকাপয়সা লাগবে দিতে রাজি, কিন্তু তাদের নিয়ে যেতেই হবে বলে আমাকে তারা জোরাজুরি করতে লাগল। আমিও উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা নৌকা পাড় থেকে খুলে ভেসে পড়লাম। কী করব? অবুঝ সব গাঁয়ের লোক, কিছু বললেও শুনতে চায় না!
লগি ঠেলে নৌকাটাকে তিতাপানির মাঝস্রোতে এনে ফেললাম। কুহুর জন্য কেনা খয়েরি রঙের শাড়ির প্যাকেটখানা কাছেই রেখে বৈঠাহাতে বসেছি গলুইয়ের কাছাকাছি। নৌকা বাইতে বাইতে আরোহী তিনজনের দিকে চাইলাম একবার। জোয়ান মানুষটি সম্ভবত মেয়েটির স্বামী। আর বুড়ো মানুষটি তার শ্বশুর। মেয়েটি বেশ দীঘল ঘোমটা টেনে বসেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেলা থেকে হাঁড়িকুড়ি, খুন্তিহাতা কিনেছে তারা। আবার একটি ঝকঝকে সুদৃশ্য লন্ঠন। দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে সে-জিনিসগুলো রেখেছে এক পাশে। আমার নৌকা ছইতোলা। তারা তিনজন ওই ছইয়ের নীচে বসেছে ঘেঁষাঘেঁষি করে। অথচ নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছে না। মেয়েটিকে দেখে মনে হল, সে জলের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আমি ওদের দিক থেকে নজর সরিয়ে মনোযোগ দিয়ে নৌকা বাইতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে এদের মুকুন্দপুরে নামিয়ে রেখে। মা নিশ্চয়ই এতক্ষণে খুব চিন্তা করছেন।
কিছু দূর নাও নিয়ে এগোনোর পর নদীর স্রোত কেমন যেন একটু এলোমেলো মনে হতে লাগল। নদীতে যারা নৌকা চালায় তারা জানে, নদীস্রোতের গতিপ্রকৃতিকে ঠিক করে বোঝাই মাঝির সবচেয়ে বড়ো কাজ। অথচ আজকে তিতাপানির জলস্রোত আমি যেন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। একবার একদিকে বইছে, পরমুহূর্তেই বিপরীত দিক থেকে ঢেউ আসছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়! ভাবতে ভাবতে কপালে আমার চিন্তার ভাঁজ পড়তে লাগল।
আকাশের দিকে চাইলাম। তিতাপানির কালো জলের উপর গম্ভীর আকাশ যেন গম্ভীরতর হয়ে উঠেছে কখন। সন্ধ্যার তরল অন্ধকারের মধ্যে উথালপাথাল হাওয়া দিতে শুরু করল। আকাশের কোণের সেই একটুকরো মেঘ এখন আর সেই এক জায়গায় থমকে নেই। ক্রমশই বাতাসের বেগে বাড়তে বাড়তে সারা আকাশ ছাইছে। ঈশান কোণে হঠাৎ বিদ্যুতের রেখা থরথর করে কেঁপে উঠল। কী আশ্চর্য! এসব তো বোশেখ-জষ্ঠির সান্ধ্য আকাশে দেখা যায়! অথচ এখন এই ভরা শীতকালে এমনতরো কালবোশেখির আয়োজন? অদ্ভুত তো!
আমার নৌকার আরোহীদের দিকে চেয়ে দেখলাম, এসবে যেন তাদের কোনো হেলদোলটুকুও নেই। যেন আমার উপর নৌকার ভার দিয়ে তারা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। চাদর গায়ে বুড়ো মানুষটি বোধহয় আধোঘুমে ঢুলছে। বাকি দুজনের অবস্থাও তথৈবচ। এ তো আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম!
ক্রমশই নদীস্রোতে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে লাগল। যেন আমার নৌকাটাকে নিয়ে তিতাপানি ছিনিমিনি খেলতে আরম্ভ করল। আমি চেষ্টা করছিলাম, যেভাবেই হোক নৌকাটাকে নদীর তীরের দিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তা পেরে উঠছিলাম না। হঠাৎ কড়কড় শব্দে মহা গর্জনে বাজ পড়ল। আমি একেবারে ভয় পেয়ে গেলাম। শক্ত হাতে হাল ধরে থাকলেও এবার বড়ো বড়ো রাক্ষুসে ঢেউ নৌকার পাটাতনের উপর উঠে আসতে লাগল। নৌকা যখন তিতাপানির বাঁকের কাছে এসেছে (অন্য সময়ের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়িই বাতাস নৌকাটাকে তিতাপানির বাঁকের কাছে নিয়ে এসেছে আজ), তখন নৌকা ভয়ানকভাবে দুলছে। একটা তুচ্ছ মোচার খোলার মতো নৌকা একবার স্রোতের উপরে উঠছে, পরমুহূর্তেই সেই তুঙ্গ থেকে নেমে আসছে অনেক নীচে।
আমি আবার আরোহীদের দিকে তাকালাম। লোকগুলো তো ভারি অদ্ভুত! এ অবস্থায় অন্য লোক হলে ভয়ে চ্যাঁচামেচি করত কিংবা নিজেরাই হাল ধরার জন্যে এগিয়ে আসত। অথচ এরা নির্বিকার চিত্তে গলুইয়ের নীচে যেমন বসে বসে ঢুলছিল, তেমনই বসে বসে ঢুলছে? আমি ঝড়ের সোঁ-সোঁ শব্দের মধ্যে গলা তুলে ডাকতে চেষ্টা করলাম ওদের।
কিন্তু আমার গলা থেকে আওয়াজ বেরোনোর আগেই নদীঢেউয়ের একটা প্রচণ্ড ঝাপটায় নৌকাটা ভয়ংকরভাবে দুলে উঠে স্রোতের মধ্যে যেন উলটে যেতে লাগল। আমি ‘মা গো’-বলে ভয় পেয়ে চোখ বুজে চেঁচিয়ে উঠলাম। ঠিক তখনই কানে তালা-ধরানো প্রচণ্ড আওয়াজে বাজ পড়ল কোথাও। বজ্রপাতের শব্দে আমি ভয়ে চোখ বুজলাম। আমার বন্ধ চোখের পাতায় নীল বিদ্যুতের তীব্র আলো ঝলসে উঠল।
সেই আচম্বিত মুহূর্তটা পার করে আমি কোনোমতে চেয়ে দেখতে গেলাম, নৌকাটা ডুবে গেছে নাকি? কিন্তু চোখ চেয়ে যা দেখলাম, তাতে ভয়ে বিস্ময়ে আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। দেখলাম, ছইয়ের নীচে সেই দুজন পুরুষ—একজন জোয়ান, আরেকজন বুড়ো মানুষ কোত্থাও নেই! ওরা দুজন কি নৌকা থেকে পড়ে গেছে ঝড়ে? আর স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম, সেই ঘোমটা-টানা মেয়েটি ছইয়ের নীচ থেকে বেরিয়ে এসে নৌকার পাটাতনের উপর বসে বৈঠা দিয়ে সবেগে নৌকা বাইছে। আমার হাতে বৈঠাটা এখন আর নেই! আমার বৈঠা ওর কাছে গেল কী করে?
কী হচ্ছে, ভালো করে বুঝবার আগেই ছইয়ের নীচে দপ করে লন্ঠনটা জ্বলে উঠল নীল শিখায়। আমি অবাক হয়ে গেলাম! মেলা থেকে কেনা নতুন লন্ঠন, তাতে তেল নেই, পলতে পরানো থাকার কথা নয়, সে-লন্ঠন জ্বলে উঠল কী করে? ফ্যাকাসে সেই অস্ফুট আলোয় যা দেখলাম এবার, তাতে আমার শরীরটা একেবারে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল!
শুধু সেই মেয়েটিই নয়, নৌকার পাটাতনের উপর সাত-সাতটি মেয়ে বসে আছে আধো আলো-অন্ধকারে এবং বৈঠা হাতে তারা ছপ্ ছপ্ শব্দে নাও বেয়ে চলেছে অখণ্ড মনোযোগে। অন্য কোনোদিকে একেবারেই দৃষ্টি নেই, তাদের সকলের চোখ জলের দিকে ফেরানো। প্রত্যেকেরই খোঁপার উপর ঘোমটা তোলা আর সিঁথিতে ডগডগ করছে লাল সিঁদুর, পরনে লাল রঙের তাঁতের শাড়ি। শুধু সেই যে-মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম, যে-মেয়েটি আজ সন্ধেয় মাথায় ঘোমটা টেনে আমার নৌকায় উঠে বসেছিল শ্বশুর আর স্বামীর সঙ্গে, কেবল তারই গায়ে কুহুর সেই খয়েরি রঙের নকশিপাড় শাড়িটা!
আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। মাত্র একটি লহমা! তারপরেই আমার বাহ্যসংজ্ঞা একেবারে লোপ পেয়ে গেল। প্রাণান্ত চেঁচিয়ে উঠে অজ্ঞান হয়ে আমি গড়িয়ে পড়লাম নৌকার কঠিন পাটাতনের উপর।”
তিন
‘জ্ঞান যখন ফিরল, ততক্ষণে কতটা সময় কেটে গেছে, জানি না। ধীরে ধীরে চোখ মেললাম কোনোমতে। ভাবলাম, বোধহয় মরেই গেছি। ধীরে ধীরে অস্ফুটভাবে মনে পড়তে লাগল সব। দেখলাম, শেষ রাতে মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে জ্যোৎস্না উঠেছে। ম্লান চাঁদের আলোয় নদীচরের কাছে বড়ো বড়ো মানুষপ্রমাণ দলঘাসের জঙ্গলের ভিতর কাদা আর কুয়াশামাখা অবস্থায় আমি কোনোমতে পড়ে আছি। আমার নৌকাটা চরের কাদার মধ্যে উলটে পড়ে আছে একটু দূরে। আর আমার বুকের উপরে কুহুর সেই খয়েরি রঙের শাড়ির প্যাকেট।
…কীভাবে যে বাড়ি ফিরেছিলাম সেই রাত্রে আমি নিজেও ভালো করে বুঝতে পারি না আজও। বাড়িতে কিছু একটা বলে দিয়েছিলাম যা হোক তা হোক। নদীঘাটে কাদায় পড়ে গেছি—এই গোছের কোনো একটা মিছে কথা।’
সাধনদা থামলেন। তাঁর কথা শুনতে শুনতে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছল আমাদের অনেক ক্ষণ। মেসের ঘরের মধ্যে সকলেই নির্বাক। বাইরে থমথম করছে ডিসেম্বরের রাত্রি।
কিছুক্ষণ পরে সেই নিথরতা ভেঙে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপারটা কী হয়েছিল বলো তো, সাধনদা? কিছু কি বুঝতে পেরেছিলে?’
সাধনদা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না। বুঝিনি আজও। তবে ছোটোকাকার মুখে বছরখানেক পরে শুনেছিলাম একটা প্রবাদ।’
সৌমাভ থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘প্রবাদ? কীসের প্রবাদ?’
সাধনদা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তিতাপানির বাঁকে, লুকিয়ে তারা থাকে! প্রবাদটা এইরকম। অনেক অনেক বছর আগে আমাদের চন্দনহাটি গাঁ থেকে বাঁকের হাট অবধি বাইচ খেলার চল ছিল। আমাদের ও অঞ্চলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এই বাইচ খেলা হত। নৌকা বাইবার প্রতিযোগিতা। সেই বাইচ খেলায় অনেক আগে আগে যোগ দিতেন গ্রামের নারীপুরুষ উভয়েই। কিন্তু পরে মেয়েদের পার্টিসিপেশনটা বন্ধ হয়ে যায়।’
সুপ্রভাত বলে উঠল, ‘কেন? কেন? মেয়েরা বাদ পড়েছিল কেন?’
সাধনদা আমাদের দিকে একবার স্থির চোখে চেয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন, ‘পরের পর প্রায় প্রত্যেক বছর একটা-না-একটা মেয়ে বাইচ খেলতে গিয়ে নৌকা সহ তিতাপানির বাঁকের কাছাকাছি ভয়ানক স্রোতের মধ্যে টালমাটাল হয়ে ডুবে যাচ্ছিল। এমন পর পর সাত-আট বছর হওয়ার পরে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ডুবে যাওয়া মেয়েগুলোর বয়সও কাছাকাছি; হবে এই বাইশ-তেইশ বছরের সব। তার থেকেই গ্রামের লোকজন যেমন হয়… নানারকম প্রেজুডিস…’
মধু বলল, ‘তুমি বলতে চাইছ, সেদিন সেই ঝড়বাদলের মধ্যে ওই ডুবে যাওয়া মেয়েদেরই দেখেছিলে তুমি নৌকায়?’
আমি বললাম, ‘তুমি তো বিজ্ঞানী, সাধনদা। তুমি এসব মানো?’
সাধনদা খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করলেই তুমি তাকে বিজ্ঞানী বলতে পারো না, ভাই! তবু আমাকেই যখন কথাটা জিজ্ঞেস করলে, আমি যা বুঝি, সেটাই বলি। দ্যাখো, বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা বিজ্ঞানের এলাকা নয়। যতক্ষণ কোনো কিছু প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ সেটার সম্পর্কে বিজ্ঞানীর কাজ হল, মনকে মুক্ত রাখা এবং কোনো সিদ্ধান্তে না আসা সেই ব্যাপারে। আসলে মুশকিলটা অন্য জায়গায়। মুশকিল হয় তখনই, যখন আমাদের পরীক্ষিত সিদ্ধান্তের সঙ্গে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা মেলে না। যা প্রমাণিত হয়েছে, যদি পরে তার বিরুদ্ধ অভিজ্ঞতা হাতে আসে, তখন আবার নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে বসতে হয়। আমি জানি এটা একটা কুসংস্কার বা প্রেজুডিস, অথচ এমন একটা অভিজ্ঞতা হল যে, তখন আর একে প্রেজুডিস বলতে বাঁধছে…’
আমরা আর কেউ কোনো কথা বলছিলাম না। চুপ করে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। মেঝে থেকে বাসি খবরের কাগজ, চায়ের কাপগুলো তুলে নিতে নিতে সাধনদা শুধু বললেন, ‘কুহু শাড়িটা পেয়ে খুশি হয়েছিল খুব। পরের দিন সকালেই সেই খয়েরি শাড়ি পরে আমাকে দেখাতেও এসেছিল কুহু। কিন্তু ভয়ে আমি ওর দিকে ভালো করে তাকাতে পারিনি। পরের দিনই কলকাতা চলে এসেছিলাম। কারা আমাকে সেই ঝড়ের রাতে নৌকায় উঠে বাঁচিয়ে দিয়েছিল, তারা কি সেই তিতাপানির বাঁকে বাইচ খেলতে গিয়ে ডুবে যাওয়া সব মেয়ে—সেসব প্রশ্নের উত্তর আজও আমি খুঁজে পাইনি।’
তারপরেই আবার যোগ করলেন সাধনদা, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, সবই হয়তো আমার আতঙ্কিত মনের কল্পনা! কিন্তু তাহলে নৌকার সেই তিনজন আরোহী কোথায় গেল?ডুবে গেল নদীস্রোতের মধ্যে সেই উথালপাতাল ঝড়জলের রাত্রে?’
শেয়ার করুন :