দীপঙ্কর দাশগুপ্ত
শোভাবাজার রাজবাড়িতে পুজোয় একবার আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। মহাভারতের বাংলা অনুবাদ ও ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র মতো শ্লেষাত্মক সমাজচিত্র রচনা করে তাঁর তখন বিশেষ খ্যাতি। রাজবাড়ির পুজোয় আমন্ত্রণ পাওয়া ছিল বিরাট ব্যাপার। অনেক বড় বড় সাহেবও রাজার বাড়িতে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ পাওয়ার জন্যে পরিচিত অন্য সাহেব বা বিশ্বস্ত বাবুদের দিয়ে সুপারিশ করাতেন। সেই কালীপ্রসন্ন পুজোয় উপস্থিত হয়ে রাজবাড়ির বৈঠকখানায় বসে আছেন। সেখানে আরও অনেক কেউকেটা বড় বড় লোকের জমায়েত। ওদিকে উঠোনে নাচের মজলিশ, আলোর বাহারে ঝলমলে চারিদিক। এমন সময় সেই নির্ভিক, স্পষ্টভাষী যুবক কালীপ্রসন্ন বলে উঠলেন, ‘রাজার বাড়ি দুগগো পুজো — নেমন্তন্ন আসা গেছে — সেপাই খাও, সান্ত্রী খাও — গোরা কনস্টেবল খাও — ফরাস তাকিয়া চেয়ার কৌচ খাও, ঝাড় সেজ দেওয়ালগিরি, বেললণ্ঠন যত পার খাও, বাঈজির সেঁইয়া বেঁইয়া খাও, কিন্তু লুচি-সন্দেশের যদি প্রত্যাশা কর তো সরে পড়’। ব্রিটিশ সাহেব-সুবো, সমাজের গণ্যমান্য লোকের মাঝে কালীপ্রসন্ন এ কী মন্তব্য করলেন! রাজবাড়ির পুজোয় এলাহি সব ব্যবস্থা। অথচ অতিথি আপ্যায়নে খাবারের কোন নাম-গন্ধ নেই! ভালো-মন্দ খাবার-দাবার ছাড়া আবার পুজোর মজা কী! পুজো মানেই তো খাওয়া দাওয়া। মজলিশে একটা হাসির রোল উঠল। কাউকে আবার দেখা গেল একটু অপ্রতিভ হতে। সেখানে উপস্থিত রাজ বাড়ির প্রতিভূ হরেন্দ্রকৃষ্ণ কিন্তু মোটেই বিব্রত হলেন না। তিনি বললেন, কী জানেন কালীবাবু, আমাদের বৃহৎ ব্যাপার, এই কলকাতার সাহেবই বলুন, মেমই বলুন আর সমস্ত বড় মানুষেরা তো আছেনই। কাজেই এই নাচের মজলিশের সঙ্গে আবার খাওয়ানোর উদ্যোগ করলে সামলানো মুশকিল। তাই উৎসব-অনুষ্ঠানের পরে বাড়ি বাড়ি খাবার পাঠানো হয়। কালীপ্রসন্ন কিন্তু হরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের কথা শুনে মোটেই খুশি হতে পারলেন না। বরং তাঁর মুখের ওপরে বলে দিলেন, ‘সামলাতে পারা যায় কিনা, একবার চেষ্টা করে দেখলে হয়’। এর পরেই তিনি রাজবাড়ি থেকে ফিরে গেলেন। অভিজাত পরিবারের পুজোয় আমন্ত্রণ আছে অথচ খাবার নেই — এই বিষয়টা তিনি মোটেই ভালো চোখে দেখেন নি। রাজবাড়িকে টেক্কা দিতে পরের বছরেই কালীপ্রসন্ন তাই নিজের বাড়িতে দুর্গোৎসব উপলক্ষে বিরাট আয়োজন করলেন। রাস্তার দু’ধারে রোশনাই, বাড়িতে নাচ গানের জমাটি আসর বসিয়ে এবং হাজার হাজার লোককে নিমন্ত্রণ করে ভুরিভোজ করালেন। এই ব্যবস্থা তিনি পরপর বেশ কয়েক বছর ধরে চালিয়েছিলেন। যত জাঁকজমকই হোক, খাওয়াদাওয়ার পর্ব ছাড়া পুজোর যে কোন উদ্যোগ আয়োজনই যে বৃথা, উনিশ শতকের এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আরও পড়ুন:
রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘সাদা মুখের শোভায় রাজবাড়ির উঠানে পদ্মফুলের মালা ফুটে উঠত আর আমরা কালো কালো অলিরা আশেপাশে ঘেঁষে ঘুঁষে গুঞ্জন করতুম। সাহেবদের জন্যে একটু শেরি, শ্যাম্পেন, ব্র্যান্ডি বিস্কুট থাকত বটে, ভাগ্যবান দু-দশজন প্রসাদও পেতেন, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার বেলা বাঙালিদের ফক্কা, আর অটিকিটি ভদ্রলোকের পক্ষে গলাধাক্কা।’ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও শারদীয় বিবরণে শুনিয়েছেন একই বৃত্তান্ত —
‘শান্তশীল সাহেবেরা বজরায় করি ডেরা
যাইবেন সমীরসেবনে।
কিন্তু খানালোভি যারা নগরে থাকিবে তারা
টাকিতেছে শুদ্ধ নিমন্ত্রণে।।
রাজার বাটিতে ধূম উঠিবে খানার ধূম
হোমের ধূমেতে মিশাইয়া।
ত্রিতাপ হইবে শূন্য শত অশ্বমেধ পূণ্য
লাভ হবে গোমেধ করিয়া।।’
কালীপ্রসন্ন যে খাবারের প্রসঙ্গ তুলে সন্দেশের কথা উল্লেখ করলেন তারও বিশেষ কারণ ছিল। সেই সময় বাঙালি সমাজে শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন ছিল সন্দেশ। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ খেতেন ডাব ও সন্দেশ। ব্রাহ্মণ পন্ডিত বিদায়ের সময় আটটি কাঁচাগোল্লা বা অন্তত ছানা ও চিনি দেওয়ার রীতি ছিল। কুটুম বাড়ির জন্যে তত্ত্বই হোক বা মেয়ের বাড়ির খবর আনতে যাওয়া, কুরুশের কাজ করা সাদা ঢাকনা দিয়ে এক থালা সন্দেশ পাঠানো ছিল সাধারণ রেওয়াজ। পরিবারে শিশু জন্মালে যেমন পাড়ায় সন্দেশ বিলি করা হত তেমনই অন্নপ্রাশন, উপনয়ণ, বিবাহ, শ্রাদ্ধ সহ যাবতীয় সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং পুজো-পার্বণে সন্দেশের ভূমিকা ছিল অনিবার্য। সেকালের এক সুরসিক প্রাবন্ধিক তাই লিখেছিলেন, বেণীবাবুর ছেলে বি.এ. পাস করায় বন্ধুবান্ধবদের তিনি নেমন্তন্ন করে পোলাও, কালিয়া, মাছ, মিষ্টি খাওয়ালেন; কিন্তু সন্দেশ করেননি বলে নীলকণ্ঠবাবু বললেন যে তাঁদের সন্দেশ খাওয়া বাকি রয়ে গেল।
কাজেই মোটেই আশ্চর্যের নয় যে এক সময় এই বঙ্গে তৈরির রকমফেরে এবং স্বাদের বৈচিত্র্যে সন্দেশই ছিল প্রায় তিরিশ রকমের। পানিহাটির গুঁপো যা দেখতে ছিল দুখানা ফেনি বাতাসা একসঙ্গে জুড়ে দেওয়ার মতো, সোদপুরের রামচাকি, রানাঘাট-শান্তিপুরের কাঁচাগোল্লা, জনাইয়ের মনোহরা, আড়িয়াদহের ভূতো ময়রার আমসন্দেশ, চন্দননগরের তালশাঁস, শিমুলিয়ার জলভরা তালশাঁস, মদন দত্তের বাড়ির কপাট ভাঙা কড়াপাক, তারই অপভ্ৰংশ সিমলার কড়াপাক, রাতাবি সন্দেশ। এছাড়াও ছিল আবার খাব, অবাক, গোলাপ ফুল, কাঁচা আমের গন্ধ-যুক্ত সবুজ রঙা আমসন্দেশ, কামরাঙা, মনোরঞ্জন, কস্তুরি। আস্ত ডিমের মতো দেখতে ডিম সন্দেশ ছিল যার ভিতরের পুর হলদে রঙের আবার ডিম সিদ্ধ কাটলে যেমন দেখায় ছিল ঠিক তেমন কাটা ডিম সন্দেশ। আতা, বরফি, চপ, বিস্কুট, চকোলেট ও ক্ষীরের সন্দেশ এবং আইসক্রিম সন্দেশও ছিল। আর একরকম ছিল এখন বাংলাদেশের অন্তর্গত পোড়াদহে সরের নাড়ু। এমন সব সন্দেশ এখনও নামে হয়ত কিছু টিঁকে রয়েছে, তবে অধিকাংশ বিলুপ্ত। সেই আমলে গরুর দুধের ছানায় সন্দেশ হত। দুধে কোন ভেজাল তো ছিলই না, মাঠাও তোলা হত না। কাজেই সেই সন্দেশের স্বাদ যে স্বর্গীয় হবে তাতে আর সন্দেহ কী! আর সেই সব সন্দেশ মুখে দিলে ঠিক কেমন অনুভূতি হত, তাও এখন আমাদের কল্পনাতীত।
সেকালে ধনাঢ্য জমিদার বা অবস্থাপন্ন অভিজাত পরিবারে দুর্গাপুজোয় সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানোর প্রথা ছিল। তখনকার সমাজে জাতপাতের বিষয়টি প্রাধান্য পেত। তাই ব্রাহ্মণের বাড়িতে খাওয়ানো হত ভাত, পাঁচ রকমের তরকারি, দই, পায়েস। শাক্ত ব্রাহ্মণ হলে মাছ থাকত। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত সেকালের কলকাতার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, বামুন বাড়িতে শাকের ঘন্ট, মোচার ঘন্ট যা হত অতি উপাদেয় হত। কারণ, বাড়ির মেয়েরা রাঁধত। যিনি যে বিষয়ে পারদর্শী, তিনি সেই পদ রাঁধতেন আর সকলে খেয়ে প্রচুর সুখ্যাতি করতেন। রান্না হত কাঠের উনানে, মাটির হাঁড়িতে। সেই রান্না হত অতি সুস্বাদু। কায়স্থের বাড়িতে হত লুচি আর কুমড়ো, পটল, মটর ভেজানো দিয়ে ছক্কা। তাতে কিন্তু আলু থাকত না। আর সেই ছক্কা হত আলুনি। কলাপাতার ওপরে ডানদিকের কোনায় দেওয়া হত লবণ। আলুর প্রচলন তখনও হয়নি। কাঠের জাহাজে বোম্বাই থেকে আলু আসত। তাই নাম ছিল বোম্বাই আলু যা ছিল মহার্ঘ এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এখনকার পুজোর ভোগ বা খাওয়াদাওয়ায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু ও টোম্যাটো ছাড়া আমরা ভাবতে না পারলেও তখন সবই ছিল দুষ্প্রাপ্য। তখনকার খাওয়া দাওয়ায় চালু ছিল পটল ভাজা ও শাকের ঘন্ট। এখনকার ভোজের শেষে চাটনির সঙ্গে পাঁপড় ভাজা অনেকেরই প্রিয়। কিন্তু পাঁপড়ে হিং দেওয়া থাকে বলে সেকালে পাঁপড় ভাজার প্রচলন ছিল না। কারণ, সাধারণ লোকে হিং দেওয়া জিনিস খেত না। লুচি ছাড়া তখন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিল ‘কর্মবাড়ির কচুরি’ — কড়াইডালের পুরে আদা, মৌরিবাটা দিয়ে সেই কচুরির স্বাদই ছিল আলাদা। কলাইয়ের ডালের জনপ্রিয়তা ছিল এমনই যে প্যারীমোহন কবিরত্ন গান বেঁধেছিলেন —
,’যত রকম ডাল আছে এ সংসারে
কলায়ের কাছে সব শালা হারে…
মাংস তুল্য গুণ মাষ কলাই ধরে,
শিব লিখিছেন তন্ত্রসারে’।
পরম উপাদেয় সেই কচুরির সঙ্গে থাকত তেকোনা নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর, কাঁচাগোল্লা। আর মাটির খুরিতে চার রকমের সন্দেশ। তিনটে দেওয়া হত না। খাজা দিয়ে ক্ষীর খাওয়া হত বলে ক্ষীর-খাজা কথাটি সুপ্রচলিত ছিল। কিন্তু বিজয়া দশমীর প্রণাম, কোলাকুলি সবেতেই থাকত কোন সন্দেশ নয়, নারকেল কোরার সঙ্গে ছানা ও বাটা চিনি পাক দিয়ে তৈরি নারকেল ছাপা। পরবর্তীকালে বাংলায় আলু চাষ শুরু হওয়ার পর নুন দেওয়া আলুর দম আর নুন দেওয়া ছোলার ডাল চালু হওয়ায় আলুনি কুমড়োর ছক্কার দাপট কমে গেল। ততদিনে পাঁপড়, সিঙ্গাড়া, গুজিয়াও নিমন্ত্রিতদের পাতে পড়তে শুরু করেছে।
সেই সময় কলকাতায় একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল- মা এসে গয়না পরেন জোড়াসাঁকোয় শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ি, ভোজন করেন কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়ি আর নাচ দেখেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে। শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ির মতো ঠাকুরের অপরূপ সাজ সত্যিই আর কোথাও হত না। আর আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে অভয়চরণ মিত্রের বাড়ির দুর্গোৎসব ও শ্যামাপূজা ছিল দেখার মতো। বাড়ির প্রাঙ্গনে বিভিন্ন ফল ও মিষ্টান্ন সজ্জা ছিল দুর্দান্ত আকর্ষণীয়। সেকালে রাসের সময় রাসমঞ্চের সামনে জাল খাটিয়ে নানা রঙের শোলার মাছ, ফুল, পাখি টাঙিয়ে ইন্দ্রজাল রচনা করা হত। সেরকমই দুর্গোৎসবের সময় মন্ডপের সামনের অঙ্গনে রচনা খাটানো হত। তাতে মাটি বা শোলার নয়, আসল ফলমূল যেমন কাঁদিশুদ্ধ নারকেল, কলা, মোচা, লাউ, কুমড়ো, বেল, আখ, লেবু, ডালিম ও বিভিন্ন ধরনের ফুল অত্যন্ত নান্দনিক ভাবে ঝোলানো হত। আর তার সঙ্গে থাকত নানা রকমের মিষ্টান্ন। একেকটি জিলিপি যেন গরুর গাড়ির একখানি চাকা, বিরাট বারকোষের মতো একেকটি গজা আর কামানের গোলার আকারের মতিচুর। ঠাকুর দালানে মায়ের প্রতিমার দুপাশে দুটি বিশাল থালা পাতা হত। তাতে উপরে উপরে একের পর এক মিঠাই সাজানো হত একেবারে মেঝে থেকে কড়িকাঠে গিয়ে ঠেকত। নিচের থাকে কাশীর কলসির মতো এক একটা বড় মিঠাই। তার ওপরের থাকে তার চেয়ে একটু ছোট। এমনি ভাবে আকৃতিতে কমে কমে চূড়ায় একটি ১০-১২ সেরের আগমন্ডা। দেবদেবীর পুজোয় নিবেদন করা ফলমূল, নৈবেদ্য ও ভোগ প্রসাদ হিসেবে পাওয়ার প্রথা চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। পুজোয় নিবেদন করা হয় বলেই প্রতিটি জিনিস তৈরির পিছনে ছিল পরিবারের মেয়ে-বউদের অসীম যত্ন, ভালোবাসা ও ভক্তি। বাংলার রন্ধন-সংস্কৃতির উৎকর্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত দৈব ভাবনা, কারণ, কৈলাস থেকে আসা উমা যে ঘরেরই কন্যা।
কলকাতার রাজবাড়ি বা বনেদি বাড়ির দুর্গোৎসবের জাঁকজমকের পাশাপাশি পল্লীবাংলার পুজোর চিত্রটি ছিল বাহুল্যবিহীন আন্তরিক সারল্যে ভরা। পুজোর ক’দিন সেখানে মন্ডপে বা ঠাকুরদালানে আসা দর্শনার্থীদের দেওয়া হত নারকেল নাড়ু, কলা ও বাতাবি লেবুর টুকরো। বিকেলে বা সন্ধ্যায় এলে নাড়ু ও বাতাসা। বিভিন্ন পুজো বাড়িতে তৈরি হত ছাঁচে ফেলে ক্ষীরের সন্দেশ আর নানা আকারের ছোট বড় নারকেল নাড়ু। পুজোর কয়েকদিন আগে থেকে বাড়ির মহিলারা দুপুর থেকেই নিরামিষ রান্নাঘরে নারকেল ভাঙতেন। কুরুনি নিয়ে বসতেন কজন। নারকেল পাক দেওয়ার কাজে অন্য কয়েকজন। যেসব নারকেল ফোঁপরা হয়েছে, সেগুলি দিয়ে নাড়ু হত না। ফোঁপরা সহ নারকেল কুচি চারপাশে ঘুর-ঘুর করা ছোটরা পেত। নাড়ু সাধারণত চমৎকার সোনালি রঙা দানাদার আখের গুড়ে হলেও কিছু নাড়ু হত চিনি দিয়ে তৈরি। সেগুলিকে বলা হত রসকরা। আবার কিছু লম্বা, চ্যাপ্টাকৃতি গলদা চিংড়ির মাথার মতো করে ঘিয়ে ভাজা হত যার নাম ছিল ইচার মুড়া। আগুনের তাপে গায়ে রঙ ধরলে অনেকটা গলদা চিংড়ির মাথার মতোই দেখতে হত। আর ছিল কটকটে, দাঁতভাঙা তিলের নাড়ু। পুজোয় শুধু নাড়ু, বাতাসা, সন্দেশ ও ফলমূল দিয়ে আতপ চালের নৈবেদ্যই হত না, মুগ ডালের নৈবেদ্যও দেওয়া হত। ঝকঝকে কাঁসার রেকাবিতে মাঝখানে উজ্জ্বল হলুদ রঙের ডালের চুড়ো, চারপাশে কলা, নারকেল কোরা, বাতাসা। প্রসাদ হিসেবে দই ও সন্দেশ দিয়ে চাল-কলা মাখার পাশাপাশি, কলা, নারকেল, বাতাসা দিয়ে মুগমাখাও ছিল উপাদেয়। গ্রামাঞ্চলে পুজোর ভোগে খিচুড়ি, লাবড়া তো থাকতই। প্রতিমা বিসর্জনের পরে আয়োজন করা হত পাত পেড়ে দুপুরে খাওয়ার। একসঙ্গে পংক্তি ভোজনে কাঁসার থালা বাটি গেলাস ব্যবহৃত হত না। ভাত, তরকারি, ডাল, মাছের ঝোল, বিলিতি আমড়ার টক, পায়েস সবই কলাপাতায় পরিবেশন করা হত।
বারোয়ারি বা বাড়ির পুজোর পাশাপাশি এখন জাঁকিয়ে বসেছে আবাসনের পুজো। পুজোর ক’দিন সেখানে বাড়িতে রান্নার পাট নেই। বরং সেখানে নানান সুখাদ্যের মেনুতে সেজে ওঠে কম্যিউনিটি লাঞ্চ ও ডিনার। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় রাধাবল্লভি ও আলুর দম দিয়ে যার সূচনা এবং সপ্তমীতে ইলিশ ভাপা, অষ্টমীর খিচুড়ি, নবমীতে খাসির মাংস এবং দশমীর রাতে বিরিয়ানি আর চিকেন চাঁপে যার সুতৃপ্তির সমাপন। এবারের পুজোর পরিবেশ অবশ্য একেবারেই আলাদা। আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে বহু আবাসনের পুজো এবারে বাহুল্য বর্জিত। একসঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়ার প্রচলিত প্রথাতেও তাই সাময়িক বিরতি।
পুজোর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব অবশ্য দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জনেই শেষ নয়, তার রেশ চলে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত। দুর্গাপুজো যতটা এলাহি ও সর্বজনীন, সেই তুলনায় লক্ষ্মীপুজো একান্তই ঘরোয়া। অধিকাংশ বাড়িতে সেদিন ভোগের রান্না ও পুজোর উপচার নিয়ে গৃহিণীদের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। কয়েক দশক আগেও দেবীর নিবেদনের থালায় অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে নারকেলের তৈরি নানারকম মিষ্টান্ন থাকতই। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চিঁড়াজিরা, নারকেলের তক্তি ও চন্দ্রপুলি। পূর্ববঙ্গের কিছু পরিবারের পুজোর বৈশিষ্ট্য লক্ষ্মীদেবীর সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয় ভুনি খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, লাবড়া, নারকেল কোরা দেওয়া জলপাইয়ের চাটনি ও সুজির পায়েস।
আধুনিক কালে পুজো বা উৎসবকে কেন্দ্র করে যত্ন আর মমতায় ভরা সেই একান্নবর্তী সুখী গৃহকোণের চিত্রটি পুরোপুরি অবলুপ্ত। মেট্রোপলিটান সমাজে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পুজো এখন হ্যাপেনিং ইভেন্ট। বাড়ির রান্না বা ভোগের খিচুড়ির চেয়ে তাদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় কাবাব, বিরিয়ানি, পোলাও, ইতালিয়ান কি চাইনিজ অথবা মেডিটেরেনিয়ান। ইটিং আউট আর ফুড ডেলিভারি অ্যাপের নির্ভরতায় কেটে যায় উৎসবের মরসুম। পুজো আর তার মোচ্ছবকে কেন্দ্র করে এখনকার সমাজচিত্র তাই মনে করিয়ে দেয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গোৎসব’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি —
‘বর্ষে বর্ষে এস মাগো খাও লুচি পাঁটা
ছোলা কচু ঘেচু যা যোটে কপালে
যে হল দেশের দশা, নাই বড় সে ভরসা
আসবে যাবে খাবে নেবে, সম্বৎসর কালে
তুমি খাও কলামুলো, তোমার সন্তানগুলো
মারিতেছে ব্র্যান্ডিপানি, মুর্গী পালে পালে।’
শেয়ার করুন :