৭৭ বর্ষী কন্নড় কথাসাহিত্যিক,সমাজকর্মী,আইনজীবী শ্রীমতী বানু মুস্তাক তাঁর ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পগুচ্ছের জন্য ,যা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন শ্রীমতী দীপা ভাস্তি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুকার প্রাইজ পেয়েছেন যা দ্বিগ্বিজয়ী,যুগান্তকারী সাফল্য।বুকার প্রাইজে সবচেয়ে বয়স্কা,এই প্রথম কন্নড় ভাষার বই বুকার প্রাইজ পাওয়া,বুকার প্রাইজের ইতিহাসে প্রথম গল্পগুচ্ছের পুরস্কার এমন অনেক অসামান্য অনন্য কৃতিত্বের অধিকারিণী শ্রীমতী বানু মুস্তাক।
কর্ণাটকের হাসান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মজলিম সমাজের রীতি ৮বছর বয়স হয়ে গেলে বিয়ে দিতে হয় ,কিন্তু এই নিম্নবিত্ত পরিবারে বানু মুস্তাকের বাবা এই মেয়েকে সেই অনিশ্চিয়তা,অল্প বয়সে নিজের অমতে বিয়ে হওয়ার যন্ত্রণা আর গ্লানি থেকে অন্য আলোর দিকে নিয়ে যেতে কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।যেখানে কন্নড় আর ইংরেজি ভাষা শিখবেন।সম্ভবত ঐদিন আবার জন্ম হয়েছিল এই দীপ্তিময়ীর।
কন্নড় ভাষার শেখার কয়েক মাসের মধ্যে কবিতা লিখেছিলেন আর স্নাতক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির খবর শুনে আত্মীয় পরিজনরা ওঁর বাবাকে বলেছিল এই মেয়ের জন্য সমাজে তোমার নাক কাটা যাবে।
বানু মুস্তাকের গল্পের সূত্রর গভীরে তাঁর আইনজীবী কর্মজীবন আর সমাজকর্মী জীবনের প্রত্যক্ষ্য অভিজ্ঞতা,বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলন যা প্রতিবাদের সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত,যেখানে সামাজিক গোঁড়ামির প্রতিবাদ,পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধাচরণ,গার্হস্থ্য হিংসা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবাদ তাঁর লেখায়,গল্পে উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন :
প্রথম গল্প ‘শায়েস্তা মহলের পাথর’।নামকরণের শ্লেষ উল্লেখযোগ্য কারণ মনে পড়ে তাজমহল স্মৃতিসৌধ।শায়েস্তার স্বামীর ছদ্ম প্রণয়ভাষ আর শায়েস্তা মারা যাওয়ার পরেই আবার বিয়ে করার ভণ্ডামি।’অগ্নিবর্ষা’ আর ‘কালো গোখরো’,অগ্নিবর্ষা গল্পে অশুভ রূপকদের কথা বলে,সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।’কালো গোখরো’ তে মুত্তাওয়ালির (ওয়াকফ- প্রধান)বৌয়ের সন্তাননিরোধক অপারেশনে করার ইচ্ছাপ্রকাশ।এমন মর্মস্পর্শী ১২টি গল্পগুচ্ছ হার্ট ল্যাম্প।
ভালোবেসে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে এসে শুনলেন এইসব লেখালেখি চলবেনা ,বোরখা পরতে হবে,ঘরের কাজ করতে হবে । ২৯ বছর বয়সে এই অসহনীয় বন্দিদশা সহ্য করতে না পেরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই জ্বালার সময় স্বামী পায়ে ছেলেকে রেখে মিনতি করে আমাদের ছেড়ে যেও না।এর পর আর ফায়ার তাকাননি বানু।পেয়েছেন কর্ণাটক সাহিত্য পুরস্কার,দানা পুরস্কার।১৯৯০ থেকে ২০২৩ এই ৩৩ বছর ধরে বানু লিখেছেন সেইসব অচেনা অজানা লাঞ্ছিত,দুঃসহ দুরবস্থায় পড়া সে দক্ষিণ ভারতে নিপীড়িত মুসলিম মেয়েদের কথা।
ওয়েব সিরিজের গল্প নয়, সত্যি ঘটনা যে এই বানু মুস্তাক যখন লঙ্কেশ পত্রিকায় কাজ করতেন (মনে পড়ছে ?গৌরী লঙ্কেশ?)তখন তাঁকে ছুরি মেরে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তাতে ভীত হননি এই অগ্নিকন্যা।তাঁর লক্ষ্য ছিল এইসব পিছিয়ে পড়া অত্যাচারিত মেয়েদের যুদ্ধের কথা বলতে,তাঁর ‘কালকেউটে’ গল্পের আমিনার কথা যার শরীর ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছে একটার পর একটা সন্তান জন্ম দিতে ,শেষে একক দুর্দমনীয় সাহসী সিদ্ধান্তে বাড়িতে থেকে একা বেরিয়ে ব্লক হাসপাতালে যায় টিউবেকটমি অপারেশন করাতে কারণ সে মনে করেছিল এই জীবন আমার,তাই এই শরীরের অধিকারও আমার।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বানু বলেছেন,’আমার্ গল্পগুলি সেই মেয়েদের নিয়ে যাদের ধর্ম,সমাজ,রাজনীতি প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবি করে আর অমানুষিক নৃশংস অত্যাচার করে চলে সম্পূর্ণ পরাধীন করে রেখে।’
১২টি ছোট গল্পের সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’এ লিঙ্গবৈষম্য,গোঁড়া /অন্ধ বিশ্বাস আর সামাজিক চাহিদা আর নিপীড়িত অসহায় মুসলিম মেয়েদের জীবন সংগ্রামের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে।বানু মুস্তাক আজীবন বিশ্বাস করেছেন এইসব দলিত ও মুসলিম মেয়েদের সংগ্রামের পাশে তাঁকে দাঁড়াতে হবে,এদের যুদ্ধগুলি সাধারণের চোখে মামুলি হলেও তাদের যুদ্ধগুলি সামান্য নয়।
৭৭ বছরের এই অনুপমা দীপ্তিময়ী বানু মুস্তাক শুধু সাহিত্যজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুকার প্রাইজই পেলেন না তিনি হয়ে উঠলেন নিরন্তর সংগ্রাম আর যুদ্ধজয়ের নাম।
শেয়ার করুন :