বিশ্বজয়ী বিদ্যুৎশিখা -

ছবি- আইসিসিক্রিকেট ডট কম

বিশ্বজয়ী বিদ্যুৎশিখা 

নারীশক্তির,নারী ক্ষমতায়নের জয়।

“আমি নারী বলে আমাকে ভয় করো না? বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন।”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দয়া করে আজকের এই মেয়েদের বিশ্বকাপ জেতা যা আগের ৩ বার ফাইনালে উঠেও অধরা ছিল সেই কাঙ্খিত জয় অর্জন করল যাতে আপামর ভারত তথা বিশ্বের সব ভারতীয়দের জয়োল্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন না।

আজকের এই জয় ভারতের সবক্ষেত্রে প্রত্যেকটি মেয়ের জয়, নারীশক্তির,নারী ক্ষমতায়নের জয়।যে ভারতে ক্রিকেট বলতে শুধু পুরুষদের ক্রিকেট নিয়ে প্রবল উচ্ছ্বাস আর মাতামাতি তার বিপ্রতীপে এই জয় ডায়না এডুলজি , শান্তা রঙ্গস্বামী, ঝুলন গোস্বামী,মিতালী রাজের অসাধারণ দুর্দান্ত নৈপুণ্যের ও জয়।

ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে,প্রথম টেস্ট ১৯৭৬।আজ তাঁদেরও জয়।

এই ক্রিকেট টিমের প্লেয়ার ক্রান্তি গৌড় যেখানে থাকেন সেখান থেকে কাছের রেল স্টেশন ৪০ কিলোমিটার দূরে।শেফালী ভার্মা যেখানে বড় হয়েছেন সেখানকার মুখিয়ারা মেয়েদের ক্রিকেট খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায়  শেফালীকে ছেলেদের মতো চুল কেটে তবে নিজের নারীসত্তা লুকিয়ে ক্রিকেট খেলতে হয়েছে।দীপ্তি শর্মার বাবাকে দীপ্তির দাদা বলেছিল দুটো বছর দাও ওকে,আমি দায়িত্ব নিচ্ছি ,নইলে ও অন্য চাকরি খুঁজবে।আজকের এই জয়ের পর এমন প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক মেয়ে ক্রিকেটকে তাদের ধ্যান জ্ঞান করে খেলবে এবং এটুকু আশা করাই যায় তাদের বাবা মায়েরা সেক্ষেত্রে তাদের স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না, এটা সেই জয়।

কিন্তু এর সঙ্গে বিজিত সাউথ আফ্রিকার ক্যাপ্টেন লরা উলভার্টকে অজস্র অভিনন্দন,কুর্নিশ ব্যক টু ব্যাক দুর্দান্ত সেঞ্চুরির জন্য যা আর একটু হলেই মানে অমনজিৎ কৌর ৩ বারের চেষ্টায় ( ওই ক্যাচ ফেললে ওখানে স্টিভ ওয়া থাকলে বলতেন ওয়ার্ল্ড কাপটাই ফেলে দিলে) ক্যাচ না ধরলে অন্য বিষাদসিন্ধু পোস্ট লিখতে হতো।আর হেরে যাওয়ার পর কি শান্ত,মার্জিত,অভিজাত ব্যক্তিত্বের মাধুর্য।

হ্যাঁ এর আগে আন্ডার নাইন্টিন ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ এই শেফালী ভার্মার ক্যাপ্টেন্সিতে আমরা জিতেছি সেটাও কম গৌরবের নয় কিন্তু এই জয় সব কিছু ছাপিয়ে গেছে।

ভারতীয় মহিলাদের ক্রিকেট দলের ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জয় শুধু এক ক্রীড়া সাফল্য নয়, এটি ভারতের সামাজিক মানচিত্রে এক গভীর প্রতিধ্বনি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেখানে আজও নারীকে “দ্বিতীয় সারির” নাগরিক হিসেবে দেখা হয়, সেখানে মেয়েদের হাতে ট্রফি উঠেছে এক প্রতীকী প্রতিবাদের মতো।

এই জয় আমাদের দেখিয়েছে, প্রতিভা ও পরিশ্রমের কোনও লিঙ্গ নেই। মাঠে যে দক্ষতা, মনোবল ও কৌশলের প্রকাশ ঘটেছে, তা ভারতের প্রতিটি গ্রামের মেয়ে, প্রতিটি পরিবারের কন্যাকে সাহস জুগিয়েছে নিজের স্বপ্নকে নিজের হাতে গড়তে। এক সময় যে খেলার মাঠ ছিল কেবল পুরুষদের দখলে, সেখানে আজ নারীরা নিজের অধিকার আদায় করে নিয়েছে।

ভারতের প্রাক্তন মহিলা অধিনায়ক ডায়না এডুলজি বলেছেন,’আজ সত্যিই এক লাল অক্ষরের দিন। আজ আমি এক গর্বিত নারী ক্রিকেটার। গত পঞ্চাশ বছরের সব পরিশ্রম আজ ফল দিয়েছে।’

সচিন তেন্ডুলকর বলেছেন,’১৯৮৩ সালে ভারতীয় পুরুষ দলের জয় এক প্রজন্মকে বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। আজ আমাদের মহিলা দলও সেই রকম এক অনন্য ইতিহাস তৈরি করেছে।’

বিরাট কোহলি বলেছেন,’আমাদের মেয়েরা ইতিহাস তৈরি করেছে, একজন ভারতীয় হিসেবে এর চেয়ে গর্বিত মুহূর্ত আর কিছু হতে পারে না… এই জয় দেশের অসংখ্য মেয়েকে খেলাধুলায় আসতে অনুপ্রাণিত করবে। জয় হিন্দ।’

এই জয়ের গুরুত্ব আরও গভীর কারণ এটি সমাজের মনস্তত্ত্বকে নাড়া দেয়। যে দেশে বহু কিশোরী আজও নিজের স্বপ্নকে পরিবারের অনুমতির অপেক্ষায় স্থগিত রাখে, সেখানে মহিলাদের ক্রিকেট দলের এই সাফল্য যেন এক উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভ। এটি প্রমাণ করে মেয়েরা কেবল বাড়ির সীমায় আটকে নেই, জাতির গৌরবের মঞ্চেও তাঁর অবদান সমানভাবে মূল্যবান।

মনে রাখতে হবে ঐদিন  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেনস টি টোয়েন্টি যে খেলায় হারলে সিরিজ হেরে যেত সেই খেলা হটস্টারে দেখেছেন ১৮.২ কোটি মানুষ আর এই মেয়েদের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল দেখেছে ৩২.৮ কোটি মানুষ।পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এটা মেয়েদের বিশাল বড় জয়।এই বিশ্বজয়ী টিমে একজন বাঙালি বাঘিনী রিচা ঘোষ দুর্দান্ত দুর্নিবার দুর্ধর্ষ খেলেছে তাই এই জয় বড় মধুর।

জয় হিন্দ। জয় ভারত।জয় মেয়েদের ক্রিকেট।

ও আমার দেশের মাটি,ও আমার দেশের মেয়েরা,তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *