সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
খাস্তা শব্দটা খাবারের দিকে গেলে -সে এক ব্যাপার।খাস্তা কচুরি -নিমকি-লুচি।খাস্তা গজা।মুচমুচে একটা খাদ্য।সেকালের বাঙালি খাস্তা কচুরির খুব ভক্ত ছিল।শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তখন কাশীপুর উদ্যান বাটিতে।গিরিশচন্দ্র এসেছেন।বরাহনগর বাজারে বিখ্যাত ফাগুর দোকান।গিরিশচন্দ্রের জন্য খাস্তা কচুরি আনিয়েছেন।তিনি ঠাকুরের সামনে বসে একের পর এক খেয়ে চলেছেন।কোনো হিসেবে নেই।বেপরোয়া মানুষ।বিরাট শরীর।ঠাকুরের খুব আনন্দ।গিরিশ তাঁর ভীষণ প্রিয় সন্তান।ঠাকুর এক ভক্তকে বলছেন,’গিরিশকে বলে দে ,অনেক গুলো কচুরি খেয়ে ফেলেছে -আজ যেন বাড়ি গিয়ে আর কিছু না খায়।’ খাদ্যের মধ্যেও কিছু খাদ্য আছে -রজো শূলি।পেটে গিয়ে জমিদারি হাঁক ডাক ছাড়ে।যেমন- ঘি চপচপে পোলাও।একালের মানুষের সহ্য হবে না।ক্ষীর,রাবড়ি ভয়ের জিনিস।পায়েসও কিছু কম যায়না।মোহনভোগ তো হারিয়েই গেছে।এখন তালগোল পাকানো ড্যালা ড্যালা হালুয়া।ছেলেবেলায় যখন প্রকৃত পোস্ত পাওয়া যেত,সেই সময় পোস্ত দিয়ে হে-রে-রে-রে করে এক থালা ভাত মেরে দেওয়া যেত ;যেন পাতে ডাকাত পড়েছে।
জীবন থেকে জীবন হারিয়ে গেছে।বেঁচে থাকার ভীষণ কষ্ট।কটা টাকা রোজগারের জন্য জীবনের সব সুখ বিসর্জন।কে কোথায় থাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না।বাড়ি আছে ,লোক নেই।ভোঁভাঁ।বাড়িগুলো সব আলমারির মতো।এ পাল্লা খুললে -মিত্তির।ও পাল্লা খুললে বোস।ভেতরটা সব এক রকম।একটুখানি বসা,দু চার পা হাঁটা,একফালি শোয়া,প্রায় অদৃশ্য এক চিলতে বারান্দা.একটা ফুলগাছের টব-বাগানের উপহাস।খাটো রান্নাঘর।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যা হয় টুকটাক।একপাশে একটা মর্গ।চাপা ভাপা শব্দ -ফ্রিজ।দু-দরজা।একটাকে বলা হয় গভীর ঠান্ডার এলাকা।এই মর্গ থেকে বেরোবে খাদ্যের অতীত।পোস্ট- মর্টেম হবে পরিবার পরিজনের দাঁতে।টাটকা কিছু চেও না,সভ্যরা তোমাকে অসভ্য ভাববে।’চাউ’ কি জানেনা-হাউ ফানি।ও কি অসভ্য উচ্চারণ কাকাবাবু -মাগি নয় ম্যাগি।পুনডুলস নয় নুডলস।সুফি নুডলস শোনেন নি। লোকটা কি বীভৎস রকমের প্রাচীন।কালো গরুর ক্ষীর ক্ষীর দুধের স্মৃতিচারণ করছেন।
‘তোমার এই অ্যান্টিক কাকাবাবুটি কবে যথাস্থানে ফিরবেন ?’
‘কেন কাবেরী?’
‘সর্ষের তেল মেখে বাথরুমে স্নান করে টাইলসগুলোর অবস্থা কি করেছেন ! মনে হচ্ছে গোয়াল ঘর !’
‘সর্ষের তেল পেলেন কোথায় ! ও তেলের সঙ্গে তো আমাদের সম্পর্ক নেই।’
‘সঙ্গের ওই নীল ব্যাগটায় এইটিনথ সেঞ্চুরির মাল পত্তর আছে।পান সাজার সরঞ্জাম,দোক্তা,সর্ষের তেল,নারকোল তেল ,বিটনুন।খড়ম।’
‘খড়ম ? খড়ম দিয়ে কি করবেন?’
‘গুরুদেবের কাঠ পাদুকা।স্নানের পর বারান্দায় ফুলগাছের তবে ওপর সাজিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চন্ডীপাঠ করে শোনান। মনস্ট্রাস,হরিবল।ফুলগাছটা নেতিয়ে গেল।পানের পিকে দামি বেসিনটা শেষ। এরপর লোকের কাছে মুখ দেখাব কি করে। রাস্তার দিকের বারান্দায় লাল গামছা আর বারো হাত থান ধুতি সপাটে ঝুলছে।আবার বলেন কি সত্যনারায়ণ পুজো করবেন।অসহ্য ,অসহ্য।কাঁটালি কোলা চটকান সিন্নি। বাবারে,একি নরক যন্ত্রণা।তুমি বরং ভুলিয়ে ভালিয়ে তোমার কালীঘাটের পিসিমার কাছে রেখে এসো।শ্যাওলা ধরা উঠোন।পাতকো। নোনা ধরা দেওয়াল,গোবর গোবর গন্ধ।বাথরুমের টিনের দরজা ঢ্যাঁস করে খোলে। এরা কোনোদিন মানুষ হবে না।আদিগঙ্গা,কচুরিপানা।’
‘তোমার আইডিয়াটা মন্দ নয়।মা কালীর লোভ দেখাই।’
‘আর কিছুদিন থাকলেই আমাদের নাম খাস্তা।’
নাম খাস্তা।খাস্তা কচুরি নয়,খাস্তা নাম।অনেক সময় পুরোনো বই পোকায় কেটে খাস্তা করে দেয়।খাস্তা নিমকি এই হালকেতার আলমারি নিবাসে চলবে না।কার্পেটে চুরচুর চূড়মুড় পড়বে।চিজ পাফ চিৎ হয়ে শুয়ে খেতে হবে।সোফার আপহোলস্ট্রি নষ্ট হয়ে যাবে।হাঁটি হাঁটি পা পা সভ্যতা এগোচ্ছে।বুড়োরা সব আরো বুড়ো হয়ে যাবে।ধৈর্য ধরে থাকতে হয়-কবে খাট খালি হয়।শ্রাদ্ধ একটা করতেই হয়।একবারই একটু কষ্ট।সে তো দাঁত তুলতেও কষ্ট।তারপর যাও না,সিঙ্গাপুরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এস।বিজ্ঞান ভূত প্রেত বিশ্বাস করে না।ভদ্দর লোকের ছেলে মেয়ে ভূত হতে যাবেন কেন?পরলোকে ফাসক্লাস থাকবেন।সেপারেট রুম,অ্যাটাচড বাথ।জানলার বাইরে উদ্যানে অপ্সরারা পালা করে নেচে যাচ্ছে।
‘কাকাবাবু কালীঘাটে পিসিমার কাছে কিছুদিন থাকবেন ?’
‘অক্সফোর্ড থেকে ঘুরে আসি।সংস্কৃত পড়াতে হবে সায়েবদের।যাবার আগে তোমার কেমন আছ দেখে গেলাম।খুব খারাপ আছ বাবা।জীবনটাকে খাস্তা করে ফেলেছ।’
শেয়ার করুন :