কাঁসর -

অলংকরণ -নির্মলেন্দু মন্ডল

কাঁসর

… শুনলাম কমপ্লেক্সের পুজোর কাঁসরটা নাকি পাওয়া যাচ্ছে না ?…

হর্ষ দত্ত

ঠট্যাং  ঠট্যাং  ঠট্যাং ।ঠাঁই নানা,ঠাঁই নানা,ঠাঁই নানা,ঠট্যাং  ঠট্যাং  ঠট্যাং।এর হাতে ,ওর হাতে ঘুরছে কাঁসর।যে যেমন ভাবে পারছে ,বাজাচ্ছে।যে কোনও পুজোয় বাজনা বাজার একটা রীতি।আবহমান ঐতিহ্য।মন্ত্রোচ্চারণ পর্বে,আরতির অপূর্ব মুহূর্তগুলোতে,ভোগ নিবেদনে,প্রসাদ বিতরণে, বিসর্জনে। সমগ্র পুজো হয়ে ওঠে শব্দময়।ঘন্টা ,শঙ্খ,কাঁসর,ঝাঁজর,ঢাক,ঢোল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র তালে-বেতালে পুজোর গাম্ভীর্য নষ্ট করে দেয় কিনা,সে বিতর্ক পরে।শব্দময় উৎসব তীর্থস্থান থেকে মন্দির,মন্দির থেকে রাজপথ,রাজপথ থেকে অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে।কোনও বাড়িতে অবশ্য লক্ষী পুজো করা হয় নিঃশব্দে,নীরবে।মা লক্ষীর বাহন শব্দ পছন্দ করেন না।দেবতোষ নিজে অবশ্য আওয়াজ শূন্য পুজো স্বচক্ষে দেখেনি।এই সব বাদ্যযন্ত্রের পাশে মাইক ও ডিজেকে যুক্ত করে না নিলে,অনেকে পুজোর আবহ অনুভব করতে পারে না।দেব-দেবীর অর্চনাকে প্রেক্ষাপটে রেখে ধ্বনি -প্রতিধ্বনির এই উল্লাস এখন সংস্কৃতির মর্যাদা পেয়েছে।

ওদের কমপ্লেক্সে আটটা ব্লক।এ থেকে এইচ।এক একটা ব্লকের কার পার্কিং পুজো বা অনুষ্ঠানের জন্য খালি করতে হয়।কে কমিউনিটি -হলটা আছে তার আয়তন ছোট।হলের মধ্যেই শরীর সচেতনরা একটা জিম কর্নার তৈরি করেছে।উপরন্তু ,অধ্যাপক নীরদ গুহ ঠাকুরতা মারা যাওয়ার পর, তাঁর স্ত্রী ছয় আলমারি বই সোসাইটিকে দেন করেছেন।বইভর্তি কাঠের আলমারিগুলোর ঠাইঁ হয়েছে কমিউনিটি হলে।একদিকে দেহচর্চা -অন্যদিকে মননচর্চা -দুটো মিলিয়ে হলটার স্যান্ডউইচ অবস্থা।ফলে এ-কার পার্কিংয়ে ইংরেজি নববর্ষ,বি-তে বাংলা নববর্ষ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী।সি-তে দুর্গা ও লক্ষী পুজো,ডি-পার্কিং খালি করতে হয় কালীপুজো উপলক্ষে।এখানেই অনুষ্ঠিত হয় সরস্বতী পুজো।বাঁ দিকের পংক্তি ই,এফ,জি,এইচ ব্লকে যথাক্রমে স্বাধীনতা দিবস,সোসাইটির প্রতিষ্ঠা দিবস,বাৎসরিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা শিবির এবং দরিদ্র নারায়ণ সেবা দিবস পালিত হয়।

সুবিধে-অসুবিধে মিলিয়ে পার্বণগুলো এখনো করা হচ্ছে।ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি।কমপ্লেক্স মেন্টেনেন্সের টাকায় আট-নটা  উৎসব সম্পন্ন হওয়া মুশকিল।ফলে আলাদা করে চাঁদা নিতেই হচ্ছে।তবে তার পরিমাণ সাধ্যের মধ্যেই রাখার চেষ্টা করা হয়।ফলে উষ্মা থাকলেও,তা আড়ালে রেখে সবাই অংশগ্রহণ করতে আসেন।খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে পুজো- পার্বণে।অন্যগুলোয় প্যাকেট।পুজোর বাসন কোসনও থাকে কমিউনিটি হলে।বড় টিনের বাক্সে তালা দিয়ে বাসন ও অন্যান্য উপকরণ রাখা আছে।পেতল,কাঁসা,তামা,কাঠ ও পাথরের তৈরি এই দৈব সম্পত্তি দেখাশোনার দায় বর্তেছে দেবতোষের ওপর।এমনিতে ও খুব সতর্ক ও দায়িত্ববান।

গত বছর দেবদেবীর সম্পদের রক্ষক ছিলেন বেণুগোপালবাবু। খুবই নির্বিরোধী ও অল্পকথার মানুষ।জানুয়ারি মাসে বোর্ড অফ ম্যানেজমেন্টের মিটিং যখন হল,বেণুগোপালবাবু তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে বাক্স দেখাশোনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অল্প পরিশ্রমের কাজ নিলেন।সভাপতি প্রদ্যুৎকৃষ্ণ রায় কোনও আপত্তি শুনলেন না,বাসনের ঢাউস বাক্সটা দেবতোষের কোর্টে ঠেলে দিলেন।অগত্যা ওকে ভার নিতেই হল।কিন্তু  একটা ভুল করে ফেলল দেবতোষ।বেণুগোপালবাবুকে দাঁড় করিয়ে বাক্সটার তালা খুলে কতগুলো ও কত রকমের বাসন আছে দেখে নিল না।চাবিটা সোজা পকেটে ঢুকিয়ে দেবতোষ অনিচ্ছাকে মুছে ফেলে বলেছিল,ঠিক আছে ।কাউকে না কাউকে ভার তো নিতেই হবে।

সরস্বতী পুজোর দিন,বাসন যা যা লাগবে বের করে দিল দেবতোষ।নিয়ে গেল সি-ব্লকের শ্যামলী আর রুচিরা।ওরা দু’জন প্রত্যেকটি পুজোয়,আয়োজনের বিভিন্ন কাজ নিজেরাই কাঁধে তুলে নেয়।এবারের প্রতিমা ভারী সুন্দর হয়েছে।ডাকের সাজ,শ্বেতশুভ্র প্রতিমার মুখ আধুনিক নয়,উনিশ শতকের অপূর্ব ছোঁয়া।টানা টানা চোখ,পান পাতার মতো মুখ,লাল টুকটুকে ঠোঁট।সারা কমপ্লেক্সে সরস্বতী প্রতিমার মাধুর্য নিয়ে সাড়া পড়ে গেছে।সোসাইটির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা,কিশোর-কিশোরীরা বাসন্তী রঙের জামা,শাড়ি পাঞ্জাবি পরে ডি-ব্লকের কার পার্কিংয়ে আসতে শুরু করেছে।কমললোচনা বিশালাক্ষীর অঞ্জলি সাড়ে বারোটায় শুরু,একটার মধ্যে শেষ।প্রতিবছরের মতো এবারেও মহিলাদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।যে-ব্লকগুলোতে প্রতিমা পুজো হয়,সেখানে প্যান্ডেল তৈরি করার জন্যে একদিন আগে পার্কিং খালি করে এখানে ওখানে গাড়ি সরাতে হয়।এই অসুবিধেটুকে ছাড়া আনন্দ-অনুষ্ঠান ভালভাবে উৎরে যায়।সকলের মনের মতো হবে এমন আশা অবশ্য আবাসন কমিটি করে না।

ঠাকুরমশাই ব্রজনাথ চক্রবর্তী ঠিক সময়ে পুজো শুরু করে দিয়েছেন।ওঁর হাতে হাতে উপকরণ জুগিয়ে দিচ্ছে শ্যামলী,রুচিরা আর তন্বী। ঝুড়িতে অঞ্জলীর ফুল-বেলপাতা গুছিয়ে রাখছে রোজি আর কস্তুরী নাম দুই কলেজ পড়ুয়া তরুণী।দেবতোষ এবং আরও কয়েকজন,খেতে বসার টেবিল-চেয়ার সাজানোর তদারকি করছিল।ওরা পরিষ্কার শুনতে পেল চক্রবর্তী ঠাকুরমশাই চেঁচিয়ে বলছেন,’এবার আরতি শুরু হবে।যাঁরা দেখবেন,আসুন।’ হাতের কাজটুকু শেষ করে দেবতোষ যাবে।হঠাৎ দেখল, রুচিরা প্রায় ছুটতে ছুটতে ওর কাছে এগিয়ে এল।বলল ,’দেবুদা কাঁসরটা হয়তো বাক্সতেই থেকে গেছে ।বের করা হয় নি।’দেবতোষ অবাক,’তখন শ্যামলী যে বলেছিল,সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে !”এখন তো শ্যামলী বলছে কাঁসর ছিল না….।ডোন্ট  ওরি।আমার কাছে একটা ছোট কাঁসর আছে।ওটা এক্ষুণি নিয়ে আসছি।…আপনি আপনার কাজ করুন।

লাস্ট ব্যাচে খেতে বসে কমিটির সদস্যরা টের পেল ,যে কাঁসরটা বেজেছে ,সেটা আদৌ আবাসনের সম্পত্তি নয়। তাহলে সেই গোলাকৃতি,ভারী,তীক্ষ্ণ আওয়াজে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো বাদ্যযন্ত্রটি কোথায় গেল? পুজো সাঙ্গ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি প্রশ্নটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে।দেবতোষ তৃপ্তি করে ভোগ প্রসাদ খেতে পারল না।ক্যাটারারের বসানো টেম্পোরারি বেসিনে হাত ধুতে ধুতে দেখল,পুজো প্যান্ডেলের সামনে ওর নেক্সট ডোর নেইবার চিত্ত দাশগুপ্ত এদিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।লোকটি ভয়ঙ্কর পাজি,মিথ্যেবাদী।অনেকদূর পর্যন্ত বদমায়েশি করতে পারে।সোসাইটিতে থাকার পক্ষে একেবারে অনুপযুক্ত।সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ জুতো রাখার র‍্যাক নিয়ে দেবতোষ আপত্তি করেছিল।দাশগুপ্ত প্রথমে শোনেন নি।অসভ্যের মতো দেবতোষের বাবা,মা আর বোনের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করেছে। ল্যান্ডিং এ জুতো রাখা যেন ফান্ডামেন্টাল রাইট -এই ইস্যুতে ওর বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিতেও ছাড়েনি।

কমপ্লেক্সের কোনও ব্লকেই সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ জুতো রেখে দেওয়ার জন্য সু বক্স বা র‍্যাক কেউ বসায়নি।বাহ্যিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে প্রত্যেকটা ব্লক সমতা রক্ষা করছে।ব্যক্তিগত অভিপ্রায় পূর্ণ করার তাগিদে কমন প্লেস ব্যবহারের নিয়ম তাদের আবাসনে নেই।এই বিষয়টাকে কমপ্লেক্স মেন্টেনেন্স কমিটিকে জানাতেই হল।তখন দেবতোষ কমিটির মেম্বার ছিল না।ওকে সেই সময় সবচেয়ে বেশি আশ্বস্ত করেছিল সেক্রেটারি সুভাষ ভট্টাচার্য।দেবতোষেরই  বয়েসী সুভাষ ভরসা দিয়ে বলেছিল,নিয়মকানুন তার নিজের জায়গায় থাকবে,সু স্ট্যান্ড ফ্ল্যাটের ভেতরে। বেশি থানা পুলিশ মামলা দেখালে ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে যেতে বলব।প্রায় প্রত্যেক আবাসনে কিংবা স্ট্যান্ড অ্যালোন ফ্ল্যাট বাড়িতে দাশগুপ্তের মতো দু’ এক পিস্ ত্যাঁদড় মাল থাকে।চিন্তা করিস না।একটা আর্জেন্ট মিটিং ডেকে,রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনের বাইরে বেরোনোর জন্য চিত্তবাবুর ফালতু স্পর্ধা ,কীভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয় আমি জানি।

সুভাষ ওর চেয়ার এতটুকু নড়ায়নি।ফলে চিত্ত দাশগুপ্ত জুতোর র‍্যাক সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে ঘরে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।কিন্তু আজ ওই হাসি অন্য ইঙ্গিত করছে- এই যে দেবতোষবাবু ,আমি জুতো ঘরে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম।সবচেয়ে বেশি পেছনে লেগেছিলেন আপনি।এবার ঠাকুরের বাসন চুরির  দায়ে আপনার মুখে সারা আবাসন জুতোর বাড়ি মারবে।কাঁসা -পাতলে কেজি এখন প্রায় পাঁচশো টাকা।দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য হিসেবে একটার পর একটা বাসন চুরি করে চোরাবাজারে বিক্রি করে দিন।পরের মাল ঝেড়ে দিয়ে যা পাবেন,তাই লাভ।কেমন লাগছে এখন?যতই খুঁজুন ,ওই কাঁসর বাক্সতে পাবেন না।হাওয়া হয়ে গেছে।

লোকটার বিশ্রী দৃষ্টি ও মিচকি হাসি অসহ্য ,অসহ্য !দেবতোষ মুখ ঘুরিয়ে নিল।ওর ভেতরে এক প্রবল আলোড়ন যেন শুরু হবে একটু পরেই।কমিটির অন্য কোনও সদস্য বসে হয়তো ওকে জিজ্ঞেস করতে পারেন ,শুনলাম কমপ্লেক্সের পুজোর কাঁসরটা নাকি পাওয়া যাচ্ছে না ?এই হয়েছে এক জ্বালা,দায়িত্ব বদল হলেই কোনও না কোনও অঘটন ঘটবেই।তাই না !দেবতোষ জানেনা এসব প্রশ্নের কী উত্তর হবে।কী হওয়া উচিত।সযত্নে রাখা ঠাকুরের বাসন হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়ার দায় ওর – দেবতোষ এই সত্যটি জানে।আগামীকাল প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে কাঁসরটা বাক্সে আছে কি নেই দেখতে পারলে ভাল হতো।চিত্তবাবুর মতো লোকেরা ওকে ছোট করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন।এতে টেনশন আরও বাড়বে।খুব দামি জিনিস নয় ,কিন্তু এই আবাসনের সেন্টিমেন্ট কাঁসরটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।কমিউনিটি হলের একটা চাবি থাকে প্রদ্যুৎবাবুর কাছে।আর একটা নবনির্বাচিত সেক্রেটারি মেঘনাদি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।চাবি চাইতে গেলে দু’জনের ভুরু কুঁচকে যাবে।আর কারণটা শুনলে প্রদ্যুৎকৃষ্ণ হতাশ গলায় বলবেন ,’আমি তোমায় ট্রাস্ট করি,দেবু।’ মেঘনাদি চোয়াল শক্ত করে জ্ঞান দেবেন,দেবতোষ,প্লিজ বি ডিউটিফুল ! জিনিসটা আবাসনের ,কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।’

এমন বেদনাহত বার্তা আর সাবধান বাণী যে শুনতে হবে এবং আরও কেউ কেউ নানা ধাঁচে বলবেন,তা দেবতোষ জানে।কেবল স্পষ্ট উত্তর ওর জানা নেই।নির্বিঘ্নে ঠাকুর বিসর্জনের তিন দিন পরে দেবতোষ সভাপতি ও সম্পাদিকাকে সরাসরি ফোন করে অনুরোধ করল,দয়া করে আপনারা দশ মিনিটের মধ্যে আসুন।আমি বাক্সটা খুলে একবার খুঁটিয়ে চেক করতে চাই।সরস্বতী পুজোয় ব্যবহৃত বাসন ও অন্যান্য জিনিসগুলো কাল শ্যামলী আমাকে মেজে ঘষে দিয়ে যাবে।বাক্সটা এখন অনেকটাই খালি।কাঁসরটা খুঁজতে সুবিধে হবে।ওর অনুরোধে রাজি হয়ে প্রদ্যোৎকৃষ্ণ ও মেঘনা এলেন ,দেখলেন,বিরস বদনে ফিরে গেলেন।বাক্সটায় কাঁসর নেই।খুঁজতে খুঁজতে দেবতোষ নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠছিল।তন্নতন্ন করে দেখেও কাঁসরটা পাওয়া গেল না।লজ্জিত,পরাজিত দেবতোষ তবু একবার শেষ চেষ্টা করবে।

শ্যামলী আর রুচিরা রবিবার সকালে কমিউনিটি হলে ব্যবহৃত বাসনগুলো দিতে এল।ওদেরও মুখ থমথমে।খোওয়া যাওয়া ঘটনার সঙ্গে ওদেরও নাম জড়িয়ে গেছে।খুব শান্ত স্বরে দেবতোষ জিজ্ঞেস করল,আচ্ছা শ্যামলী,পুজোর আগের দিন তুমি আর রুচিরা যখন বাসন নিয়ে গেলে,তখন কাঁসরটা সত্যিই কে ছিলনা ! তুমি ভালো করে ভেবে দেখ।…বলো…

রুচিরার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে শ্যামলী আহত মানুষের মতো উত্তর দিল,হয়তো এনেছিলাম।কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না।পুজোর দিন থেকেই ভেবে মরছি,দেবুদা।এক একবার মনে হচ্ছে চন্দন কাঠ আর কাঁসর বাজানোর কাষ্ঠদন্ডটা পুষ্পপাত্রের ওপরে রেখেছিলাম।পিলসুজ আর পঞ্চপ্রদীপ একটা বারকোশের ওপর শোয়ানো ছিল।জিনিসপত্র গুলো ওখান থেকে নিয়ে গিয়ে কোথায় রেখেছিলে ?দেবতোষের গলার স্বর খুব করুণ শোনাল।মান সম্মান নিয়ে অনেকে টানাটানি…করছে…

হ্যাঁ,তা তো করবেই,রুচিরা বলল,হারিয়ে গেল,না কি কেউ চুরি করল !আমিও বিভ্রান্ত।একটু থিম শ্যামলীর হয়ে রুচিরা উত্তর দিল,প্রতিবারের মতো বাসনগুলো প্রথমে প্যান্ডেলে,প্রতিমার কাছাকাছি থাকে।তারপর আমি ও শ্যামলীদি ভাগাভাগি করে বাড়িতে পরিষ্কার করতে নিয়ে যাই।অতগুলো বাসন একজনের পক্ষে মেজে চকচকে করা তো সম্ভব নয়।

নিশ্চয়ই। ঠিকই বলেছ।দেবতোষ একটু ভেবে খুব দরকারি কথার মতো জিজ্ঞেস করল ,এখন সব  দেখে শুনে,মিলিয়ে নিয়ে এসেছো তো !

ওরে বাব্বা,কাঁসর কাণ্ডের পর থেকেই আমরা মরমে মোর আছি।যেকটা বাসন ও অন্য জিনিসপত্র নিয়ে গেছিলাম,সব ঠিকঠাক এনেছি।

ভেরি গুড।আচ্ছা,আমাকে কে যেন বলেছিল, কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আসার পর অনেকেই ডাকের সাজের অনবদ্য মূর্তি দেখতে এসেছিল।খবরটা কি ঠিক?

এবারে উত্তর দিল শ্যামলী,এমন উদ্দীপনা আমি কোনও বছর দেখিনি,দেবুদা।ছোট ছেলেমেয়েরা তো ছিলই,ওদেরই পুজো।বয়স্করাও এসেছিলেন।

বয়স্কদের মধ্যে কারা ?নাম মনে আছে?যেন একটু আসার আলো দেখা যাচ্ছে, এমনভাবে দেবতোষ জানতে চাইল।

ওই সময়ে সবাই একটা না একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত,ওই ব্যস্ততার মধ্যে নির্দিষ্ট কারও নাম মনে নেই।তবে একটা বিরক্তিকর মুহূর্তের কথা মনে পড়ছে।…আপনার প্রতিবেশী চিত্তবাবু প্রতিমার কাছে এগিয়ে বসে হাত বাড়িয়ে পরখ করছিলেন,মা সরস্বতীর ডাকের সাজ আসল শোলা দিয়ে তৈরি নাকি সাদা আর্টপেপার।আমার ভারী রাগ হয়ে গেছিল।এক নম্বর বদমাইশ।পুজোর স্টেজে জুতো পরে উঠেছিলেন।দু নম্বর,শোলা আসল নাকি নকল তা যাচাই করতে ওঁকে কে বলেছে !আমি বিরক্তি দেখাতে কী একটা বলে,যেখানে বাসনগুলো রাখা ছিল,সেদিকে সরে গেছিলেন,এইটুকু মনে আছে।তখন কমিটির কেউ একজন আমাকে ডাকছিলেন।

চুপ করে সব শুনে দেবতোষ জোরে শ্বাস ফেলে দৃঢ় গলায় বলল,কাঁসর আমি নিজের টাকায় কিনে কম্পেন্সেট করে দেব।কিন্তু আবাসনের কাঁসরটা যে ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে যায়নি,সেই সত্যটা বের করে ছাড়ব। ছাড়বই।

রুচিরা ও শ্যামলী সভয়ে দেখল দেবুদার চোখে আগুন জ্বলছে।প্রতিহিংসার আগুন নয়,দুর্নীতি প্রতিরোধের আগুন।

সময় নিজের মতো চলতে চলতে দুর্গাপুজোর সামনে এসে যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়াল।গতকাল মহালয়া শেষ হয়েছে।কাঁসর হারানো বা চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা ফিকে হয়ে গেছে।প্রত্যেকটি ব্লকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল,’নতুন কাঁসর কিনে এনে,কমিটি সদস্য দেবতোষ বসু আবাসনের পুজো – পার্বণের জন্য উৎসর্গ করেছেন’।তবু চিত্ত দাশগুপ্তের মতো সংকীর্ণ মনের তথাকথিত ভদ্রলোক, এখনও বাতাসে ভাসিয়ে রেখেছে একটি বাক্য,’আহা, স্মৃতিবিজড়িত কাঁসরটা কোথায় গেল !’

ওদের আবাসনে প্রত্যেক বছর কমিটি বদলায়,ঢাকিদেরও বদল হয়।প্রত্যেক বছর একই ঢাকিদের বাজনদার হিসেবে ডাকা হয় না। পুজো সংক্রান্ত একটা মিটিং এ দেবতোষ সেক্রেটারি মেঘনাদিকে নিজের থেকেই বলল,এবারে ঢাকি ভাড়া করার কাজটা আমাকে দেবেন? অরুনাংশুর করার কথা।তবে ওর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি ভার নিলে ওর আপত্তি নেই।হাত তুলে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিল অরুনাংশু।কমিটি মেম্বারেরা কেউ আপত্তি করেনি। পঞ্চমীর দিন শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর থেকে,দেবতোষ আবাসনের নিয়মভেঙ্গে যে বাজনদার দের নিয়ে এল,তারাই এসেছিল গতবছর।কালাচাঁদ সর্দার ও তার তিন সঙ্গী।দুটো ঢাক,একটা ঢোল ও একটা কাঁসর।ঢাকিওয়ালাদের ভিড় আর বাজনার কানফাটা শব্দের মধ্যে,দেবতোষ ওদের দেখতে পেয়েছিল।কৈশোর উত্তীর্ণ কাঁসর বাদকের হাতে অন্যদের চেয়ে বড় ও গমগমে বাদ্যযন্ত্রটা দেখেই দেবতোষ ওদের ভাড়া করে নিয়ে এসেছে।আবাসনে ঢোকার আগে,প্রদ্যুৎকৃষ্ণকে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে,দাদা আমি নিয়ম ভাঙলাম।মাপ করে দেবেন।কিন্তু কথা দিচ্ছি,আমাদের কাঁসরটা উদ্ধার হবেই।মায়ের ইচ্ছায় কীভাবে হবে স্বচক্ষে দেখতে পাবেন।

ষষ্ঠীর বোধনে আবাসনের সবাই আসতে পারে না।তবে মিসেসকে নিয়ে চিত্তবাবু এসেছিলেন।একটুপরে দুজনে হঠাৎ উধাও।খেয়াল করল অরুনাংশু।দুর্গা দুর্গতিনাশিনীর আহ্বান লগ্নে পুরোহিত ইঙ্গিত দিতেই কালাচাঁদের ঢাক বেজে উঠল।প্রত্যাশিত শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে গেল সারা আবাসনে।কাঁসর বাদক ছেলেটি মনে হয় নড়বড়ে টাইপের।খুব অলস হাতে কাঁধের ঝোলা থেকে বের করল কাঁসরটা।বাজাতে শুরু করল।কমিটির সদস্যরা চমকে উঠতেই দেবতোষ চেঁচিয়ে বলল.আরও চমক বাকি আছে।

আগমনীর পুজো শেষ হতেই পুরো কমিটি কালাচাঁদকে ঘিরে ফেলল।ভয়ার্ত কালাচাঁদ বলল,গেল বছর আমরা যখন সদর দিয়ে রাস্তায় বেইরেছি,হাঁটতেছি তখন এখেনের এক বাবু কাঁসরটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,এইটা তোমরা লিয়ে যাও।আমার ঘরে পইড়ে আছে।তোমরা বাজাবেক।তা আমি নিয়ে নিনু।আমরা গরিব মানুষ…মেঘনাদি ওকে আশ্বস্ত করল,ঠিক আছে,ঠিক আছে।আমরা একটা নতুন কাঁসর তোমাদের দেব।পুরোনোটা ফেরত দিয়ে যেও।

সবাইকে হতবাক করে দিয়ে প্রদ্যুৎকৃষ্ণ ঘোষণা করলেন,হঠাৎই দেবুর পরম মিত্র চিত্ত দাশগুপ্ত আজ সকালের ট্রেনে হায়দ্রাবাদ বেড়াতে চলে গেছেন।কাকভোরে ওর হোয়াটস্যাপ মেসেজ পেয়েছি। 

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *