ধনু দ্য ডন -

ছবি- শুভেন্দু সরকার

ধনু দ্য ডন

ধনু বাবু ম্যাচের আগে রাতে এমন কিছু দেখতেন, যা পরের দিন ফলে যেত।

সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়

– গেলো, গেলো, গেলো !

– ও কত্তা, কিছু দ্যাখলেন নাকি ?

– কে রে তুই হতছাড়া ?

–  আমি কানাই ।

– এত রাতে তুই এখানে কী করছিস ?

– বেরিয়ে ছিলাম চুরি করতে, কিন্তু আজ রেতে ঠিক মন লাগলনি। তাই ভাবলাম, আপনি তো জেগেই থাকবেন, যাই আপনার সঙ্গে একটু গল্প করে আসি।

– তা এসে কী দেখলি ?

– দ্যাখলাম, এক ফালি বাঁকা চাঁদের আলো যে ভাবে রাস্তার উপর এসে পড়ে, ঠিক তেমনি, দক্ষিণের জানলার ভাঙা খড়খড়ি দিয়ে রাস্তার আলো আপনার মুখের উপর পড়ছে। আর আপনি ঘুমোচ্ছেন। ভাবলাম আপনার বুঝি শরীর খারাপ হল নাকি। কারণ, রেতে তো আপনি ঘুমিয়ে পড়েন না। তাই একটু দ্যাওয়ালে ঠেঁস দিয়া বসলাম। ভাবলাম যদি মনোজ ডাক্তারকে ডাকতে হয়। তা কত্তা, কাল তো ফাইনাল, তা আপনি কী দেখলেন ?

– কানাইয়ের কথা উত্তর না দিয়ে, খানিকক্ষণ নিজের মনেই ভাবতে লাগলেন ধনু বাবু ওরফে ধনঞ্জয় কর্মকার। তারপর কানাইকে অর্ডার করলেন, এসেছিস যখন, যা রান্নাঘরে গিয়ে দু’কাপ চা করে নিয়ে আয়। আবার দেখিস, কাপ গুলো নিজের পকেটে পুরো নিস না।

– ছ্যা কী বলেন কত্তা, আপনার বাড়িতে আমি চুরি করতে পারি । তা কত্তা আপনার বাড়ির রান্নাঘরটা কোন দিকে ?

– খুঁজে দেখ, কোনও একটা ঘরে হবে, উত্তর দেন ধনু বাবু ।

গোপীডোবা । চার কিলোমিটার মধ্যেই শেষ আমাদের গ্রাম। শরৎ এলে রং খেলে গোপীডোবার। বর্ষা ফুরোলে ফুলিও শান্ত হয়ে যায়। তার চরেই মাথা চাড়া দেয় কাশের বন। শ্যাপলা উঁকি মারে টলটলে জলের মধ্যে থেকে। গত বিশ বছর ধরে গোপীডোবায় এক অবাক কাণ্ড হচ্ছে। মার্চ মাস থেকে যা শুরু হয়, শেষ হয় মহালয়ার দিন। সকাল থেকেই আজ আমাদের গাঁয়ে উৎসব। কারণ, প্রতিবারের মতো এবারও মহালয়ার বিকেলে আমাদের ইস্কুল মাঠে ফুটবলের ফাইনাল।

তারাসুন্দরী চ্যালেঞ্জ কাপ। না, এর মধ্যে কোনও স্মৃতি এখনও নেই। নবতীপর তারাসুন্দরী সংসারের মাঝমাঠে এখনও সবাইকে ড্রিবল করে চলেছেন। ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয় তাঁর গোবরজল দিয়ে শুদ্ধিকরণের কাজ। তারপর আমাদের চাকর সতীশকে নিয়ে গোয়ালে আমাদের দুই গরু সুন্দর ও সুন্দরীর সংসারের কাজ। বেলা বাড়লে নিজের মনেই বাড়ির বাগানে ঘুরে আমার ঠাকুমার জন্য ফুল তুলে আনেন। বিকেল হলে বেরিয়ে পড়েন পাড়া ঘুরতে।

তারকেশ্বর মুখুজ্জ্যে মারা যাওয়ার আগে নিজের বোনের নামে গাঁয়ের ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম রেখে গিয়েছেন। যেখানে নিয়ম একটাই, জিতেছো খুব ভাল, ট্রফি হাতে নিয়েছো, ব্যস ওইটুকু !পরের দিন আবার ট্রফি তারাসুন্দরীকেই ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। ওই ট্রফি গোবরজলে শুদ্ধি করে তারাসুন্দরী আবার নিজের সিন্দুকে তুলে রাখবেন।

আমরা খেলাবো, খেলব না। এটাই ছিল জামরুলতলা স্পোর্টিং ক্লাবের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট তারকেশ্বরের নিদান। তাই এতদিন মাঠে চুন দেওয়া থেকে জল বওয়া – এটাই ছিল আমাদের কাজ। তবে এবার সেই সিদ্ধান্ত বদলেছে। আর বদলেছেন ধনু বাবুই। ছেলেরা কেন খেলবে না ? এই প্রশ্নটাই বৈঠকে সবার সামনে রেখেছিলেন তিনি। প্রথমে আমার বাবা, যিনি ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট, তিনি একটু গাইগুঁই করেছিলেন। কিন্তু আমাদের ইস্কুলের হেডস্যর রামকরি বাবু এবং থানা দারোগা ভবতোষ বাবুর পাল্টা কাউন্টার অ্যাটাকে বৈঠক জিতে নেয় বিরোধী পক্ষ।

কিন্তু সকাল থেকেই আমাদের টেনশনে বুক ফেটে যাচ্ছে। কারণ, অভিষেকেই আমরা যে ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছি। এই প্রথম তারাসুন্দরী চ্যালেঞ্জের ফাইনাল খেলছি আমরা। কোথায় আনন্দ ? সকাল থেকে আমাদের দুই হাফ ব্যাক হাবুল আর কেষ্টার জ্বর। ফরোয়ার্ড অমল বীজগণিত ভুলে যাচ্ছে। গোলকিপার তারকের ইতিমধ্যেই চারবার আসা যাওয়া হয়ে গিয়েছে। আর এ সবের মধ্যে দক্ষিণ দিকের বার পোস্টের তলায় গুম মেরে বসে আছেন ধনু বাবু।

বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য।

গোপীডোবার মুখুজ্জ্যেদের এটাই ইতিহাস। তারসঙ্গে তারাময় সংসার। আমার ঠাকুরদা তারকেশ্বর। আমার ঠাকুমা তারারানি আর আমাদের সবার পিসিমা তারাসুন্দরী। যাঁরা নিজেরাই এক একটা ইউনিভার্স। দুই তারা ছোট থেকেই সই। শশুরবাড়ি থেকে শেষবার অষ্টমঙ্গলার দিনেই এসেছিলেন তারাসুন্দরী। তারপর আর ফেরেননি। সেই থেকে তিনিই এ বাড়ির লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স।

তারকেশ্বর ছিলেন এই গ্রামের প্রথম আইএ পাস। আর ছিলেন মোহনবাগান অন্ত প্রাণ। রোজ সকালে স্টিম ইঞ্জিন চেপে সাহেবদের কোম্পানিতে কলম পিষতে যেতেন। আর মোহনবাগানের খেলা থাকলে ময়দানে ছাতা খুলে সেলিব্রেট করতেন। ফেরার সময় ঢুঁ মারতেন খালাসিটোলায়। কারণ, জিতলেও পান, আবার হারলেও পান।

একবার আমি পিসি ঠাকুমাকে জিগেস করেছিলাম – আচ্ছা পিসি ঠাকুমা ঠাকুরদা কি মদ খান ? তাতে পিসি ঠাকুমা উত্তর দিয়েছিলেন, না ওষুধ মনে করে খান। এই উত্তরের যে ঠিক কি অর্থ হতে পারে, তা আমি তখন আর বুঝতে পারিনি। যাই হোক এই সংসারে আমার বাবাই বড়। অমলকান্তি এই গ্রামের প্রথম সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। গ্রামের ইস্কুলেই অঙ্কের মাস্টারমশাই। বড় ক্লাসে ওঠার পর সকালে বাবা, দুপুরে মাস্টারমশাই আবার বিকেলের পর থেকে বাবা, এটাই এখন তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। দুই তারার মাঝে উইথড্রয়াল মিডফিল্ডার হিসাবে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা অলকা।

আমার মেজো কাকা কৃষি বিজ্ঞানি। একসময় জার্মানি গিয়েছিলেন গবেষণা করতে। সেখানে গিয়ে ক্যাথলিন, যিনি এখন কমলা, তাঁকে বিয়ে করে বসেন। সেই খবর শুনে আমার ঠাকুরদা আমার মেজো কাকা অম্লানকান্তিকে ত্যাজপুত্র করেছিলেন। ঠাকুরদা বলেছিলেন, বুড়োর বিয়ে আমরা মানছি না, ও অফসাইডে গোল করেছে। যাইহোক, জয় তারা করে আমার মেজো কাকা আবার আমাদের সংসারেই ফিরে এসেছেন। এখন তিনি সদা ব্যস্ত তাঁর জৈবিক চাষ নিয়ে। আর ক্যাথলিন ওরফে কমলা গ্রামের মেয়েদের স্কুলের শিক্ষিকা। সেখানে পড়ে আমার বোন তিন্নি।

আমার বাকি দুই কাকা সজল ও অরূপকান্তি ব্যস্ত থাকেন মরশুমী কাজে। এর মধ্যে আমার ছোটকাকা অরূপকান্তির মধ্যে চুনী গোস্বামীর ছায়া দেখেছিলেন আমার ঠাকুরদা। কিন্তু ওটা শুধু উনিই দেখতে পেয়েছিলেন। আর গড়ের মাঠে গিয়ে বার দুয়েক চুনী গোস্বামীকে দেখে ফিরেছিলেন আমার কাকা। তাঁর যাবতীয় টোকা ঠাকুরদার তৈরি জামরুলতলা স্পোর্টিং ক্লাবেই। তাঁর কোচিংয়েই আমাদের ফাইনালে ওঠা। চার ফুটবলারের অসুস্থতার বিভ্রান্তিতে আজ অরূপকান্তিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে দেখতাম এক ভদ্রলোকের আনা গোনা। প্রায় ছ ফিটের উপর লম্বা। সাহেবদের মতো গায়ের রং। উত্তমকুমারের মতো হাসি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ধুতির উপর হাওয়াই শার্ট। ইতিহাসের পাতায় আঁকা আলেকজান্ডারের মতো নাক, আর চোখে গ্রেগরি পেগের মতো রিমলেস চশমা। যাওয়ার আগে আমার মায়ের কাছে একটাই আবদার থাকত…

– বউমা একটা পান।

ঠাকুমাকে জিগেস করতাম, কে গো উনি ?

– উনি ধনঞ্জয় কর্মকার। ওই যে গ্রামের পূর্ব দিকের বড় বাড়ি সেই বাড়িতেই ধনু থাকে।

বাবা আর মেজো কাকা দেখতাম তাঁকে ডাকতেন ধনু দা বলে। সেজো কাকা ডাকতেন শুধু ধনু বলে। আর ছোটো কাককে বলতে শুনতাম, ধনু কাকা। তাই একবার আমি ওনাকেই জিগেস করেছিলাম, আচ্ছা আপনাকে আমি কি নামে ডাকব ?

– উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ধনু দ্য ডন। সেই থেকেই তিনি আমার কাছে ধনু দ্য ডন। ঠাকুমা বলতেন ধনু বাবুর মধ্যে নাকি এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। কী হবে, তা নাকি আগে থেকে আঁচ করতে পারতেন ধনু বাবু।

বছর পাঁচেক আগের কথা। তার কয়েক মাস পরেই তারকেশ্বরের শতবর্ষ। বাবা কাকাদের পরিকল্পনা তো আছে, আমি আর তিন্নি মিলে ঠাকুরদার জন্য স্পেশাল প্ল্যান করছি। কিন্তু এক শীতের দুপুরে হঠাৎ করেই নড়বড়ে নিরানব্বইয়ে নিজের উইকেট দিয়ে গেলেন আমার ঠাকুরদা। পরে তিন্নি আমায় বলেছিল, জানিস দাদাভাই আমি মনোজ ডাক্তারকে ধনু দ্য ডনের কানে বলতে শুনেছি।

– আমি জিগেস করলাম কি ?

– তিন্নি বললো, মনোজ ডাক্তার ধনু দ্য ডনকে জিগেস করছিলেন, ধনু বাবু আপনি কিছু কি দেখেছিলেন নাকি ? মনোজ ডাক্তারের এই প্রশ্নে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন ধনু বাবু।

এদিন তাই সকালে দক্ষিণ দিকের বার পোস্টের নিচে ধনু বাবুকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে আমার বুকটাও ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। তাহলে কী ধনু বাবু এমন কিছু দেখছেন, যার জন্য তাঁর এত উদ্বেগ। এই ভাবতে ভাবতেই আমি বাড়ি ফিরলাম।

মহিষপোঁতা বয়েজ।

যারা গত পাঁচ বছর তারাসুন্দরী চ্যালেঞ্জের চ্যাম্পিয়ন। এবারের ফাইনালে তারাই আমাদের প্রতিপক্ষ। জগাই-মাধাই আর দিনাই এই ত্রিফলাতেই কেউ খেয়েছে ১০ গোল, কেউ ১২ আবার কেউ ১৫। যেদিন ওদের খেলা থাকত, সেদিন আমি ওদের গোলকিপার সোনাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম কখনও বারের নিচে বসে গোপালভাঁড় পড়ছে। আবার কখনও বিলির বুট উলটে দেখছে। আর হাফটাইম হলে এক ঘটি জল খেয়ে উল্টো দিকের বার পোস্টের তলায় ঘুমিয়ে পড়ছে। আসলে মহিষপোঁতা এতটাই শক্তিশালী, যে সোনাইয়ের গোল খাওয়ার কোনও ভয় ছিল না।  শেষ বাঁশি বাজিয়ে রেফারি নস্কর বাবুর কাজ ছিল সোনাইকে ঘুম থেকে ডাকা।

আর আমরা…

যেদিন সিদ্ধান্ত হল আমরা মাঠে নামব, সেদিনই আমার সেজো কাকা সজলকান্তি হাত তুলে জানালেন, এবার ক্লাবের জার্সি আমি ডিজাইন করব। ছোট থেকেই সেজো সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজে হাত পাকিয়েছেন। হাইস্কুলের হরি স্যর বললেন, গ্লুকোজের দায়িত্ব আমার। বুট থেকে বল কে কি দেবে, তার তালিকা তৈরি হয়ে গেল। দল কী হবে, তা আর ঠিক হল না।

অবশেষে অনেক আলোচনার পর আমার ছোটকা তাঁর ফুটবল মস্তিস্ক দিয়ে একটা দল খাড়া করলেন। তাতে গোলকিপার তারক। যে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মুরগী পাহারা দেয়। যাতে ভাম বিড়াল এসে মুরগী থেকে না পারে। তাই আমার ছোট কাকার ধারণা ওর রিফ্লেক্স এই দলে সবচেয়ে ভাল। তাই অনেক কসরতের পর বল ধরার টেকনিকই এখন তারক ভাম বিড়ালকে আটকাতে কাজে লাগাচ্ছে।

চার ব্যাক মিন্টাই, কানাই, তোতন, তুতান। মাঝমাঠে আমার পাশে ঘণ্টা, ছোটকা, দই আর দোলন। কারণ, হাবুল আর কেষ্টা অসুস্থ। দুই ফরোয়ার্ড মাখন আর আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বয় অমল।

দুপুর থেকেই গুম মেরে আছে আকাশ। এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। খাওয়ার পর থেকে শরীরটা বেশ আনচান করছে। বিছানায় মন টিঁকছে না। গত কয়েক মাস ধরে কোচ ছোটকাকার অনুশাসনে আমরা খালি হাড়ভাঙা অনুশীলন করেছি। কিন্তু একটাও ম্যাচ খেলেনি। প্রত্যেক ম্যাচেই দেখেছি প্রতিপক্ষ মাঠে আসেনি। হয় তারা ঝড়ে আটকে গিয়েছে। আবার বাঁধ ভেঙে এমন জল ঢুকেছে, যে তাঁদের ফুটবল মাথায় উঠেছে। আর প্রতিবারেই দেখতাম ধনু দ্য ডন আমায় বলে যেতেন, কী ক্যাপ্টেন সব ঠিক আছে তো, এবার ফাইনালের জন্য তৈরি হও।

তাহলে কী সত্যিই ধনু বাবু ম্যাচের আগে রাতে এমন কিছু দেখতেন, যা পরের দিন ফলে যেত। তাহলে গত রাতে তিনি কী এমন কিছু দেখছেন, যার জন্য তিনি দক্ষিণ দিকের বার পোস্টের নিচে গুম মেরে বসেছিলেন। হাতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, ঘরে কিছুতেই মন টিঁকছে না। আর এটা এমন একটা কথা যে সাহস করে কাউকে বলতেও পারছি না। একবার ছাদে যাচ্ছি, একবার ঘরে ফিরছি। একটাও ম্যাচ খেলিনি, সেখান থেকে একবারে ফাইনাল। তাও আবার মহিষপোঁতার বিরুদ্ধে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি এই দলের অধিনায়ক। সবমিলিয়ে কেমন হব গুলিয়ে যাচ্ছে।

মেঘ কেটে রোদ উঠেছে।

আমরা মাঠে এসেছি। ফাইনালে আমাদের গায়ে উঠেছে উপরের দিকটা সবুজ-মেরুন, নিচের দিকটা লাল-হলুদ। তার উপর সাদা-কালো দিয়ে আমার সেজোর কাকার হাতের কলকার কাজ। সে এক বিচিত্র রং আমাদের সবার গায়ে। জার্সির নম্বর কোনটা ইংরেজি হরফে আবার কোনটা বাংলা হরফে। আমরাই বুঝতে পারছি না, কার গায়ে কত নম্বর জার্সি। গত কয়েকদিনে এই পৃথিবীতে যত রকমের রং হয়, সেই রঙের জার্সি গায়ে আমরা সাইড লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বলে একটাও শট মারিনি। মাইকে বারে বারে ঘোষণা হচ্ছে। মাঠে ভিড় জমছে। আর আমি খুঁজে যাচ্ছি ধনু দ্য ডনকে। হাতের নাগালে একবার পেলেই জিগেস করব, কাল রাতে আপনি কী দেখেছেন বলুন ?

ডায়াসে দেখলাম নতুন ধাক্কা পাড় ধুতিতে আমার বাবাকে। পাশের দুটি চেয়ার এখন ফাঁকা। ম্যাচ শেষের ঠিক ১৫ মিনিট আগে তাতে দুই তারার আর্বিভাব হবে। দু খিলি করে দোক্তা পান মুখে দিয়ে বাড়ি নারীশক্তিকে নিয়ে তাঁরা মাঠে আসবেন। কোনও শব্দ খরচ না করে পুরস্কার দিয়ে এবং সেই পুরস্কার কবের মধ্যে ফেরত দিতে হবে তা মনে করিয়ে দিয়ে আবার তাঁরা মাঠ ছাড়বেন।

ক্লাব প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়েই রেফারি নস্কর বাবু দুই দলের অধিনায়ককে মাঠে ডেকে নিলেন। টস হল। আমি হারলাম। মহিষপোঁতার অধিনায়ক ঝন্টা বলল, যে কোনও দিকেই তারা খেলতে রাজি। ৩০ মিনিটের ম্যাচ এখুনি শেষ হয়ে যাবে। তাই দিক নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। ঠিক হল, দক্ষিণদিকে আমরা থাকব। উত্তর দিকে ওরা থাকবে।

– আজ আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। মনে রাখবি এমনই এক লড়াই হয়েছিল ১৯১১ সালে। মনে রাখবি তোরা এটা ফুটবল নয়, মর্যাদার ম্যাচ। ছোট কাকার এই ভোকাল টনিক নিয়ে মাঠে নামল জামরুলতলা স্পোর্টিং ক্লাব। এদিনও দেখলাম বিপক্ষের গোলকিপার সোনাইয়ের হাতে হাঁদা-ভোঁদা আর বাটুল দ্য গ্রেট।

– দোলন আমায় জিগেস করল, হ্যাঁরে, ওদের গোলকিপার মাঠে বই নিয়ে এসেছে কেন ? ও কি বাড়িতে বই পড়ে না ? দোলনকে কোনও উত্তর না দিয়ে আমি সেন্টার করতে গেলাম। শুধু চোখের সামনে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে তিন ত্রাস জগাই-মাধাই আর দিনাই। নস্কর বাবুর বাঁশি, খেলা শুরু….

সত্যিই স্বাধীনতার যুদ্ধ !

প্রথম পাঁচ মিনিটেই ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল আমাদের প্রতিরোধ। বল ধরার টেকনিক ভুলে আমাদের গোলকিপার তারক আবার ভাম বিড়াল মোডে ফিরে গেল। দই আর দোলন হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল। অমল গেল প্রতিপক্ষের গোলকিপার সোনাইয়ের সঙ্গে বই পড়তে। আর আমরা, বাকিরা সবাই গোল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে জগাই-মাধাইয়ের তাণ্ডব সামাল দিচ্ছি। এর উপর আমার সেজো কাকার ডিজাইন করার খদ্দর কাপড়ের নতুন জার্সি। ভরা ভাদ্রের রোদে গায়ে ছিরবিড় করছে। নিট ফল হাফটাইমে মহিষপোঁতা এগিয়ে দু গোলে।

নস্কর বাবুর হাফটাইমের বাঁশিতে খানিক স্বস্তি। প্রথম ১৫ মিনিটেই রণক্লান্ত হয়ে আমরা মাঠ ছাড়লাম। দেখলাম আমাদের তেলে সান্তানা ছোট কাকা তাঁর সব কৌশল থেকেই ভঙ্গ দিয়েছেন। গ্লুকোজের জল বাড়িয়ে আমায় জিগেস করলেন, কী করা যায় বল তো ?

– উত্তর না দিয়ে গোটা মাঠে আমার চোখ তখনও একজনের আশায়। তাহলে কী সেই এই বিপদের আশঙ্কায় আজ মাঠে আসেননি। নাকি আমাদের আরও বিপদ রয়েছে। যা লজ্জায় পরিণত হতে চলেছে। হঠাৎ করে আমার চোখ গেল মাঠের ধারের চেয়ারের দিকে। দেখি পাশাপাশি বসে আছেন দুই মূর্তিমান। একজন আমাদের থানার দারোগা ভবতোষ সাঁপুই। তার পাশেই আমাদের গ্রামের একমাত্র চোর কানাই।

– সম্বিৎ ফিরে ছোট কাকাকে উত্তর দিতে যাব, দেখি আমাদের মাঝে হাজির সেই ছ ফিটের উচ্চতার ভদ্রলোক। আজও অমলীন তাঁর হাসি। রিমলেস চশমার ফাঁক থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, চালিয়ে যাও ক্যাপ্টেন। কোনও চিন্তা নেই। এই দেখ তোমার দুই ফুটবলারকে চাঙ্গা করে দিয়েছি। সকাল থেকে মনোজ ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে ওরা এখন ফিট।

পাশে তাকিয়ে দেখি জার্সি পরে রেডি হাবুল আর কেষ্ট। ছোট কাকা এগিয়ে গেলেন রেফারি নস্কর বাবুর দিকে। বললেন দুটি চেঞ্জ আছে। দই আর দোলন বাইরে। মাঠে হাবুল এবং কেষ্ট। মাঠে নামার আগে আমি বললাম, সোনাইকে ঘুমতে দেওয়া চলবে না। যে যেখান থেকে পারবি ওদের গোল লক্ষ্য করে শট মারবি। আজ আমরা সোনাইকে সেকেন্ড হাফে ঘুমতে দেব না। এমন জাগিয়ে রাখব, ব্যাটা টের পাবে। অমল কী বুঝল জানি না, জিগেস করল কত ডিগ্রিতে শট করব ? বলের গতিবেগ কত হবে ?

– ঘণ্টা শুধু উত্তর দিল, অমল দা তুমি খালি মারবে, বল নিজের মতো করে গতিবেগ বুঝে নেবে। তবুও আমার মনে খচখচানি কাটল না। বারবার প্রশ্ন উঠল, ধনু বাবু কী তাহলে সেকেন্ড হাফের কিছুই দেখেননি। কেন আমার দিকে তাকিয়ে তখন চোর কানাই হাসল ? হাবুল আর কেষ্টা নিয়ে ঠিক হাফটাইমের সময় কেন ধনু বাবু মাঠে ঢুকলেন।

শুধু মাঠে নামার আগে তারককে জিগেস করলাম, তোর বাড়িতে কটা ভাম বিড়াল আসে ? তারক বলল, একটা। তার আবার তাগড়াই চেহারা। আমি বললাম, ধর তোর বাড়িতে তিনটে ভাম বেড়াল এসেছে। তুই আটকাতে পারবি। এক ঢোঁকে গ্লুকোজের জল খেয়ে তারক বলল, বেশ পারব।

দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু…

ইতিমধ্যে ডায়াসে হাজির টুর্নামেন্টের প্রধান অতিথি তারাসুন্দরী এবং তাঁর কোম্পানি। সেন্টার হল। মিনিট কয়েক আমাদের দিকে বল এল না। আমি হাবুল, কেষ্টা আর মাখনকে চোখের ইশারায় দিনাইয়ের পায়ে পড়ে যেতে বললাম। ঘণ্টাকে ইশারা করলাম রেডি থাকার জন্য। এই প্রথম ম্যাচে আমরা প্রথমবার মহিষপোঁতা মাঝমাঠ পেরোলাম। পিছনে থেকে দেখলাম তুতান আর তোতনও উপরে উঠে এসেছে। মনে মনে ভাবলাম ধনু বাবু গতকাল রাতে আর যাই দেখুন, ফাইনালে মনে হয় এই দৃশ্য দেখেননি।

চাপে পড়ে গেল মহিষপোতা। ঘুম উড়ে গিয়েছে সোনাইয়ের। কখন ডান দিক, কখন বাঁ-দিক থেকে আমাদের আক্রমণ। এর মধ্যে ঘণ্টার ক্রশ থেকে মাখনের হেড বার উঁচিয়ে চলে গিয়েছে। এই করে সেকেন্ড হাফের সাত মিনিট চলে গিয়েছে। তখনও আমরা দু গোলে পিছিয়ে। আমাদের পায়ে পড়ে যাওয়া ফুটবলে জগাইদের ত্রাস শেষ।

এর মধ্যে ফাউল করে ফেলল মহিষপোঁতা। প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে আমরা ফ্রিকিক পেলাম। অমল বলল, আমি মারব। ঘণ্টা বলল, অমল দা এই সুযোগ, দেখিয়ে দাও তোমার পায়ে সিক্সটি ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে বল বাঁক খায়। ছ জনের প্রাচীর তৈরি করল মহিষপোঁতা। প্রতিপক্ষের বক্সের বাইরে আমরাও তৈরি। মাঠে চাপা উত্তেজনা। চারদিকে স্তব্ধতা। পিন পড়লেও শব্দ হবে। বেজে উঠল নস্কর বাবুর বাঁশি।

খানিকক্ষণের জন্য গোটা ইস্কুল মাঠ নিস্তব্ধ। হই হই চিৎকারে আকাশ চেরা আওয়াজ। ইতিহাস তৈরি করছে অমল। তার বাঁকানো শটে ব্যবধান কমালো জামরুলতলা। প্রতিপক্ষের জাল থেকে বল কুড়িয়ে নিয়ে এল মাখন। আর কী যেন কানে কানে বলে এল সোনাইকে ? ম্যাচ শেষে আমি মাখনকে জিগেস করেছিলাম, তুই তখন সোনাইকে কী বলছিলি ? মাখন বলল, আমি বললাম, শুধু হাঁদা-ভোঁদা পড়লে হবে, মাঝে মধ্যে তো রোভার্সের রয়ও পড়তে হবে। না হলে বলে বাঁক খাওয়া বুঝবে কী ভাবে ? আমি বললাম, বোঝ কাণ্ড !

মাঠে তখন উল্লাস চলছে। লোক সরাতে ভবতোষ দারোগা নিজেই মাঠে নামলেন। খানিকক্ষণ পর আবার শুরু হল খেলা। হাতে আর শেষ পাঁচ মিনিট। আর এই পাঁচ মিনিটে এক স্বপ্নের ফুটবল খেলল জামরুলতলা স্পোর্টিং ক্লাব। প্রতিপক্ষকে মাঝমাঠে আটকে দিয়ে আবার গোল অমলের। এবার হাবুলের থ্রু থেকে।

আর শেষ বাঁশি বাজার আগে ঘণ্টার কর্নার থেকে মাখনের বাইসাইকেল কিক। ডায়াসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুই তারাকে বুকে আগলে পুজোর ঢাকের বোলে নাচছেন আমার অঙ্কের মাস্টারমশাই বাবা। মেজ কা তাঁর জমিতে হওয়া জৈবিক জলপাই হরির লুঠের মতো দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। ডিগবাজি খাচ্ছেন আমার আরও দুই কাকা।

খেলা শেষ।

আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ধনু দ্য ডন। বললেন, তুমি আমার মিথ ভাঙলে ক্যাপ্টেন। এবার থেকে আমি যা দেখব, সেটা যে মিলবে এমন নয়। আমি ভুল, তুমি ঠিক। তারাসুন্দরীর হাত থেকে প্রাইজ নিচ্ছে জামরুলতলার ফুটবলাররা। তারা জানে এই ট্রফি কাল সকাল নটার মধ্যে আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। মাঠেই ঘোষণা হয়ে আজ রাতে সবার বাড়িতে অরন্ধন। গ্রামের সবাই থাকবে জামরুলতলার ক্লাবের সামনে। পাঁটার মাংস আর ভাত। আর শেষ পাতে দুটি করে মুরারী ময়রার গরম রসগোল্লা।

– ঘোষক ধনু দ্য ডন।

শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *