সাবর্ণী দাস
রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ নিয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেই ছবিতে পোশাক পরিকল্পনা ছিল আমার। আলোচনা, মিটিং ইত্যাদি করার পর আমরা ঠিক করেছিলাম কিছু কিছু জায়গায় জামাকাপড় সংগ্রহের জন্য আমি আর ঋতু একসঙ্গে যাব, গিয়েওছিলাম। প্রায়ই মনে হত যে সময়টাকে ধরতে চাইছি সেটা করতে পারছি তো? কিছু জিনিস যেন মনে হচ্ছে এখনকার, কোথাও দেখেছি …।

আজকের লেখাটা এই বিষয়টা নিয়েই। ‘রেট্রো লুক’। সবাই জানি ফ্যাশন এমন একটা বিষয় যা ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে আসে। ধরা যাক ‘পোলকা ডট’-এর কথা, দিশি ভাষায় যাকে আমরা ববি প্রিন্ট বলি। বলা হয় মধ্যযুগে, ইউরোপে নাকি এই ডিজাইন প্রথম দেখা গিয়েছিল। সেই সময়কার ছবি তো পাওয়া দুষ্কর, নেই। তবে এই গোল গোল চিরন্তনীরা যুগে যুগে ফিরে ফিরে আসে। ৫০ দশকে মেয়েদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল এই ডিজাইন। ড্রেস, স্কার্ট, টপ, চুলের বো ইত্যাদি সর্বত্র এই পোলকা ডটের ছড়াছড়ি ছিল।
বাড়ির অন্দরসাজও হত এই পোলকা ডট দিয়ে। জানলা দরজার পরদা, কুশন কাভার সবই করা হত এই পোলকা ডটের প্রিন্ট দিয়ে। আমাদের দেশেও ছিল, তবে জনপ্রিয় হয় ১৯৭৩ সালে ববি সিনেমা আসার পর। ডিম্পল কাপাডিয়ার মিনি স্কার্টের উপর পোলকা ডটের নট বাঁধা টপ আপামর জনতার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। পোলকা ডটের নবিকরণ ঘটে। এখন তো আমজনতা পোলকা ডট কে ববি প্রিন্ট নামেই জানে।
আরও পড়ুন:
প্রসঙ্গত বলা যাক, বিশ্বনন্দিত ডিজাইনার সব্যসাচীর কথা। ওঁর ডিজাইন ভাবনা সম্পূর্ণ আমাদের ঐতিহ্যর উপরে গড়ে ওঠা। বিশেষ করে বাঙালিয়ানার যে ধারাবাহিকতা, সেটা উনি ওঁর পোশাক ভাবনায় সঞ্চারিত করেছিলেন।

একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন ১৯৫০-এর সময় থেকেই পোলকা ডট খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই সময়কার যে পোশাক ভাবনা ছিল, এই মেটেরিয়ালটি সেই ভাবনা অনুযায়ী ডিজাইন করা হত। অর্থাৎ স্কার্টের নকশা বা উপরের ব্লাউজটির কাট যুগোপযোগী করে তোলা হয়। এবার এই প্রিন্টটি যদি আমরা আজকের দিনে পরতে চাই তাহলে পোলকা ডটের প্রিন্টটিকে নিয়ে আমরা যে পোশাকটি বানাবো তা হবে এই সময়কার নকশা।স্কার্টের ঝুল কতটা উঠবে বা ব্লাউজের নেক লাইন আসলে কতটা নামবে তা নির্ধারণ করবে সময়!
সব্যসাচীও ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন তাঁর প্রথম ফ্যাশন শোতে বাংলার শাড়ি, লাল ফিতে দিয়ে তেল দেওয়া চুলে কলাবিনুনী এবং বড় মোটা ফ্রেমের চশমা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এই গ্রাম্য সাজকে কি কোনও ভাবে ফ্যাশন বলা যায়? যায়, গেলও তো। তাঁর এই প্রাসঙ্গিক ভাবনাটাই তো ওঁকে বহুদিন হল গ্লোবাল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক ডিজাইনরা আজ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন সৃষ্টি করছেন।
তাঁতের শাড়ি বিশেষ করে বাংলার তাঁতের বুনোট এখন খুবই জনপ্রিয়। সে ধনেখালির ডুরেই হোক কিংবা ঢাকাইয়ের জ্যামিতিক নকশা। কিন্তু সেগুলির পরার ধরনের দিকে একটু নজর করা যাক। মাছডুরের সেই ঐতিহ্যমন্ডিত শাড়ি হয়তো আজ কেউ পরছেন অফশোলডার ব্লাউজ দিয়ে। ঢাকাই নকশার ব্লাউজের সঙ্গে লেস লাগিয়ে প্রায় একশো বছর আগেকার কোনও জ্যাকেট ব্লাউজের আদলে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নকশা। কিন্তু টুইস্ট থাকছে নেকলাইনে। অতি গভীর সেই রেখা। তৈরী হচ্ছে সমসাময়িক কায়দায় পুরাতনী ব্লাউজ যা কোনও ঐতিহ্যমন্ডিত শাড়ির সঙ্গী হবে।
বছরের কয়েকটা দিন বাঙালি মেয়েদের শাড়ি পরাটা একেবারে একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে। পুজোর সময় তো পরতেই হয়। কিন্তু এই প্রজন্ম তা কীভাবে পরে তা আমরা দেখেছি। শাড়ি পরার মূল ফোকাস থাকে ব্লাউজ। শাড়ি একটা পছন্দমতো হবে, কিংবা মা-মাসির পুরনো কোনও শাড়িও হতে পারে কিন্তু ব্লাউজ হতে হবে এক্কেবারে সবার থেকে আলাদা। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক।

মেয়েরা যখন শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরতে শুরু করলেন তখন সেগুলি উর্দ্ধাঙ্গের প্রায় সবটাই ঢেকে থাকত। টার্টল নেক, ফুল স্লিভ – কোনও অংশ থেকেই ত্বকের প্রদর্শন হত না। আজও টার্টল নেক, পাফড ফুল স্লিভ ব্লাউজ শাড়ির সঙ্গে পরা ফ্যাশনেবল হয়েছে। কিন্তু তার ধরন ও কাট পালটেছে। সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে তার সঙ্গে শাড়িটা ঠিক কেমন ভাবে পরা হবে।
বাংলার তাঁতের শাড়ি যেমন তুমুল জনপ্রিয় ঠিক তেমনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শাড়ি, যেমন গুজরাতে ইন্ডিগো কিংবা রাজস্থানের লেহরিয়া অথবা ওড়িশার কোটপাড় বা অন্ধ্রের তেলিয়া ইত্যাদিরও দারুণ কদর। তবে তার পরার ধরণ, ব্লাউজ ও অ্যাকসেসরিজ সেখানে খুবই প্রাধান্য পাচ্ছে। এখানে অ্যাকসেসরিজের ভূমিকা যেহেতু খুবই মূখ্য তাই সেগুলি নিয়ে সামান্য হলেও কথা বলা যাক।
প্রথমেই আসি গয়নার প্রসঙ্গে। সোনার গয়না নিয়ে আলোচনার জায়গা এখানে নয়। যদিও এখনও অনেকেই শাড়ির সঙ্গে সোনার গয়না পরতে পছন্দ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রুপোর গয়না বেশ বহুদিন হলই দারুণ জনপ্রিয়। এর একটা বিকল্প ব্যবস্থাও হয়েছে। রুপো যেহেতু খুবই দামী হয়ে উঠেছে সেই কারণে দস্তার গয়নাকেও রুপোর বিকল্প হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া অন্যান্য ধাতু, পুঁতি, সুতো, ডোকর, কাপড়, দড়ি, পাট ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে অনেক ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে যা মেয়েরা আজকাল পরতে খুবই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ভালবাসেন।
এবার আসা যাক চশমায়। চশমা এবং সানগ্লাস এখন সাজের অন্যতম উপাদান। চোখের প্রয়োজনে হলে তো কথাই নেই, বিনা প্রয়েজনেও ফ্যাশনেবল চশমা এখন সাধারণ কথা। লেনন গ্লাসই হোক অথবা ক্যাটস আই, এখন তা ব্যাগ বা পকেটের অঙ্গ।

জুতোতেও এসেছে বিপ্লব। ফ্যাশনেবল মহিলারা শীতকালে শাড়ির সঙ্গে জ্যাকেট ও বুট বহুদিন ধরেই পরতেন। এবারে বিপ্লবটি এসেছে স্নিকার বা ট্রেনারের হাত ধরে। অত্যন্ত আরামদায়ক এই জুতোটা এতকাল স্পোর্টস ও ব্যায়ামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন তার মুক্তি ঘটেছে – সে এখন শাড়িরও সঙ্গী। একটা ছোট্ট তথ্য দিয়ে রাখি। লিখলে খুব একটা ভুল হবে না যে এই স্নিকারের জনপ্রিয়তা সাম্প্রতিক কালেই ঘটেছে। স্নিকার যে এক নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরেও বিচরণ করতে পারে তা বোধকরি আনন্দ আহুজা প্রথমে এদেশে বুঝিয়েছিলেন। ‘পজিটিভ নেগেটিভ’ স্টোরগুলি তাঁর, যেখানে বিভিন্ন রকমের এই জুতো পাওয়া যায়। যদিও তা আমাদের মতো মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু তথ্য হিসেবে আমাদের জানা দরকার যে কাস্টম মেড স্নিকার তিনিই এখানে শুরু করেন। নিজের বিয়ের জুতো হিসেবে তিনিই প্রথম স্নিকার পরেন। তাঁর অন্য একটি পরিচয় আছে – তিনি সোনম কাপুরের স্বামী।
এই পুজোতে টায়েড আপ ব্লাউজ, টাঙ্গাইল শাড়ি আর স্নিকার সাজে সজ্জিতাদের দেখে টিপস পেতে পারেন, নতুন সৃজনশীল ভাবনাও মাথায় আসতে পারে।
ঋতুপর্ণর কথা মনে পড়ে বার বার। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ান লুঙ্গিকে পরিধান করত, কিন্তু নিজের মতো করে। নৌকাডুবিতেই ঋতুর কথায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় পাঞ্জাবি বানাতে দিয়েছিলাম ঢাকাই শাড়ি কেটে। পরে সেই ফ্যাশন প্রায় সবাই নকল করেছিলেন। ফ্যাশন আসে, ফিরে ফিরে। নতুন হাওয়া, নতুন আনন্দ নিয়ে।
শেয়ার করুন :

 
                 দশ দ্রুমের পুজো
দশ দ্রুমের পুজো দুগ্গাপুজোর আশ্চর্য অজানা ইতিকথা
দুগ্গাপুজোর আশ্চর্য অজানা ইতিকথা



