পিয়া ঘোষ বন্দোপাধ্যায়
সেদিন যখন চাকরিটা গেল, তখন বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। এমনিই সংসারে হাড়ি চড়ে না, তার ওপর চাকরিটা নেই। মাকে কি বলবো ভেবে অস্থির হৃদয়ে বাড়ি ফিরলাম। প্রতিদিনের মতো মা এসে দরজা খুলল। বৃষ্টিতে আমার কান্না ভেজা চোখ আড়াল হল বটে। কিছু একটা করে নেওয়া যাবে কিন্তু মাকে এসব জানাবার দরকার নেই, হাবিজাবি ভাবনা যখন ঘিরে ধরছে। তখন হঠাৎ করেই মা বলে উঠল, ” ঠিক আছে। তুই তো ছাড়বিই বলছিলি, না হয় গেল ! কিছু একটা হয়ে যাবে। খেয়ে নে তো দেখি আগে।” চমকে উঠলাম ! মা- মানে মা জানল কি করে? না এ ঘটনা নতুন নয়। আপনাদেরও নিশ্চয়ই মায়ের সঙ্গে এমন না হলেও কিছু না কিছু চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা আছে। মা ঠিক সব জেনে যান, সব বুঝে যান। কিন্তু কি করে? আসলে মা কোনও শব্দ নয়, মা কোনও সম্পর্ক নয়। মা একটা পৃথিবী। আমাদের নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা ডাক। যে সব কিছু জানে। প্রচন্ড শরীর খারাপ হোক বা চরম আনন্দের মুহূর্ত আমরা আনমনেই মাকে ডেকে ফেলি। মা শুনছেন কি শুনছেন না, আমরা খবর রাখি না। এই ডাকেই যেন আমাদের হৃদয়ে শান্তি ছড়িয়ে যায়।
বলা হয় মায়ের জাত। হ্যাঁ একমাত্র মায়েরই একটা জাত হয়। সে গরীব বা বড়লোক নয়, সে দলিত বা উচ্চ বর্ণ নয়, সে কেবল মা। ওই যে মেয়েটা, যাকে রাতের অন্ধকারে পরিবারের অন্যরা গলা টিপে মেরে দিতে চেয়েছিল, কোনও এক মা সেই মেয়েকে বুকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আজও। আর সেই যে বাচ্চাটা, যার বাবা রোজ রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে অকারণে তাকে মারতে চায়, তখন ঠিক সেই মুহূর্তে, দশভূজার রূপ নেয় তার মা।
মায়ের জন্য কোনও আলাদা দিন হয় না। প্রতিটা দিনই তাঁর। কিন্তু গোটা বিশ্বে ১০ মে মাতৃদিবস পালন করা হয়। কিন্তু আলাদা করে এই দিন কেন এল? কবে থেকেই বা এই একটা বিশেষ দিন নির্ধারিত হল? এর পিঁছনেও রয়েছে এক মায়ের ভালবাসার গল্প। বিশ্ব মাতৃদিবস সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল আমেরিকাতে। আমেরিকার অ্যানা জার্ভিস নিজের মাকে খুবই ভালবাসতেন। নিজেও কখনও বিয়ে করেননি। তাই মায়ের মৃত্যুর পরই মাকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানাতে এই বিশেষ দিনটার প্রচলন শুরু হয়। তিনিই প্রথম ১৯০৫ সালে মাতৃদিবসকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য লড়াই শুরু করেন। শুরুর দিকে তাঁর প্রস্তাব খারিজ করে মার্কিন কংগ্রেস। কিন্তু শেষে জয় হয় জার্ভিসেরই। ঐ দিন গোটা বিশ্ব মাতৃদিবস পালন করে। এছাড়াও ১৯১৪ সালে ৯ মে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন একটি আইন পাশ করেন, তাতে বলা হয় মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মাতৃদিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই হিসেবে এই দিনটিতেও অনেক দেশ মাতৃদিবস পালন করে। গ্রিসে ২ মে , ব্রিটেনে মার্চ মাসের চতুর্থ রবিবারে মাতৃদিবস পালন করে। আসলে মায়ের জন্য তো সব দিনই ধার্য।
মা কখনও কবিতায় আসেন। আবার কখনও মহাভারতের পাতায় ঘুরে বেড়ান একের পর এক দুখিনী মা। কখনও ছেলে কর্ণর জন্য অসহায় হন কুন্তী।আবার অর্জুনের হার, মৃত্যুর কথা ভেবে শিউরে ওঠেন সেই মা কুন্তীই।শেষ শয্যায় ছেলে ভীষ্মর মুখে জল দিতে ছুটে আসেন মা গঙ্গা। আবার গান্ধারী পুত্র দুর্যোধনের প্রাণ বাঁচাতে খুলে ফেলেন চোখের বাঁধন। হিড়িম্বা রাক্ষসি হয়েও ছেলে ঘটোৎকচের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভাল করে খেয়াল করলে মনে হতেই পারে মহাভারত যেন শুধু মায়েদেরই গল্প বলে। ঠিক যেভাবে আমাদের হৃদয়ে গেঁথে যায় ম্যাক্সিম গোর্কির মা।যেখানে অশিক্ষিত মা নিলোভনা কিছু না বুঝে সন্তানস্নেহে পাভেল কে রক্ষা করবে বলে রুশ বিপ্লবের অংশীদার হয়।আবার সেই সব অগণিত মা যারা সারাটা জীবন থেকে গিয়েছেন অন্তরালে।
আমাদের দেশে এমন হাজার হাজার মা রয়েছেন যারা প্রতিদিন নিজে না খেয়ে, সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন।বাড়ির কাজ সামলে, যান দিনমজুরের কাজ করতে, যাতে তাঁর সন্তান থাকে দুধে-ভাতে। আর বর্তমান সময়ে তো আর এক মাকে আমরা চিনছি। যারা অতিমারিতেও কঠিন মুখে লড়াই করছেন।ঘরে নিজের সন্তানকে রেখে একের পর এক অতিমারিতে আক্রান্ত সন্তানকে বাঁচিয়ে তুলছেন ডাক্তার মা,নার্স মা।এই মায়েরা কেউ মুখে রা কাটেন না। তাঁরা সব কিছু কেবল সহ্য করেন,সন্তানসম রুগী আর ছেলে মেয়ের মঙ্গল কামনায়।
আর আমরা মাকে খুঁজে নিই কবিতায়। রবি ঠাকুরের কলমে মাকে ছোট বয়সে হারানোর যন্ত্রণা স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের মা রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে না থাকলেও খানিকটা ছিলেন তাঁর স্মৃতির মধ্যে৷ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, ‘‘মনে পড়ে বাড়ি-ভিতরের পাঁচিল-ঘেরা ছাদ৷ মা বসেছেন সন্ধেবেলায় মাদুর পেতে, তাঁর সঙ্গিনীরা চারদিকে ঘিরে গল্প করছে৷….এই সভায় আমি মাঝে মাঝে টাটকা পুঁথি পড়া বিদ্যের আমদানি করেছি….ঋজুপাঠ দ্বিতীয়ভাগ থেকে স্বয়ং বাল্মিকী রামায়ণের টুকরো আউড়ে দিয়েছি অনুস্বর-বিসর্গ-সুদ্ধ৷ মা জানতেন না তাঁর ছেলের উচ্চারণ কত খাঁটি, তবু তার বিদ্যের পাল্লা….তাঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে৷” রবীন্দ্রনাথ ‘বীরপুরুষ’-এ লিখছেন ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।” আবার কখনও নজরুলের কবিতায় যেখানেতে দেখি যাহা/মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,/মায়ের মতন এত/আদর সোহাগ সে তো/আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!’
শঙ্খ ঘোষের কলমে ধরা দিচ্ছেন মা। যমুনাবতী-তে কবি লিখছেন, “নিভন্ত এই চুল্লীতে মা, একটু আগুন দে, আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি, বাঁচার আনন্দে।”বাংলার পল্লীগ্রামের মায়ের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ সার্থক চলচ্চিত্রায়ণ পথের পাঁচালির সর্বজয়া।দারিদ্র্য, দুর্গার মৃত্যু, বাস্তুত্যাগ, স্বামীহীন হওয়ার পর পরিবর্তিত জীবনে ক্লিন্নতার সঙ্গে সংগ্রাম, অপুর সঙ্গে মানসিক বিচ্ছেদ, সর্বশেষ অসুস্থতা ও নৈঃসঙ্গ্যের মধ্য দিয়ে মৃত্যুতে মুক্তি। আবার মাদার ইন্ডিয়া ছবিতে মা গ্রামের মেয়ের আব্রু রক্ষার জন্য গুলি করে মারেন তার ডাকাত ছেলেকে।এও মাতৃত্বের আর এক রূপ।
মহাশ্বেতা দেবীর ‘স্তনদায়িনী’ গল্পের যশোদা এক আশ্চর্য মা যার স্তনদুগ্ধ খেয়ে নিজের আর অন্যের শিশুরা বড় হয়।এছাড়াও ওনার ‘হাজার চুরাশির মা’যেখানে মা সুজাতা তার নকশাল আন্দোলনে মৃত ছেলে ব্রতীর জন্য পথে নামেন।মানিক বন্দোপাধ্যায়ের যে কয়েকটি লেখা কালজয়ী বলে সমালোচকগণ দাবি করেন, সেগুলোর মধ্যে তাঁর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জননী’।শ্যামা নামে এক নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের বহুবিধ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে।সাহিত্য, সিনেমা, রামায়ণ মহাভারত হোক বা আজকের সিঙ্গল মাদার সুস্মিতা সেন কিম্বা নীনা গুপ্তা সকলের যেন একটাই জাত, মায়ের জাত।
বিপদে, আনন্দে, প্রেমের জয়ে, না পারার লজ্জায়, হেরে যাওয়ার চরম মুহূর্তে একটাই ডাক মা। দু’বছরের শিশু থেকে সকলের কাছেই মা সব থেকে বড় ভরসা। তাই যখন গোটা পৃথিবী এক দিকে হয়ে যায়, আর ছেলে বা মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে, সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে সে বা তারা যখন একেবারে এক প্রান্তে এসে ঠেকে, তখন অবচেতন মন একটাই গান গায়, ‘তুঝে সব হ্যায় পাতা, হ্যায় না মা? “
এ বছর একদিন আগে পরে ২৫শে বৈশাখ আর আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস,তাঁরই কবিতায়-‘মাকে আমার পড়ে না মনে,/শুধু কখন খেলতে গিয়ে/হঠাৎ অকারণে/একটা কী সুর গুনগুনিয়ে/কানে আমার বাজে,/মায়ের কথা মিলায় যেন/আমার খেলার মাঝে।/মা বুঝি গান গাইত, আমার/দোলনা ঠেলে ঠেলে;/মা গিয়েছে, যেতে যেতে/গানটি গেছে ফেলে।‘
শেয়ার করুন :