সুমন্ত্র মিত্র
আজকের দিনে অতিমারী আক্রান্ত বিদ্ধস্ত পৃথিবীতে যেখানে নিজের স্বার্থ ছাড়া বেশিরভাগ আমরা সব কিছুর সম্বন্ধে নির্লিপ্ত,নিস্পৃহ আর উদাসীন,সেখানে শুধু জন্মদিনের উৎসব পালনে ছুটি ছাড়া আমাদের রোজকার জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব আর সত্যিকারের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে?আজকের ইয়াং নেটিজেন যুবকদের প্রতি ওনার দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান কি আদৌ কোনও গুরুত্ব রাখে?কেন্দ্র রাজ্যের জন্মজয়ন্তী উদযাপনে টিভিতে বা রাস্তায় দেখা,আর একটা সরকারি ছুটির দিন ছাড়া কি আর কোনও তাৎপর্য বহনে করে ?শ্রুতিকটু হলেও সদাজাগ্রত নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক বুম নিয়ে পথচলতি জনসাধারণকে স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাসার উত্তরে নির্বোধ,মূর্খের বাইট নিয়ে বৈঠকখানায় হাসির তুফান তোলা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট আছে?সম্প্রতি আমেরিকার রাষ্ট্রদানব ডোনাল্ড ট্রাম্পের কুখ্যাত ‘ভিভেকামুন্ডন’ সোশ্যাল মিডিয়া আর সংবাদপত্রের হাসির খোরাক ছাড়া আর আসন্ন নির্বাচনের জন্য বাংলার মনীষীদের নিয়ে সর্বদলের ভাষণে ভদ্রলোক একটু জায়গা পাচ্ছেন এতে ওনার পুলকিত হওয়ার কারণ ছাড়া আর কিছু হয়েছে ?গত ১৫ /২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলার মনীষী,সংস্কৃতি নিয়ে নির্লজ্জ নিস্পৃহ উদাসীনতায় আমরা অভ্যস্থ।আত্মঘাতী বাঙালি এতে চূড়ান্ত আত্মপ্রসাদ লাভ করে দিব্যি আছে তাই ‘কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্ত করার এই ধান ভানতে শিবের গীতের দরকার নেই।কঠিন সহজ সত্য হল আজকের বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে,স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর কোনও টিআরপি নেই।
সত্যিই কি নেই?সামগ্রিকভাবে আপামর খেটে খাওয়া অতিমারী বিদ্ধস্ত জনসাধারণের বেশিরভাগ অংশের নিস্পৃহতা সত্বেও ভদ্রলোক সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষের জীবনে নানাভাবে প্রবল এবং প্রকান্ডরূপে উপস্থিত যেটা তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া আর টিআরপির আড়ালে।স্বামী বিবেকানন্দর জীবনী বিশেষজ্ঞ শংকর সম্প্রতি রোববার পত্রিকায় লিখছেন,’এদেশের ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ইদানিং ‘স্বনির্ভর ভারত সৃষ্টি’ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ অভিমত ঘেঁটে দেখছেন।’ বারবার কৃতকার্যে ব্যর্থ হওয়ার পর এখনও অসংখ্য,অগণিত অনেকে ওনার বাণী পড়ছেন যেখানে উনি বলছেন.’তোমার দ্বারা কিছুই অসম্ভব নয়।তুমি তখনই ব্যর্থ যখন সেই কাজে তুমি তোমার সর্বশক্তি ও সম্পূর্ণ মনোসংযোগ করতে পারছনা।বিশ্বাস,বিশ্বাস,বিশ্বাস,নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।লোকে যাই বলুক না কেন তাতে প্রভাবিত না হয়ে নিজের বিশ্বাস আর প্রত্যয়ে অটল থাকতে হবে।‘
অল্পেতে হাল ছেড়ে দেওয়া সকলকে দৃপ্ত কণ্ঠে কে বলতে পেরেছে ‘ওঠো,জাগো,লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না।’
তৎকালীন নারীজাতির প্রতি সমাজের নিষ্ঠূরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বলেছিলেন ‘মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে,তবে দেশের কল্যাণ,ভারতের কল্যাণ’ যা আজ এই ২১ শতকের ভারতবর্ষেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
অধুনা এই অতিমারীকে যারা ভাগ্য আর অদৃষ্টের দোষ দিচ্ছেন তারা কি জানেন উনি কতকাল আগে বলে গেছেন ‘সাধারণ মানুষ তাদের দুর্গতির জন্য ভাগ্যকে দায়ী করে আর শেষে ভগবান কে।ভাগ্য কী?কে ভাগ্য? আমরা আমাদের কর্মফলের জন্য দায়ী।আমরা আমাদের নিজের ভাগ্য গড়ি।’
এখানে এই করোনা আক্রান্ত পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৮৫৮ সালে কলকাতায় প্লেগের অতিমারীতে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও বিদ্ধস্তকালে স্বামী বিবেকানন্দ ‘প্লেগ ম্যানিফেস্টো’ ছাপিয়ে তার সহচরদের নিয়ে আর্তের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।সেই ম্যানিফেস্টোর কিছু সারাংশ;
‘কলকাতার ভাইয়েরা,
১) আপনি যখন খুশি হন তখন আমরা খুশি হই এবং আপনি যখন কষ্ট পান তখন আমরা কষ্ট পাই।অতএব, চরম প্রতিকূলতার এই দিনগুলিতে, আমরা আপনার কল্যাণ এবং আপনাকে রোগ থেকে রক্ষা করার একটি সহজ উপায় এবং মহামারীর আতঙ্কের জন্য প্রয়াস এবং অবিরাম প্রার্থনা করছি।
২. যদি সেই গুরুতর রোগ – যা উচ্চ ও নিম্ন, ধনী এবং গরিব উভয়ই এই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে – এই ভয়ে যদি সত্যই আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয় তবে আপনার সেবা ও নার্সিংয়ের সময় আমরা যদি ধ্বংস হয়ে যাই তবে আমরা নিজেকে ভাগ্যবান বলে বিবেচনা করব কারণ আপনি ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি।যে অন্যথায় – অহঙ্কার, কুসংস্কার বা অজ্ঞতার বাইরে চিন্তা করে – সে ইশ্বরকে আপত্তি করে এবং মহাপাপের প্রবণতা পোষণ করে। এটি সম্পর্কে সামান্য সন্দেহ নেই।
৩. আমরা আপনাকে বিনীতভাবে প্রার্থনা করি – অনুগ্রহপূর্বক ভয়ের কারণে দয়া করে আতঙ্কিত হন না। ইশ্বরের উপর নির্ভর করুন এবং শান্তভাবে সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম উপায় সন্ধান করার চেষ্টা করুন। অন্যথায়,যারা খুব কাজটি করছেন তাদের সাথে হাত মিলান।
৪) ভয় পাওয়ার কী আছে? প্লেগ সংঘটিত হওয়ার কারণে যে সন্ত্রাস মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করেছে তার বাস্তব ভিত্তি নেই।ইশ্বরের ইচ্ছার মাধ্যমে, প্লেগ যে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, তার কোনও কিছুই কলকাতায় ঘটেনি। সরকারী কর্তৃপক্ষও আমাদের বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে। তাহলে ভয় পাওয়ার কী আছে?
৫)আসুন,আমরা এই মিথ্যা ভয় ছেড়ে ইশ্বরের অসীম মমতায় বিশ্বাসী হই,আমাদের কোমর বেঁধে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করি।আসুন আমরা শুদ্ধ ও পরিষ্কার জীবনযাপন করি রোগ,মহামারী সম্পর্কিত ভয় ইত্যাদি তাঁর অনুগ্রহে বাতাসে বিলীন হয়ে যাবে।
জাপানের বিখ্যাত কবি ওকাকুরা ভারতবর্ষকে বুঝতে বিবেকানন্দের কাছে গেলে তিনি বলেছিলেন ‘এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই।এখানে সর্বস্ব ত্যাগ।রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে যান।তিনি জীবনের মধ্যে আছেন।’ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন,’ভারতকে যদি জানতে চান বিবেকানন্দকে জানুন।’
আজকের পৃথিবীতে স্বামী বিবেকানন্দের চেয়ে আর কেউ এত প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক?
শেয়ার করুন :