শান্তনু ঘোষ
আজ চলুন আপনাদের একটা অন্যরকম সফরে নিয়ে যাই।গ্রাম বাংলার এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসবের সফর করায়।
প্রথমেই বলি আমি একজন চাষী বাড়ির ছেলে তাই ছোটবেলা থেকেই একটা উৎসব কে গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে পালন হয়ে আসতে দেখেছি।
নবান্ন, নাম টা শুনেই বোঝা যায় ক্ষেতের/চাষের নতুন ধান বা চাল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে যে উৎসব পালিত হয় তার ই নাম নবান্ন।(নব – নতুন, অন্ন – খাবার)।মূলত যাদের জীবন ও জীবিকা কৃষি কেন্দ্রিক তারাই এই উৎসব টা নিষ্ঠা ভরে পালন করে থাকে।
একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হয়েছি তাই সেই ছোটবেলা থেকেই দেখতাম এই উৎসব এর প্রস্তুতি আগের দিন বিকেল বেলা থেকেই শুরু হয়ে যেত। একটা সময় ছিল যখন মাটির উঠান ছিল তখন কাজের জেঠিমা আগের দিন বিকেলে গোবর দিয়ে উঠান নিকিয়ে দিত( এখন সে মাটির উঠান আর নেই আপগ্রেড করে নিয়েছে নিজেকে,তারপর সন্ধ্যার দিকে মা শাক সবজি কাটতে বসত আর কাকিমা কে দেখতাম সিল নোড়া নিয়ে চাল বাটতে বসে যেতে(এখন যদিও এটাও আপগ্রেড হয়ে মিক্সি হয়েছে।
পরের দিন খুব সকাল সকাল মা কাকিমা রা উঠে পড়ে, রান্নার শাক সবজি ধুয়ে, স্নান সেরে সেদিনের পুজোর জোগাড় জাত করতে বসে যেত,তারপর একে একে পঞ্চদেবতা, মনসা,গ্রাম এর স্থানীয় ঠাকুর ধর্মরাজ এসব জায়গাই পুজোর রেকাবি দিয়ে আসতো, এরমধ্যে কাকিমা কে দেখতাম পুরোদস্তুর রান্নার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে।নতুন চালের ভাত,আলু ভাজা,বেগুন ভাজা,নারকেল ভাজা, বড়ি ভাজা,চাষের কলাই এর ডাল,মাছের মাথা দিয়ে ফুলকপির তরকারি, পালং আর লাউ শাক এর চচ্চড়ি, নিজেদের পুকুর এ ধরা মাছ এর সর্সে বাটা দিয়ে ঝাল,নিজেদেরই গাছের পাকা তেতুল দিয়ে মাছের টক, খেজুর গুড়ের পায়েস সঙ্গে পুও ভাজা(পুও ভাজা হলো কলাই এর ডাল বেঁটে চিনি দিয়ে মেখে ফুলুরির মত ডিপ ফ্রাই করা আর রসগোল্লা এই থাকতো মেনু তে।
আর দুপুরের এই খাবার এর আগে আর একটা রিচুয়াল হয় সেটা হচ্ছে চাল নবান্ন।
এই চাল নবান্ন র জন্যই আগের দিন চাল বেটে ফ্রিজে রাখা থাকতো আর সেটার সাথে পুজোর ফল,খেজুর গুড়, নারকেল কুড়ি,সামান্য আদা কুচি,সামান্য মুলো কুচি,কাচা দুধ,আর বিভিন্ন রকমের ফল কুচি দেওয়া হতো আর অবশ্যই পরিমাণ মতো চিনি,আর সমস্ত পুজো দেওয়া প্রাসাদের ফল মেশানো হতো।
এই প্রিপারেশন টা করার পর, সেই চাল নবান্নের প্রসাদ ছোট ছোট কলাপাতা করে কাক পক্ষীকে,গরুকে, তুলসী তলায়,আর ধানের মড়াই এ অর্পণ করা হয় তার পর আমরা যারা বাড়ির ছোটরা আছি তারা গুরুজন কে, আর যারা গত হয়েছেন তাদের ছবি তে প্রণাম করে এই চাল নবান্নের প্রসাদ খাই।
আর একটা জিনিস আমরা আমাদের এই উৎসবে তাদের কে আমন্ত্রণ জানাই এবং তাদের সাথে সেলিব্রেট করি যাদের ছাড়া আমাদের এই সোনার ফসল ঘরে তোলা সম্ভব ই নয়। যারা সারা বছর জমি তে কাজ করে এই সোনার ফসল ফলায়,তারা এবং তাদের পরিবারের এই বিশেষ দিনে আমন্ত্রণ থাকে।এটি অগ্রহায়ণ মাসের একটি উৎসব।
এখন ও একই রকম ভাবে বংশ পরম্পরায় এই উৎসব চলে আসছে।
ছবি:লেখক
শেয়ার করুন :