এই পৃথিবী শুধুই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর যুক্তিবাদের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু ঘটনা ছড়িয়ে আছে, যেগুলোর ব্যাখ্যা আজও রহস্যাবৃত, অন্ধকার আর প্রশ্নচিহ্নে ঘেরা। কোনোটা মৃত্যু আর আতঙ্কে মোড়া, কোনোটা শতাব্দীর পরও ধোঁয়াশা; এমনকি বিজ্ঞানও যেগুলোর যথার্থ জবাব দিতে ব্যর্থ।সাইবেরিয়ার বরফঢাকা ‘ডায়াটলভ পাস ট্র্যাজেডি’, রহস্যঘেরা ভুতুড়ে জাহাজ ‘এস এস ওউরাং মেদান, কিংবা রক্তস্নাত ইতিহাসে ভরা লন্ডনের ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ এমন প্রতিটি ঘটনার পেছনে যেন এক অদৃশ্য ছায়া কাজ করে চলেছে, যা ইতিহাসবিদ, তদন্তকারী আর ষড়যন্ত্রতত্ত্ববিদদের আজও ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।এই প্রবন্ধে আমরা এমনই কয়েকটি অমীমাংসিত রহস্যের দিকে তাকাব যা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে, শিহরণ জাগায়, আর উত্তরহীন প্রশ্নের ভেতর আমাদের ডুবিয়ে রাখে।

১)ডায়াটলভ পাস দুর্ঘটনা: এক অমীমাংসিত সাইবেরিয়ান রহস্য
১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাস। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের উরাল পর্বতমালার এক প্রত্যন্ত ও তুষারাবৃত অঞ্চলে ঘটে যায় এমন এক রহস্যময় দুর্ঘটনা, যা আজও ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সাধারণ মানুষের মনে ভয়ের ছায়া ফেলে রেখেছে। এই ঘটনাটি “ডায়াটলভ পাস ইনসিডেন্ট” নামে পরিচিত।
অভিযাত্রী দলের পরিচয়- ইগর ডায়াটলভ নামক এক অভিজ্ঞ উরাল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্রের নেতৃত্বে ৯ জন অভিযাত্রী (৭ পুরুষ, ২ নারী) তুষার পর্বতারোহণের জন্য যাত্রা করেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন দক্ষ স্কি অভিযাত্রী ও শিক্ষার্থী।
কী ঘটেছিল?
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ রাতে তাঁরা “খোলাত সাইকেল” নামে পরিচিত এক দুর্গম পার্বত্য এলাকায় তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রামে ছিলেন। কিন্তু পরে উদ্ধারকারীরা যে দৃশ্য পান তা ছিল ভয়ঙ্কর ও রহস্যে মোড়া-তাঁদের তাঁবুটি ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।বেশ কয়েকজন ছিলেন অর্ধনগ্ন ও খালি পায়ে, যদিও তাপমাত্রা ছিল -২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে।দুই অভিযাত্রীর মাথার খুলি ভাঙা, একজনের বুক থেঁতলানো, এবং এক নারীর জিহ্বা ও চোখ অনুপস্থিত ছিল।আশপাশে অসাধারণ কোনো লড়াই বা হাতাহাতির চিহ্ন ছিল না, কিন্তু মৃতদেহগুলো ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন দূরত্বে।
সরকারি তদন্ত ও বিভ্রান্তি
তৎকালীন সোভিয়েত সরকার ১৯৫৯ সালে একটি তদন্ত শুরু করে। যদিও তারা বলেছিল “অপরিকল্পিত প্রাকৃতিক শক্তির” কারণে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু কী সেই শক্তি তা স্পষ্ট করেনি।সম্ভাব্য ব্যাখ্যা গুলির মধ্যে রয়েছে: হিমবাহধ্বংস বা তুষারধস,ইনফ্রাসাউন্ড: কম ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ যা মানসিক বিভ্রান্তি ঘটাতে পারে।রেডিয়েশন: কিছু মৃতদেহে অস্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায়।
সোভিয়েত গোপন অস্ত্র পরীক্ষা-বহির্জাগতিক (UFO) কার্যকলাপ – স্থানীয় মানুষ ও গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, রাতে আকাশে উজ্জ্বল আলো দেখা গিয়েছিল তা আজও কী অমীমাংসিত? ২০১৯ সালে রাশিয়ার পক্ষ থেকে আবারও তদন্ত করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, যেখানে বলা হয় তুষারধসই প্রধান কারণ, তবে অনেক বিশেষজ্ঞ ও পরিবার তা মানেননি। ঘটনার বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন ছিল এবং কিছু নথি আজও সাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়।
ডায়াটলভ পাস দুর্ঘটনা ইতিহাসের এমন একটি ঘটনা, যেখানে ৯ জন তরুণ অভিযাত্রীর মৃত্যু রহস্য হয়ে রয়ে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও এই অজানা ঘটনার পেছনের সত্য উন্মোচন করা যায়নি। তাই এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং মানব ইতিহাসে এক চিরকালীন রহস্য।

২) টাওয়ার অফ লন্ডন :রহস্যমণ্ডিত এবং কুখ্যাত কারণ ১৪৭১ খ্রিস্টাব্দে ওয়েকফিল্ড টাওয়ারে ২১শে মে ১৪৭১ ষষ্ঠ হেনরির হত্যা, ১৫শ শতাব্দীতে পঞ্চম এডওয়ার্ড ও তাঁর ভাইয়ের রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, এখানে টর্চার চেম্বারে অ্যানি বলেইন,লেডি জেন গ্রে,স্যালিসবারির কাউন্টেস এবং অন্যান্য রাজপুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল।বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা বমিলেনি তা হল অসংখ্য গার্ড এবং পর্যটক কন্ধকাটা মূর্তি ,ভয়াল শব্দ আর কিছু চেম্বারে প্রবেশ করলে শীতে কেঁপে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এবং আজও প্রতি ২১শে মেরে অভিশপ্ত দিনে নাকি রাত ১২টার ঘন্টা বাজার পর ষষ্ঠ হেনরির ভূতকে দেখা যায় আর সেই অশরীরী ১২টার শেষ ঘন্টা পড়ার পর মিলিয়ে যান।এছাড়া এক ঝড়ের রাতে এই টাওয়ার প্রহরা দেওয়ার সময় একজন রক্ষীই ওপর কে যেন একটা বড় রেনকোট ছুঁড়ে ফেলে এবং সেই রেনকোট সরিয়ে দেওয়ার সময় কেউ যেনে পেছন থেকে তা দিয়ে গলায় ফাঁস দিতে চাওয়া মৃত্যুভয়ে ওখান থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে গার্ড রুমে এসে বাকি রক্ষীদের জানায় যারা তখন ওর গলায় স্পষ্ট ফাঁসের দাগ দেখেছিল।

৩) মাউন্ট শাস্তা: এক পর্বতের বুকে লুকোনো অন্য জগতের কাহিনি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত মাউন্ট শাস্তা শুধু একটি আগ্নেয়গিরি নয়, এটি এক রহস্য ও লোককথার আধার। ১৪,০০০ ফুট উচ্চতার এই পর্বতকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে ছড়িয়ে আছে অলৌকিক কাহিনি, গুপ্ত শহরের গল্প ও ভিনগ্রহবাসীর উপস্থিতির গুজব।
টেলোস – লুকোনো এক শহর
জনশ্রুতি অনুযায়ী, মাউন্ট শাস্তার গভীরে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন গোপন শহর – “টেলোস”। বলা হয়, এই শহরে বসবাস করে লেমুরিয়ান নামক এক উন্নত প্রজাতির মানুষ, যারা এক সময়ে ডুবে যাওয়া প্রাচীন মহাদেশ লেমুরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিল।
তাদের সম্পর্কে বলা হয়:তারা আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত, টেলিপ্যাথি ব্যবহার করে যোগাযোগ করে।
তারা বহু শতাব্দী ধরে মাউন্ট শাস্তার গুহা ও সুড়ঙ্গের মধ্যে বসবাস করছে।
তাদের গঠন সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা – দীর্ঘকায়, সাদা পোশাকে আবৃত, এবং তাদের শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়।
আলো, ছায়া ও অদ্ভুত দর্শন
স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্বতারোহীদের অনেকে দাবি করেন, মাউন্ট শাস্তার আশেপাশে:
রহস্যময় আলো দেখা যায় রাতের বেলায়, যা কখনও স্থির, আবার কখনও চলমান।
অদ্ভুত দর্শন বা হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া কিছু মানুষের খবর আছে।অনেকেই বলেন, তাঁরা অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত সত্তার অনুভব পেয়েছেন।
হলো আর্থ থিওরি ও ইউএফও সংযোগ
অনেক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মাউন্ট শাস্তা “হলো আর্থ” বা ফাঁপা পৃথিবী তত্ত্বের অন্যতম প্রমাণ। তাঁদের মতে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে একটি বিকল্প সভ্যতা রয়েছে এবং মাউন্ট শাস্তা তার একটি প্রবেশদ্বার।আবার অনেক ইউএফও পর্যবেক্ষকের মতে, এখানে ভিনগ্রহীদের গোপন ঘাঁটি রয়েছে। ইউএফওর আলো ও শব্দ প্রায়ই ধরা পড়েছে বলে দাবি করা হয়।
এই পর্বত শুধু রহস্যের স্থান নয়, এটি অনেকের কাছে এক আধ্যাত্মিক শক্তির কেন্দ্র। বহু মানুষ এখানে আসে ধ্যান ও আত্মানুসন্ধানের উদ্দেশ্যে।এমনকি কিছু নিউ এইজ আন্দোলনের অনুসারীরা মনে করেন, এই পর্বত ‘চাক্রিক শক্তির বাহক, যা আত্মিক উন্নতির জন্য সহায়ক।এটি বাস্তবতা নাকি কল্পকাহিনি সেই নিয়ে চর্চা অবিরাম হয়ে চলেছে যদিও আজ পর্যন্ত কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণে টেলোস শহরের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা যায়নি। তবে সেই স্থানীয় গল্প, অনুশোচনাহীন দর্শন ও শত শত মানুষের অভিজ্ঞতা এই পর্বতকে তৈরি করেছে এক জ্যান্ত রহস্যগ্রন্থ।
পরিশেষে মাউন্ট শাস্তা শুধুমাত্র একটি ভূপ্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, এটি এমন এক স্থান যেখানে বাস্তবতা ও রহস্যের মধ্যে সীমানা প্রায় মুছে যায়। টেলোসের অস্তিত্ব সত্য হোক বা না হোক, এই পর্বত মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে অনাবিষ্কৃতের খোঁজে, অজানার প্রতি কৌতূহলের মাঝে।

৪) এস এস আওরং মেডান–১৯৪৭ সাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রপথে চলমান একটি অজানা বিপদ সংকেত আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় নিকটবর্তী নৌযানে। একটি জাহাজ – নাম এস এস আওরং মেডান, যার মালিকানা ছিল তখনকার ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া)–এর। এই জাহাজ থেকে যে বার্তা পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল সত্যিই বিভীষিকাময়।এসওএস বার্তা ছিল : মৃত্যু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে,আর শেষ বার্তা: ক্যাপ্টেন সমেত সব অফিসাররা চ্যাটরুম আর ব্রিজে মৃত এবং সর্বশেষ বার্তা ছিল ‘আই ডাই’ ।
কাছাকাছি থাকা জাহাজ সিলভার ষ্টার সংকেত পেয়ে এস এস আওরং মেডানকে খুঁজে পায় মালাকা প্রণালীর কাছে।
জাহাজে চড়ে যা দেখা গেল, তা ছিল শীতল, নীরব এবং অস্বাভাবিক,সমস্ত নাবিক মৃত, শরীরে কোনও দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন ছিল না,চোখ ছিল বিস্ফারিত, মুখে ছিল ভয়ানক আতঙ্কের ছাপ, এমনকি কুকুরটিও মৃত অবস্থায় দাঁতের কামড়ে ধরা মুখে জমে ছিল।কেউ কেউ বলেন, মনে হচ্ছিল তারা কোনো অদৃশ্য আতঙ্কের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে।
সিলভার স্টারের যখন উদ্ধার দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল ঠিক তখনই জাহাজে ধোঁয়া দেখা যায়,এরপর একটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং এবং এস এস আওরং মেডান সাগরের অতল গর্ভে তলিয়ে যায় আর এই বিস্ফোরণের কারণ আজও অজানা।
তত্ত্ব ও যুক্তি: কী ঘটেছিল সেদিন?
এই রহস্যময় ঘটনার কোনও সরকারি নথি বা যাচাইযোগ্য রেকর্ড আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নানা তত্ত্ব প্রচলিত আছে:
১. বিষাক্ত গ্যাস তত্ত্ব-বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্ভবত জাহাজে অবৈধভাবে রাসায়নিক গ্যাস (পটাসিয়াম সায়ানাইড বা নাইট্রোগ্লাইকোল) বহন করা হচ্ছিল, যা লিক করে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে সবার মৃত্যু ঘটায়।
২. ভুতুড়ে জাহাজের কিংবদন্তি-অনেকে একে ” ঘোস্ট শিপ” বলে মনে করেন যা মৃত্যু ও আতঙ্কের প্রতীক।
৩. কেলেঙ্কারি বা ধোঁকাবাজি-কিছু গবেষক যেমন রয় বেইনটন মনে করেন , এই গল্প সম্ভবত একটি সমুদ্রযাত্রার কিংবদন্তি, যার কোনও নির্ভরযোগ্য নথিভিত্তিক প্রমাণ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে উল্লেখ করেন তাহলে এত লোকের অভিজ্ঞতা কোথা থেকে এল ?
এস এস আওরং মেডান রহস্য একদিকে সমুদ্রের গভীর অজানার দিকে ইঙ্গিত করে, আর অন্যদিকে আমাদের চিরন্তন কৌতূহলের প্রতিফলন। সত্যিই কি এটি একটি ভুতুড়ে জাহাজ, নাকি শুধুই একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা, কিংবা নিছক গল্প? আজও এই প্রশ্নের কোনও সুস্পষ্ট উত্তর নেই।

৫) প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ, চিলি
রহস্য: দ্বীপে ছড়িয়ে আছে প্রায় ৯০০টি বিশাল পাথরের মূর্তি (মোয়াই), যেগুলোর উচ্চতা ৩০ ফুট পর্যন্ত, ওজন ৮০ টনের বেশি। প্রশ্ন হল এত প্রাচীন সময়ে, কোনো আধুনিক যন্ত্র ছাড়া, এত বড় মূর্তি কে বা কারা তৈরি করল এবং কীভাবে সেগুলো মাইলের পর মাইল দূরে সরানো হলো?
অমীমাংসিত দিক:কোন উদ্দেশ্যে মোয়াই তৈরি হয়েছিল?কীভাবে এত ভারী মূর্তি দূরে স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়েছিল? অনেক মূর্তির দেহ মাটির নিচে লুকানো, সেটি কেন?
বিভিন্ন মত:কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন, ধর্মীয় বা পূর্বপুরুষ পূজার অংশ হিসেবে তৈরি,আবার অনেকে মনে করেন, এটি বহির্জাগতিক প্রভাবের ফলাফল।
তথ্যসূত্র -বিবিসি,হিস্ট্রি ডট কম,ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া।
শেয়ার করুন :