পিয়া ঘোষ বন্দোপাধ্যায়
জীবন সমুদ্রের ঢেউ বোঝা বড় দায় ! কখন কোন ঢেউ যে মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, তা কেউ জানে না। আর জানে না বলেই গল্প তৈরি হয়। জানে না বলেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। জানে না বলেই মানুষ হারাতে জানে। করণ জোহরের ধর্মা প্রোডাকশনের ‘আজিব দাস্তান’ ঠিক এমনই এক জীবন সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবি। চারটে অমূল্য রতন খুঁজে এনে চার পরিচালক এক সুতোয় গেঁথে মণিহার তৈরি করেছেন। ছোট গল্পে ভাগ করে একটা গোটা সিনেমা তৈরির ট্রেন্ড বলিউডে অনেক দিন ধরেই চলছে। এই ছবিও সেই গতিই অনুসরণ করেছে।
প্রথম গল্প: মজনু
সম্পর্কের টানা পোড়েন তো থাকেই জীবনে। কিন্তু যেদিন থেকে সমকামিতা মানুষ বুঝতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে মানুষের জীবনে সমস্যা বেড়েছে বইকি। আমরা সমকামিতা কি হয় জানি, অনেকে বুঝি, অনেকে বুঝেও মানি না। বিশেষ করে আমাদের সমাজ মানে না। শরীর তো বিপরীত লিঙ্গকেই চাইবে, এটাই তো উচিত। আর এই উচিত-অনুচিতের ধাঁধাঁয় পড়ে বহু জীবন নষ্ট হয়ে যায়। এই গল্প তেমনই এক ঢেউ বইয়ে দেয় জীবনে। বিবাহিতা স্ত্রীকে ছুঁয়ে পর্যন্ত না দেখা। ওদিকে সেই আগুনে জ্বলে স্ত্রী যেন হয়ে উঠছেন সাহসী। ছোট্ট একটা সংসার, আর পুরুষের ভালবাসার আশায় মরিয়া মেয়েটি। স্বামী থেকেও নেই। যখন সত্যি প্রেম এল, সেও প্রতিশোধ নিয়ে চলে গেল। কিন্তু সমকামী অসহায় স্বামী শরীর না ছুঁলেও, শক্ত হাতে স্ত্রীর পাশে থাকলেন। অন্যের সন্তানকে নিজের করতে দ্বিধা করলেন না। কারণ দু’দিকের মানুষই নিরুপায়। নিজের নিজের ভাবনার কাছে। তাই বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হয় সব কিছু। খেয়াল করলে এমনটা বোধহয় আমাদের সবার সঙ্গেই হয়। পরিচালক শশাঙ্ক খৈতান অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পের রসায়ন। আর ফতিমা শেখ যেন দিন দিন তাঁর অভিনয়ে দক্ষতার ছাপ রেখে যাচ্ছেন।
দ্বিতীয় গল্প: খিলোনা
সমাজের উচু স্তর ও নিচু স্তরের মানুষের গল্প বলে এই খিলোনা। তাঁর সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে জড়িয়ে পড়ে একটা খুন। এখানেও সেই ইচ্ছে এবং না পাওয়ার লড়াই। তবে এই গল্পের শেষে আপনি দু’বার ভাববেন। কারণ সত্যিই কি কোনও খুন হয়েছে? নাকি সবটাই ‘খিলোনা’। অসাধারণ অভিনয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, নুসরত বারুচার। শিশু শিল্পী ইনায়াত বর্মা জিতে নেয় মন। দুই বোন যে কখন আপনার নিজের হয়ে যাবে, আপনি টের পাবেন না। রাজ মেহতার পরিচালনায় পাঁপড়ি মেলেছে খিলোনা।
তৃত্বীয় গল্প: গিলি পুচি
ভারতী মন্ডল। তাঁর চোখ, লড়াই, ঠকে যাওয়া সব যেন কুড়ে কুড়ে খাবে আপনাকে। সমকামী জীবন থেকে শুরু করে নিচু জাতের মেয়ে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সঠিক কাজ না পাওয়া। পুরুষের সঙ্গে চোখ চোখ মিলিয়ে লড়াই। কোথায় ছিলেন এই মেয়ে ! আসলে ভারতের আনাচে কানাচে প্রতিদিন লড়ছে ভারতী মন্ডলরা। আবার হারিয়েও যাচ্ছে। তবে এই গল্পের ভারতী শেষ পর্যন্ত হারতে শেখেনি। স্টিলের কাপে নিচু জাত বলে চা খাওয়ার জবাব সে কড়ায় গন্ডায় দিয়েছে। ভারতীর চরিত্রে কঙ্কনা সেন শর্মা যে কখন নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দিয়েছেন তা বোঝা যায় না। এক মুহূর্তও চোখ ফেরানো যায় না ওই মেয়ের লড়াই থেকে। মন যেন কঙ্কনার গিলি-পুচি বন্ধুত্বের পিয়াসি হয়ে ওঠে। এ ছবি শুধু কঙ্কনার। বাকিরা ভাল। পরিচালক নিরজ ঘায়ান কঙ্কনা বা ভারতীতেই সব রসদ ভরে দিয়েছেন। দেখুন আর ভাবুন লড়াইটা আজও কোন জাগায় আটকে রয়েছে। আমরা কি সত্যিই এক পাও সভ্যতার দিকে এগিয়েছি? নাকি ভারতী মন্ডলরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, আমাদের দৈন্য !
চতুর্থ গল্প: আনকাহি:
এ গল্প আমাদের সবার। রাতের বেলা ঘরের দরজা ঠেলে যখন বাড়িতে আসেন, তখন আপনার কাঁধে হাজার একটা বোঝা থাকে। কিন্তু ঘরের মানুষটা আপনার স্ত্রী সে বোঝার আঁচ পায় না। সে অন্য লড়াইতে ব্যস্ত। এই লড়াই দ্বন্দে , না বোঝায়, মানুষ একা হয়। আর তখনই হয়ত জীবনে তৃত্বীয় ব্যক্তি আসে। কিন্তু আসলেই কি আমরা সব পিছুটান এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলতে পারি? হয়ত পারি না। যেমন পারেননি এই গল্পের নায়িকা শেফালি শাহ। শরীর, মন দুই হয়ত অন্য জীবন কাটাতে চায়। শেষ বার নিভে যাওয়ার আগে, জ্বলে উঠতে, বেঁচে উঠতে সবাই চাই আমরা। কিন্তু কিছু অভ্যেস, কিছু দায়িত্ব আমাদের পা বেঁধে দেয়। চাইলেই সব কিছু পারা যায় না। তবে ভালবাসাকে সেলসম্যান বলে দেওয়াও বোধহয় যায় না। ওই ‘সেলসম্যান’ কথাটা বলতে বাধ্য হতে হয়। কারণ জীবন আমাদের বাধ্য করে। এই গল্প বলে, প্রেম থাকলে মুখের কথা দরকার হয় না। ভাষাহীন জীবনেও গতি আসে। আর প্রেমহীনতায় সব কথাই বেমানান। কায়জি ইরানির পরিচালিত গল্প আপনাকে কাঁদাবে। শেফালি শাহ বরাবর ভাল। টোটাও যথাযথ। তবে চোখ বন্ধ করলেই বার বার মানব কলের মুখ মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে সেই অসাধারণ ইশারায় বলা কথা, ‘ঠোঁট মিথ্যে বলে, কিন্তু চোখ নয়।’ এক ঝটকায় সেই প্রেমিকই যখন সেলসম্যান হয়ে যায়, তখন কানে বাজে, “তুমি চোখ দিয়েও অসাধারণ মিথ্যে বলো।'”
শেয়ার করুন :