সুমন্ত্র মিত্র
‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি,বাবাকে আপনি।আমাদের মা গরিব প্রজাদের মতো দাঁড়াতো বাবার সামনে ,কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারতো না।আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।আমাদের মা আমাদের থেকে বড়ো ছিলো,কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।’
-‘আমাদের মা ‘-হুমায়ুন আজাদ
আন্তর্জাতিক নারীদিবসের এবছরের থিম ‘অ্যাকনলেজ দ্য আইডিয়া অফ মাদারহুড’।মাতৃত্ব দেশ কাল,জাত,ধর্ম সব কিছুর ঊর্ধ্বে হলেও বাঙালি মায়েদের সন্তানস্নেহ ,বাৎসল্যর প্রাবল্য নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কটাক্ষ করে ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় লিখেছিলেন ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুঘ্ধ জননী,রেখেছো বাঙালি করে,মানুষ করোনি।’অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে বঙ্গজননী তাদের সন্তানদের অনেক বেশি আদরে,স্নেহে বড় করে তোলেন।এই স্নেহময়ী মায়েরা বাঙালি সমাজে চিরকাল বেশ খানিকটা অনাদরে অবহেলায় মুখ বুজে কাটিয়ে গেলেন।সময় অনেক বদলেছে ,আগের তুলনায় এখনকার মায়েরাও সব কিছু মুখ বুজে সহ্য না করলেও তাদের সন্তানস্নেহ কম পড়িয়াছে এমন কোনো দুর্নাম বা অভিযোগ নেই আর এখন সব মায়েরা তাদের ব্যক্তিত্ব প্রকট করে সমাজে পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছেন এমনও ভাবার কোনো কারণ নেই শুধু স্নেহময়ী মায়েদের সন্মান আর স্বীকৃতি আগের থেকে কিছুটা উন্নত এই যা। ওপরে হুমায়ুন আজাদের উল্লিখিত লাইনগুলি অমোঘ ও চিরন্তন সত্য।বাড়িতে বাবাই যে প্রধান আর মা সে অর্থে শুধু কাজের মানুষ এই ধারণা ছোট থেকে পেয়ে এসেছে ছেলে মেয়েরা তাই বাবাকে আপনি আর মাকে তুমি।
এই সব বাঙালি মায়েরা,রবীন্দ্রনাথের কাছে সমালোচিত বাঙালি মায়েরা,সারাজীবন উদয়াস্ত সংসার আর ছেলেমেয়েদের পরম স্নেহছায়ায় আদরে মানুষ করা মামুলি,সাধারণ মায়েদের কথা বাঙালির ইতিহাসে উপেক্ষিত হলেও সাহিত্যে স্মরণীয় উল্লেখ আছে।বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ র সর্বজয়ার মাতৃত্ব,যদিও দূর্গা আর অপুর মধ্যে অপুর প্রতি ছেলে বলে পক্ষপাত বেশি।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘জননী’ উপন্যাসে গৃহবধূ শ্যামাকে স্বর্গীয় বা দৈবিক মহিমায় ভাস্বর করে তোলেন নি,শ্যামার কিশোরী থেকে গৃহিনী আর জননী হয়ে ওঠার কাহিনী,বাস্তবের কাছে স্বপ্নের পরাজয়ের কথা বলেছেন।শরৎচন্দ্রের কালজয়ী ‘বিন্দুর ছেলে’ তে বিন্দুর নিজের ছেলে না হলেও অমূল্যকে সর্বগ্রাসী ভালোবাসা,রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে ব্যক্তিত্বময়ী মা আনন্দময়ী সমস্ত জাত পাতের ঊর্ধ্বে দীপ্তিময়ী মা,মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ সুজাতা একজন কঠোর মানসিকতার নারী যিনি মৃত ছেলে ব্রতীর জন্য সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ আবার বঙ্গজীবনের অঙ্গ দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি গল্পে বুদ্ধু ভুতুম মানুষ না হয়ে বাঁদর আর পেঁচা হয়ে জন্মালেও তাদের মাতৃস্নেহ অম্লান।
এইসব বাঙালি মায়েদের চেয়ে আপন পৃথিবীতে আর কেউ নেই,সন্তানকে কত বাধা,বিপত্তি পেরিয়ে অপার স্নেহে লালন পালন করা এইসব মায়েরা,এই পৃথিবীতে শত দুঃখ কষ্টের মাঝে এই মায়েদের আশ্রয়,স্বান্তনা ,স্নেহ ভালোবাসা যেন সব দুঃখ কষ্ট ঘুচিয়ে দেয়।
গল্প সাহিত্যের বাইরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই সব অকিঞ্চিৎকর মামুলি সাধারণ মায়েদের অপার স্নেহছায়ায়, অকৃপণ ভালোবাসায়,পরম মমতায় ছোট বড় মাঝারি সব সংসারে আবহমান কাল ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছেলে মেয়েদের মানুষ করে তুলে যে শেষ জীবনে সবাই খুব আরাম আর প্রশান্তি পেয়েছেন এই দুর্নাম বা অভিযোগ নেই বরং বহু মায়েরা সারাজীবন সংসারে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা আরো নানান কাজে জীবন উৎসর্গ করেও শেষ জীবনেও উপেক্ষা,দারিদ্র ও কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন এ রূঢ় সত্যও একেবারে অজানা নয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃদিবসে এই অঙ্গীকার যে বাঙালির ঘরে ঘরে আটপৌরে,সাধারণ,সে অর্থে অকিঞ্চিৎকর,মামুলি কিন্তু আসলে এই সব মহিয়সী,স্নেহময়ী মায়েদের প্রত্যেক সন্তান আর তাদের পরিবার যেন এই একদিন নয় সারাজীবন তাদের প্রাপ্য শ্রদ্ধা ,সন্মান আর স্বীকৃতি দিলে তবেই এ দিনের সার্থকতা এই কথাটি মনে রাখলেই হবে।
শেয়ার করুন :