সাধারণত পেটের অসুখ বলতে আমাশা ,ডায়েরিয়া,পেটের ব্যাথা কিম্বা হজমের সমস্যা বুঝি।কিন্তু পেটের ব্যাথার দুটো ভাগ,এক খাদ্যনালী অর্থাৎ পাকস্থলী,অগ্ন্যাশয়,ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্রের অসুখ আর দুই লিভারের অসুখ।এর আবার দুটো ভাগ,স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি।পেটের অসুখ বিসুখ নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারি পরামর্শ-
- খাবার পর ঢেঁকুর ওঠা এমনিতে স্বাভাবিক কিন্তু বেশি হলে বুঝতে হবে পেটে গ্যাস হচ্ছে। এছাড়া বুক জ্বালা মানেই গ্যাস্ট্রিক নয় কিন্তু যদি খালি পেতে বুক জ্বলছে আর খাওয়ার পর কমে যাচ্ছে এমন হয় তাহলে সেটা গ্যাস্ট্রিক লক্ষণ হতে পারে।
- গ্যাস্ট্রিক আর ঝাল খাওয়া নিয়ে জনমানসে একটা বিভ্রান্তি আছে যে ঝাল খেলেই গ্যাস্ট্রিক হবে।এই নিয়ে অনেক রিসার্চ হয়েছে,যেমন দক্ষিণ ভারতের মানুষরা খুব ঝাল খান কিন্তু ওদের তো গ্যাস্ট্রিক সমস্যা নেই,অনেকে কাঁচা লঙ্কা ছাড়া খেতেই পারেন না তাদের তো আলসারের সমস্যা নেই।কিন্তু গ্যাস্ট্রিক আছে ,কোনো চিকিৎসা নেই অথচ এন্তার ঝাল খেয়ে যাচ্ছেন তাহলে কিন্তু আলসার বেড়ে যাবে।
- খাওয়ার পর বুক জ্বালা,রাতে শোয়ার পর বুক জ্বালা,ভাত খাওয়ার আধাখোন্তা পর গলায় জল চলে আসছে এইগুলো গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স।কারণ মশলাদার রিচ খাবারে পেট সম্পূর্ণ ভরে গেলে বুকে জ্বালা হয়।পেট পুরো ভর্তি করে না খাওয়াই শ্রেয়।
- নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া উচিত।রিফ্লাক্স বলে শরীরে একটি পদার্থ আছে।কারুর যদি প্রতিদিন ২ টোর সময় খাওয়ার অভ্যেস থাকে ,একদিন না খেলে সেই সময় পেট অ্যাসিডে ভরে যাবে।আর রোজ দেরি,অনিয়ম হলে এই লক্ষণ বেড়ে যাবে তাই নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার উপকারিতা আছে কারণ আমাদের শরীর একটা অভ্যাসের মধ্যে চলে যায়।
- চাইনিজ আর এখন অন্যান্য খাবারেও স্বাদবর্ধক আজিনামোটোর অত্যাধিক ব্যবহার শরীরে নানা ক্ষতি করতে পারে,বিশেষত বাচ্চাদের।এর থেকে মাথা ব্যাথা মাইগ্রেনের রূপ নিতে পারে,ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্রকে দুর্বল করে দিতে পারে,বাড়তে পারে হৃদরোগের আশঙ্কা আর এর রাসায়নিক প্রভাবে বাড়তে পারে রক্তচাপ,সুগার আর থাইরয়েড সমস্যা।
- পেটের ওপর ভাগে দীর্ঘদিন বার বার ব্যাথা পেপটিক আলসারের লক্ষণ যা পাকস্থলী বা ক্ষুদ্রান্ত্র মানে স্মল ইন্টেস্টাইনের ব্যথার কারণে হয়।এটা দুরারোগ্য অসুখ।অনিয়মিত খাওয়া দাওয়া, ধূমপানের কারণে খালি পেটে ব্যাথা,শেষরাতে ব্যাথা এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যাথা এই রোগের লক্ষণ। খাবারের প্রতি অনীহা,অরুচি,অস্বস্তি,ওজন কমে যাওয়া আর লিভারের ব্যাথা।পেপটিক আলসারের সময়মতো চিকিৎসা না হলে লিভার সিরোসিস হতে পারে।লক্ষণ বা ধরণ দেখলে এ রোগ ধরা গেলেও স্টুল টেস্ট,কালচার পরীক্ষা করতে হবে,এছাড়া দেখতে হবে মাইক্রোস্কোপিক কোলাইটিস,ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স রোগে ভুগছেন কিনা।সময়মত রোগ নির্ণয় আর চিকিৎসা করলে এই রোগ সেরে যাবে।
- আজকালকার লাইফস্টাইলে নিয়মিত প্রসেসড ফুড খাওয়া শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক। জ্যাম,জেলি,চিজ,মাখন,কৌটোর মাছ মাংসে খাবার দীর্ঘদিন তাজা রাখতে নাইট্রেট সালফাইড আর অন্য খাবারে গ্যালেটস রাসায়নিক মেশানোর ফলে দীর্ঘদিন খেলে অ্যালার্জি ও পেটের সমস্যা দেখা দেয়।
- বিকেলে এবং রাতে এমন গুরুপাক খাওয়া উচিত নয় যা আপনি সহজে হজম করতে পারেন না।অবশ্য নেমন্তন্ন বাড়ি হলে আলাদা কথা তবে নিয়মিত মাসে ১০ দিন রাতে তেল মশলাদার খাবার খেলে আর সিডেন্টারি লাইফস্টাইল হলে পেটের গুরুতর অসুখ অবধারিত ।এর জন্য পেট ফাঁপা বা গ্যাসের সমস্যা দীর্ঘদিন চললে অবশ্যি গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট পরামর্শ নিতে হবে।আর একটা কথা মনে রাখতে হবে যে সঠিক সময়ে পরিমিত আহার গ্যাসের প্রকোপ কমায়।
- পেটের অসুখের সঙ্গে খাবারের রঙের সম্পর্ক আছে।সস্তার বিশেষত রাস্তার খাবার যাকে স্ট্রীটফুড বলে সেখানে মেটানিল ইয়েলো রং মেশানো হয় জিলিপি, বোঁদে, লাড্ডু,চপ ইত্যাদি খাবারে।এই রং একটানা শরীরে গেলে ক্ষতি হতে পারে লিভার,কিডনি আর মস্তিষ্কের।
- ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রথম চিকিৎসা পরিপূর্ণ বিশ্রাম।স্বাভাবিক তেল মশলা ছাড়া খাওয়া দাওয়া,১/২ সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি না হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরামর্শ।শুরুতেই ক্রনিক হেপাটাইটিস রক্ত পরীক্ষা করতে হবে,এটা অত্যন্ত জরুরি কারণ ক্রনিক হেপাটাইটিস দীর্ঘদিন চললে লিভারের ক্ষতি হবে।ক্রনিক হেপাটাইটিসের লক্ষণ- দুর্বলতা,খাওয়ার প্রতি অনীহা, শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
- জীবিকার প্রয়োজনে বেশিরভাগ মায়েদের বাইরে থাকতে হয় আর এখন কিছু ক্ষেত্রে ওয়ার্ক ফ্রম হোম হলেও সেই ঘর অফিস হওয়ার কারণে শিশুরা বেশি সময় কাজের লোকের কাছে থাকে তাই শিশু,বাচ্চারা খাওয়ার সময় কি হাইজিন মেনে খাচ্ছে এটা লক্ষ্য রাখা জরুরি কারণ এই অসাবধনাটা থেকে কৃমির সংক্রমণ,ডায়েরিয়া,ফুড পয়জনিং,গ্যাস,মেয়েলি রোগ,ইউরিন ইনফেকশনের মতন রোগ বাসা বাঁধতে পারে।শিশুরা পেটে ব্যাথা বললে উপেক্ষা করা উচিত নয়।
- ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম মনের প্রকৃতির ওপর পেটের পরিস্থিতি নির্ভর করে।টেনশন থেকে পেটের সমস্যা হয়।তাই স্ট্রেস কমাতে হবে।তার জন্য যোগাসন প্রয়োজন।মন থেকে হঠাৎ পটি প্যানিক দূর করতে হবে।আর পটাপট টেনশন রিলিফের ওষুধ ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়।যত খারাপ পরিস্থিতি হোক না কেন মনকে পজিটিভ রাখতে হবে,আনন্দে রাখতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কথায়.’বৃহত্তম বিপদই বা কতদিনের,মহত্তম দুঃখই বা কতখানি, দুঃসহতম বিচ্ছেদই বা আমাদের কতটুকু হরণ করতে পারে -যদি তাঁহার আনন্দ থাকে।’
- ভেজাল ও দূষিত খাবারের মধ্যে দিয়ে ৯০% মানুষের পেটে ঢুকে পড়ে ঘাতক জীবাণু হেলিকোব্যাক্টর পাইলরি বা এইচ পাইলরি।এই ব্যাকটেরিয়া প্রথমে মানুষের পাকস্থলীতে বাসা বেঁধে ঘা তৈরি করে যা পরে পাকস্থলী ছিদ্র করে ছড়িয়ে পড়ে পেটজুড়ে এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে,খাদ্যে হজমে বাধা সৃষ্টি করে ডিওডেনাম ও পাকস্থলীর মিউকাস মেমব্রেনের লাইনিং নষ্ট করে ফেলে ক্ষত সৃষ্টি করে। রাস্তার খাবার,বেশি তেল ঝাল মশলাযুক্ত খাবার,বাসি খাবার,অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়া,ধূমপান,মাদক সেবনের কারণে এইচ পাইলরির সংক্রমণ ঘটে।শরীরে এর সনাক্তকরণ হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের কাছে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে রোগমুক্তি সম্ভব। উপেক্ষা করলে পেপটিক আলসার এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ টিম – পূর্ব ভারতের একমাত্র আন্তর্জাতিক JCI অ্যাক্রেডিটেড অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালসের ইনস্টিটিউট অফ গ্যাস্ট্রো সায়েন্সের ডিরেক্টর ডঃ মহেশ গোয়েঙ্কা -MBBS,MD,DM (gastro),MNAMS,FACG,FASGE (USA)সিনিয়র কনসালটেন্ট ডঃ কিংশুক দাস-MD,DM,PGIME&R, ,FASGE (USA), কনসালটেন্ট ডঃ ইন্দ্রজিৎ কুমার তেওয়ারি MBBS,MD,ডঃ নিখিল সোন্থালিয়া-MBBS,MD
*এই নিবন্ধটি সাধারণ তথ্যের জন্য যা কোনোভাবে ওষুধ আর চিকিৎসার বিকল্প নয়। অসুখ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
শেয়ার করুন :