ঝুমুর দত্তগুপ্ত
ইংরেজরা নিউইয়ারের বড় আদর করেন। আগামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান-নেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন।
হুতোমের নকসার প্রথমভাগে এমনভাবেই বর্ণনা রয়েছে বাংলা নববর্ষের। সেখানে কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক আর গাজন উতসব অনেকটাই জুড়ে রয়েছে। কিন্তু কলকাতা ও তার বাবু-কালচারের এই জীবন্ত দলিলে বিবিদের কথা কোথায়?
কাট ওয়ান
মোবাইলের অ্যালার্মের একঘেয়ে শব্দে প্রতিদিনের মতই ঘুম ভেঙে গেল পুপুর। ব্যাঙ্গালুরুতে বৃষ্টিভেজা আরও একটা সকালের শুরু। ঘুম চোখেই মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ। সকাল সাতটায় কলকাতা থেকে মায়ের চারটে মিসড কল।কেন? ভাবতে ভাবতেই হোয়াটস অ্যাপে নজর। হ্যাপি বাংলা নববর্ষের একগাদা মেসেজ। ওহ! আজ পয়লা বৈশাখ। বাঙালির নতুন বছর। তাই বোধহয় বং কালচারের এত উদ্দীপনা। ভাষা-রায়ট। ঝুপঝুপ করে একগাদা স্মৃতি ভিড় করে এল। বছর পয়লা উপলক্ষে পাড়ার গানের ইস্কুলে সান্ধ্য অনুষ্ঠান। মায়ের পুরাতনী আর দিম্মার আবৃত্তি। কিন্তু সকাল থেকে বড় ব্যস্ততা। কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে শাশুড়ি-বউমা জুটি। একজন সামলাচ্ছেন পুজো, অন্যজন হেঁসেল। আজ তো বছর পয়লা। দিনটা অন্যরকম হয়েও আলাদা নয়।
ছোটবেলার সেইসব কথা ভাবতে ভাবতেই উঠে পড়ল পুপু। টুক করে বাড়ির দুই মহিয়সীকে পাঠিয়ে দিল ই-পেন্নাম। অফিসের কন-কল সেরে না হয় পরে ফোন করা যাবে।
আরও পড়ুন:
জাম্প কাট
সাত সকালে জোরকদমে প্যাডেল করে স্টেশনে পৌঁছেছিল বীথি। সঙ্গে ক্লাস থ্রিতে পড়া ছেলে। এই ট্রেনটা মিস করলে আবার মিনিট পয়তাল্লিশ অপেক্ষা করতে হত। এখন লেডিস কম্পার্টমেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে ও। পয়লা বোশেখ হলে কী হবে টেরেনে বেশ ভিড়। নতুন জামা-জুতো পরে সবাই বেরিয়ে পড়েছে। গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে অবাক হয়ে সেটাই দেখছে। বীথির মাথায় নানা চিন্তুা ঘুরছে। খোলা পাবে তো দোকানটা। মণিদি বলেছিল কোভিডের পর হাতিবাগানে ভাইয়ের ফুটপাথের দোকানে দারুন বিক্কিরি হয়েছে এবার। সেল লেগেছে। রাত এগারোটা পর্যন্ত বিকিকিনি। গত কয়েকদিন মেন লাইনে টেরেনে খুব গোলমাল। বরের চাকরিটা মাস কয়েক হল পেয়েছে বীথি। তাই একটু আগেভাগে বেরোনের কথা কোনওদিনই বলতে পারেনি ও। পয়লা বোশেখে আজ ছুটি। সকাল সকাল ছেলেকে নিয়ে তাই ছুট। শেষবেলায় সেলের বাজার করতে। হাঁটু ফাটা জিনি প্যান্টের বায়না করেছে ছেলে। কথা দিয়েছিল চৈত্রসেলে দেবে। একবার নিজের পায়ের দিকে নজর পড়ল ওর। সিকিউরিট গার্ডের চাকরিতে কালো বন্ধ জুতো খুব জরুরি। এই কমাস ধার করা জুতো দিয়ে চালাচ্ছে। সেলে একটা জুতো কিনবে ভেবেছিল। হবে কিনা কে জানে। আসার সময় বিধবা ভাতার টাকা থেকে দুশো টাকা দিয়েছে মা। কাতলা মাছ কেনার জন্য। আজ তো ভালো -মন্দ খাওয়া-দাওয়ার দিন। হাবজি-গাবজি এসব ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে চোখ গেল বীথির। মনে মনে বলল ঠাকুর এবছর যেন ভালো যায়। ছেলে আর বুড়ি মাকে নিযে যেন ভেসে থাকতে পারি।
প্যারালাল কাট
কোকোর মনটা খিঁচড়ে উঠল একেবারে। সকাল সকাল দরজা নক করে হামলা গ্র্যানির। মায়ের কলটা ধরিয়ে দিয়েছে। বস্টনে একটা বিজনেস কনফারেন্স গিয়েছিল মা। ফিরছে। দিল্লি এয়ারপোর্টে লে-ওভার। সেখানে থেকে ফোনে স্ট্রিক্ট ইনস্ট্রাকশন। আজ নো হট-প্যান্ট, নো ক্রপ টপ। আজ শুধু কুর্তি। আর লাঞ্চে থাকাটা কম্পালসারি। গুড লর্ড। কিন্তু কেন? মায়ের কাজিন, আর বিজনস স্কুলের বন্ধুরা আসবে বলে কেন কোকোর অ্যাটেনডেন্স কম্পালসারি। আজ কী? রাগে গরগর করতে করতে দরজা ঠেলে ঘর থেকে বেরোতেই পুরো ফ্রিজ হয়ে গেল সে। সেই চেনা অ্যারোমা। ওকে প্রায় ঘিরে ধরেছে। ডাব চিংড়ি। তার-মানে আজ বেঙ্গলি নিউ-ইয়ার। প্রতি বছর এই মেনুটা বাড়িতে হবেই। বাড়ি ভরতি থাকে মায়ের বন্ধু-বান্ধবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা রবীন্দ্রসংগীত। বছরকার এই দিনটা ঢিপ-টিপ করে এল্ডার্সদের প্রণাম করার দিন। ভালোই লাগে কোকোর। হেভি লাঞ্চের দিন ন্যাচারাল বেলি এক্সারসাইজ। হঠাত রাগটা পড়ে গেল ওর।
বেঙ্গলি নিউ-ইয়ার বলেই কী রাতের জ্যামিং সেশনের জন্য বাংলা গানের লিঙ্ক পাঠিয়েছে মুদ্রা? আজ কী পরবে মুদ্রা? ট্রান্সপারেন্ট লাল-সাদা কটন শাড়ি পরলে ওকে দারুন মানাত। ঠিক যেমন মা এদিন পরে। সঙ্গে লাল টিপ। বিকেলে ভাবছে একটা সাদা মালা কিনে নিয়ে যাবে। মুদ্রার খোপার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে মোবাইলে গুগল কিবোর্ড ডাউনলোড করে ফেলল কোকো। আজ তো ওকে প্রথমবার বলা যেতেই পারে আমি তোকে ভালবাসি। আজ যে বছর-পয়লা। মুদ্রাকে বাংলায় মেসেজ পাঠাল কোকো।
মন্তাজ
আজ হিন্দুস্তান পার্কের এই বাড়িতে শেষ পয়লা বৈশাখ। তাই গুহ পরিবারের যে যেখানে রয়েছে সবাই এসে জমা হয়েছে। আজ পয়লা বৈশাখের দিন। প্রমোটারের সঙ্গে বাড়ি বিক্রির শেষ ডিল সই। সঙ্গে বছরকার উতসব। তাই কুচোকাচারা লালমাটির মেঝেতে, সিড়িতে আলপনা দিচ্ছে। প্রবল উতসাহে জিঙ্ক-অক্সাইডে তুলো ডুবিয়ে চলছে সেই পর্ব। বাড়ির অল্প বয়সী বউরা চলে এসেছে তিনতলার চিলেকোঠায়। ট্রাঙ্ক থেকে নামিয়ে কাসার বাসন-পত্র ধোয়া-মোছা চলছে। সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা। রান্না ঘরে আজ মা-কাকিমাদের দারুণ ব্যস্ততা। এই বাড়িতে শেষ পয়লা বৈশাখ বলে কথা। তাই ফর্দ বেশ বড়। তেতোহীন ভাঙাচোরার শুকতো, বেগুনি, ছানার ডালনা, কুচো মাছ, ইলিশ মাছের মাথার মুড়ি ঘণ্ট, দই কাতলা, তেল কই, চিংড়ি কিছুই প্রায় বাদ যায়নি। অনেকদিন পর এক হেঁসেলে রান্না। একতালার বড় রান্নাঘরে তাই দক্ষযজ্ঞ চলছে। হালকা ঝাড়পোছ করছে বাড়ির মেয়েরা। বৈঠকখানায় ফুলদানিতে ফুল। কাচের সেন্টার টেবলের ওপর পুরনো ক্রশের কাজ করা টেবিল ক্লথ। সন্ধেবেলা ভাই-বোনেরা মিলে গানবাাজনা করবে। তাই অনেকদিন পর নেমেছে হারমোনিয়াম। তবলা পাওয়া গেলও বাঁয়ার খোঁজ চলছে।
উঠোনের ধারের খোলা বারান্দায় বসে এসবই লক্ষ্য করছেন নব্বই ছুইঁছুঁই বাড়ির কর্ত্রী প্রীতিলতা। মুখে হাসি। শান্ত চোখে দেখছেন ওদের। জীবনে একটা জিনিস তিনি মানেন। পুরনোকে আঁকড়ে বসে থাকলে চলে না। নতুনকে জায়গা দিতে হয়। পাঁচকাঠা জমির ওপর এই বাড়ির কোণায় কোণায় মায়া জড়িয়ে রয়েছে তাঁর। সামনের কয়েক বছরে এখানেই উঠবে কুড়ি তলার এক বহুতল। প্রোমোটার বড়খোকার বন্ধু। টাকা পয়সার ব্যাপারে ছেলে-মেয়েরা কথা বলেছে। তার শুধু একটাই দাবি। বাড়ির নাম বদলানো যাবে না। আশ্রয়। রাজি হয়েছে প্রোমোটার। তাঁর স্বামীর দেওয়া সাধের এই নাম যেন কেউ ভুলে না যায়। নাতি-পুতির মাধ্যমে বেঁচে থাকার এক প্রবল ইচ্ছে। পয়লা বৈশাখে এটাই কামনা।
ডাচ অ্যাঙ্গেল
এই কদিন খুব চাপ গেছে চন্দ্রার। ঘর পরিষ্কার, ধুয়ো-মোছা। শুধু তো বাড়ি নয়, সঙ্গে দোকানও। স্বামীর সঙ্গে হাতেহাত লাগিয়ে দোকান ঘর রঙও করেছে। তারপর বাড়িতে দুদিনের নিরামিষ রান্নার পর্ব। উচ্ছের রস, নিশ্চিন্দা পাতার রস। বাজারে ভিড় ঠেলে গণেশ ঠাকুর কেনা। বছর পয়লার দিন খদ্দের টানতে প্রতিবছর প্যাকেট করতে হয়। কাল প্রায় সারারাত প্যাকেট গুছোতে হয়েছে। এবার প্রায় দেড়শোখানা প্যাকেট। একটা করে শুকনো লাড্ডু, দুটো করে গুজিয়া আর ছোট প্যাকেট চানাচুর। এই করতেই পুজিতে টান ধরে গেছে। সকাল থেকে পুজোর প্রস্তুতি। পুঁটি মাছ ছেড়ে ঘট বসানো। সঙ্গে খদ্দের সামলানো। দুপুরে কোনওরকমে নাকে মুখে গুজে বাসে চেপে পড়ছে চন্দ্রা। যাচ্ছে বউবাজারে সোনার দোকানে। ঝাঁ চকচকে শোরুম। গোল্ড স্কিম চলছে ওখানে। এগারো মাসের টাকা দিলে বারো মাসের টাকা পাওয়া যাবে। তারওপর গয়নার মজুরিতে পাওয়া যাবে ২০ শতাংশ ছাড়। দোকান করতে গিয়ে সব সোনা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এমনকি বরের দেওয়া আঙটিটাও। এবারের স্কিমে এরকমই একটা আঙটি কিনবে ও। আজ তো পয়লা বৈশাখ। শুভ দিন।
ক্রশ ডিসলভ
প্যারিসের দিনগুলোর থেকে সিঙ্গাপুর একদম অন্যরকম। তবে এখান এসে বেশ ভালোই লাগছে আফসানার। অনেক বন্ধু হয়েছে ওর। ভারতীয়, সিংহলি, পাকিস্তানি। বাংলাদেশি তো আছেই। একটা ইন্টারন্যাশানাল স্কুলে পড়ায় ও। বাংলা টিচার। সিঙ্গাপুরে ব্রাঞ্চ খুলেছে নতুন। তাই একটা সেমেস্টারের জন্য ট্রান্সফার। এই মাসে গ্যাব্রিয়েল আসতে পারেনি। ওর ল্যাবে খুব চাপ। এবার উইক এন্ডেই পয়লা বৈশাখ পড়েছে। নতুন কলিগদের নেমন্তন্ন করেছে আফসানা। সব বাঙালি পদ। মোচার ঘণ্ট। এখান মোচা পাওয়া যায় না। ব্যাঙ্ককের একটা রিটেল শপ থেকে অর্ডার করিয়ে সাত খানা মোচা আনিয়েছিল। কেটেকুটে রান্না করেছে কাল সারা রাত। এখন ছাতুর লাড্ডু গড়ছে। ডেসার্ট। কতদিন আম্মুর হাতের ছাতুর লাড্ডু খায় না। টকের তরকারি। নতুন বছরের প্রথমদিন চিটাগাঙের বাড়িতে এগুলো হতই। ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে এল। বিদেশে চাকরি, তারওপর সাদা চামড়ার জামাই। মানতে পারেননি বাবা। ঢাকাতে থাকা দাদার মারফত এই কবছরে মাত্র দুবার আম্মুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু বাবা একবগ্গা। ভাবছে আজ একটা চিঠি পাঠাবে ওনাকে।
প্রেরক হবে তার আট বছরের ছেলে আবীর গ্যাব্রিয়েল ডুরান্ড। চিঠির গতও ভাবা হয়ে গেছে। পহেলার সালাম নেবেন দাদাজান। আমরা ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন। আপানার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
নতুন বছরে কাউকে ফেরাতে নেই। বাবাই বলত। আশাকরি ছোট্ট আবীরের এই আব্দার রাখবে তার স্কুল মাস্টার রাশভারি বাবা। নতুন বছরে যেন সব আশা পূর্ণ হয়।
শেয়ার করুন :