কমলেন্দু সরকার
হিন্দি সিনেমা জগতে একসময় একসঙ্গে উচ্চারিত হত তিনটি নাম– দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ। চল্লিশের দশকে হিন্দি ছবির দুনিয়ায় এই তিন নায়ক দাপিয়ে কাজ করেছিলেন। হিন্দি ছবিতে রাজ কাপুরের আত্মপ্রকাশ শিশুশিল্পী হিসেবে তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। ছবির নাম ‘ইনকিলাব’ (১৯৩৫)। পরিচালক দেবকী বসু। তারপর দু’চারটি ছবি করেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তারই মাঝে কোনও ছবিতে কাজ করেছিলেন ক্ল্যাপারের আবার সহপরিচালকের। প্রথম হিট ছবি পরিচালক কেদার শর্মার ‘নীল কমল’ (১৯৪৭)। দিলীপকুমারের প্রথম ছবি অমিয় চক্রবর্তীর ‘জোয়ার ভাটা’ (১৯৪৪)। বম্বে টকিজের এই ছবিতে দিলীপকুমারের বিপরীতে ছিলেন বাঙালি অভিনেত্রী রুমা গুহঠাকুরতা৷ তাই দিলীপকুমারের প্রথম ছবির প্রযোজক, পরিচালক, নায়িকা সবাই ছিলেন বাঙালি। এমনকী, সুরকার অনিল বিশ্বাস এবং ক্যামেরাম্যান রাধু কর্মকারও বাঙালি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই ছবির পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর সহকারী ছিলেন রাজ কাপুর। তবে দিলীপকুমারের প্রথম বক্স-অফিস হিট ছবি পরিচালক শওকত হুসেন রিজভির ‘জুগনু’ (১৯৪৭)। দেব আনন্দ-এর প্রথম ছবি পরিচালক পি এল সন্তোষীর ‘হাম এক হ্যায়’ (১৯৪৬)। বিপরীতে নায়িকা কমলা কোটনিস। ইনি ছিলেন তেলুগু ছবির নামী নায়িকা। সম্ভবত কমলা কোটনিসের প্রথম হিন্দি ছবি।
দেব আনন্দ অন্য দু’জন অর্থাৎ রাজ, দিলীপের চেয়ে এক কদম এগিয়ে ছিলেন। তাঁর প্রথম ছবিই ছিল বক্স-অফিস হিট। তিন নায়কই একসময় ছিলেন অবিভক্ত ভারতের পাকিস্তানের বাসিন্দা। এবং তিনজনেরই ছিল ভিন্ন নাম। তিনজনই বিখ্যাত হয়েছিলেন সিনেমা-নামে। দিলীপকুমারের পোশাকি নাম ইউসুফ খান, রাজ কাপুরের সৃষ্টিনাথ কাপুর আর দেব আনন্দের ধরমদেব পিশোরিমল আনন্দ।
দিলীপকুমার নামটি দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় এবং নামী অভিনেত্রী দেবিকারানি। অনেকেই বলেন, অশোককুমারের পর হিন্দি ছবির সবচেয়ে বড় তারকা দিলীপকুমার। তাঁকে বলা হত হিন্দি ছবির ট্র্যাজেডি কিং। হিন্দি ছবিতে রোম্যান্টিক কিংবা ট্র্যাজেডি চরিত্রে দিলীপকুমারের কোনও জুড়ি ছিল না। তিনিই প্রথম সমস্ত শ্রেণির দর্শকদের বেড়া ভেঙে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আজ যেমন অমিতাভ বচ্চন। হিন্দি ছবির স্বর্ণযুগের নায়িকারা, যেমন, নার্গিস, মধুবালা, নিম্মি, বৈজয়ন্তীমালা, মীনাকুমারী, ওয়াহিদা রেহমান প্রমুখ দিলীপকুমারের সঙ্গে জুটি বাঁধার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন।
ষাটের দশকের শুরুতেই হিন্দি ছবিতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল পরিচালক কে আসিফ-এর মুঘল-ই-আজম (১৯৬০)। সেলিমের চরিত্রে দিলীপকুমারের দুর্দান্ত অভিনয় সকলেরই নজর কেড়েছিল। এর পরপরই পর বৃটিশ পরিচালক ডেভিড লিন ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ (১৯৬২) ছবিটি করবেন বলে মনস্থির করেছেন। পরিচালক ডেভিড লিন ছবির শেরিফ আলির ভূমিকায় কোনও ইউরোপিয়ান অভিনেতা নিতে নারাজ। তখন দিলীপকুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি শেরিফ আলির ভূমিকায় দিলীপকুমারকে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব দিলে দিলীপকুমার তৎক্ষণাৎ তা নাকচ করে দেন।
শোনা যায়, দিলীপকুমারের সঙ্গে কামিনী কৌশল-এর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পরিচালক কিশোর সাহুর ‘নদীয়া কে পার’ (১৯৪৮) এবং পরিচালক বিভূতি মিত্রের ‘শবনম’ (১৯৪৯) ছবি দু’টি করার মধ্যবর্তী কোনও সময়ে। কিন্তু তা টেকেনি। দু’টি ছবিই ছিল বক্স-অফিস হিট। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই দিলীপকুমারের সঙ্গে মধুবালার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই ‘তারানা’ (১৯৫১), ‘সঙ্গদিল’ (১৯৫২), ‘অমর’ (১৯৫৪) ইত্যাদি ছবি করার সময় থেকেই। সেই প্রেম- ভালবাসাও পরিণতি পেল না শেষপর্যন্ত। তবে দিলীপকুমার- মধুবালার সম্পর্ক নিয়ে জল বহুদূর গড়িয়েছিল।
শেষমেশ দিলীপকুমার বিয়ে করেন সায়রা বানুকে। মুম্বাইয়ের মারাঠা মন্দিরে ‘মুঘল-ই-আজম’ দেখতে গিয়ে দিলীপকুমারের প্রেমে হাবুডুবু খান সায়রা বানু। সায়রা বানু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “উনি আমাকে দেখে যখন হাসলেন এবং বললেন, ‘খুব মিষ্টি মেয়ে।’ আমি তখন ডানা মেলে উড়ে চলেছি। এবং আমিই ওঁর গৃহিণী হব।”
ওঁদের সম্পর্কের মধ্যে কোনওদিন কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি সায়রা বানুর মা নাসিম বানু। নাসিম বানু ছিলেন তিরিশের দশকে হিন্দি ছবির প্রথম সুপারস্টার অভিনেত্রী। তাঁকে বলা হত ‘Beauty Queen’. একদিন মুম্বাইয়ে গাড়িতে যাওয়ার সময় সায়রা বানুকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন দিলীপকুমার। তখন সায়রা বানু ২২ আর দিলীপকুমার ৪৪। বিয়ে হয় ১১ অক্টোবর, ১৯৬৬। যে-গাঁটছড়া ৫৫ বছর আগে বেঁধেছিলেন তা রয়েছিল অটুট। সেই বাঁধন খুলে না-ফেরার দেশে পাড়ি দিলীপকুমার। একটা বন্ধনের শেষ, একটা যুগের ইতি ঘটল।
প্রবীণ অভিনেতা দিলীপকুমারের মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৯ বছর। আজ সকাল সাড়ে সাতটায় মৃত্যু হয় তাঁর। কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ভর্তি ছিলেন মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালে। দিলীপকুমারের মৃত্যুতে বলিউডে তো সর্বত্রই নেমেছে শোকের ছায়া। দিলীপকুমার হিন্দি তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন। তিনি অভিনয়জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। আটবার ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। এবং ১৯বার পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার মনোনয়ন। ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে সম্মানিত তিনি। পেয়েছেন পদ্মবিভূষণ। একটা যুগের শেষ হল হিন্দি সিনেমায়। চল্লিশের দশকের তিন অভিনেতা রাজ কাপুর, দিলীপকুমার আর দেব আনন্দ ছিলেন প্রায় সমবয়সি। এঁদের মধ্যে রাজ কাপুর ছিলেন সবচেয়ে ছোট। উনিই প্রয়াত হয়েছেন আগে, ১৯৮৮-তে। দেব আনন্দ দশ বছর আগে ২০১১-য় আর বয়সে সবচেয়ে বড় দিলীপকুমার প্রয়াত হলেন আজ ৭ জুলাই ২০২১। হিন্দি ছবিতে চল্লিশের দশকের যুগের শেষ।
শেয়ার করুন :