গত একবছর ধরে চলা করোনাকাল,অর্থনৈতিক অবস্থা,দেশের ও দশের দুরবস্থা,সামগ্রিক সঙ্কট আমাদের মনকে এক ধারাবাহিক বিষন্নতা, মনখারাপের কালো,ঘনমেঘে ঘিরে রেখেছে।এতদিন ধরে গৃহবন্দী, তার ওপর একাকীত্ব, অসহায়তা,উদ্বেগের সব বাঁধ ভেঙে গেলে?পৃথিবীর সবদেশে সবচেয়ে বেশি অসংখ্য মানুষ সাইকোলজিস্ট,কাউন্সিলদের কাছে পরামর্শ চাইছেন,চিকিৎসার জন্য।
ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের বিশিষ্ট সাংবাদিক এলিজাবেথ বার্ণস্টাইন বিখ্যাত ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট তথা সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট ওয়েন্ডি ট্রকসেলের ৯ লাইফ চেঞ্জিং মূল্যবান পরামর্শ জানালেন :
১) ৭/৮ ঘন্টা নির্দিষ্ট অবিচ্ছিন্ন ঘুম:ঘুমের শিডিউল।প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুমোতে যাওয়া আর ঘুম থেকে ওঠা একটা মস্তিষ্কে একটা আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্কেত পাঠায় যে আশে পাশে সব ঠিক আছে।নির্দিষ্ট সময় ঘুম থেকে উঠতে গেলে নির্দিষ্ট সময় শুতে যেতে হবে আর তার এক ঘন্টার মধ্যে স্নান,বই পড়া,গান শোনা অন্য কিছু দরকারী কাজ মিটিয়ে ফেলতে হবে।আর হ্যাঁ, গভীর রাত অবধি ফোন,ট্যাব,ল্যাপটপ কঠোরভাবে পরিত্যাজ্য।
২)রুটিন মেনে চলা:খেলোয়াড় থেকে কর্পোরেট শীর্ষকর্তা,সেলেব থেকে সাধারণ সর্বক্ষেত্রে সফল মানুষেরা একটা দৈনন্দিন রুটিন,সেল্ফ ডিসিপ্লিন মেনে চলেন। একটি প্রখ্যাত আ্যভিএশন টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানের সি ই ও স্টেডম্যান স্টিভেন প্রতিদিন দুপুরে ১৫ মিনিট একাকী নিশ্চুপ থেকে ধ্যান করেন।একটা সকালের অভ্যাস সেটা একটা ব্যালকনিতে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে চা খাওয়াও হতে পারে।ঠিক সময় খাওয়া,এক্সারসাইজ করা এই দুঃসময়ে খুবই কাজে দেবে।
৩)শান্ত থাকুন: মস্তিস্ক যদি সবসময়ে একটা ‘হাই আ্যলার্ট মোড’এ থাকে সেটা স্ট্রেস এড়ানো নয় বাড়িয়ে তোলে।দিনের শুরু হোক ১৫-২০ মিনিটের ধ্যান করে আর সারা দিনে ৪ বার ২ মিনিটের প্রাণায়াম অথবা চোখ বন্ধ করে ডিপ ব্রিথিং এক্সারসাইজ’করুন।একটা হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে কিছুক্ষন রেখে ছেড়ে দিন।
৪)কথা বলায় সতর্ক থাকুন: সারাদিনে বাড়িতে, অফিসে,বাইরে কথা বলার সময় শান্ত ও মৃদুস্বরে কথা বলার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।চিৎকার করে,কর্কশ শব্দ প্রয়োগ কখনই নয়। রিসার্চে প্রমাণিত এতে মেন্টাল স্ট্রেস বেড়ে যায়।মুড লিফটার্স প্রতিষ্ঠানের সি ই ও ডঃ ডেলডিন জানালেন ,’কথা বলার ভাষা ও শব্দের ব্যবহার আপনার অনুভূতি আর আশেপাশের সবাইকে শান্ত ও প্রভাবিত করে।
৫)স্নেহ,প্রেম,দয়া,ভক্তি : মনপ্রাণ কোমল করে তোলে তাই স্ট্রেস এড়াতে মস্তিকের ব্যায়ামের জন্য বেশি করে অভ্যাস করুন। রিসার্চে প্রমাণিত এতে উদ্বেগ,দুশ্চিন্তা,বিষন্নতা অনেক কমে যায়,মনে প্রসন্নতা,প্রেরণা,প্রত্যয় আনে।
৬) মিডিয়া ডায়েট: বিদেশে বেশ কিছু বছর ধরে চলা একটা প্র্যাকটিস।সারাদিনে ৫ মিনিটের বেশি খবর দেখেন না অনেকে কারণ অতিমারি, দুরবস্থা,দেশ বিদেশের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ‘নেগেটিভ নিউজ’ মনের ওপর সারাদিনে একটা গভীর উদ্বেগ ও বিষন্নতা সৃষ্টি করে তা থেকে মুক্তি পেতে এই ব্যবস্থা।প্রতিদিনের ‘নিউজ ক্যালোরি কাউন্ট’ করুন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সবসময় ট্রোল,কুরুচিকর,খারাপ সমালোচনা করা বন্ধু (?)দের এক্ষুণি আনফ্রেন্ড করে দিন।
৭)সচল থাকুন:এটা শুধু মনের জন্য নয়,শরীরের জন্য এমনকি হার্ট আ্যটাক এড়ানোর জন্যও।এক জায়গায় ৩০ মিনিটের বেশি বসে থাকা নয়।দিনে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা।অফিসে,বাড়িতে,কাজে কম্মে বসে থাকার মাঝে ২ মিনিট হাঁটা চলা, বিশেষত কম্পিউটারে কাজ করলে ব্রেক নিয়ে মাথা,হাত,ঘাড়, পিঠের সঞ্চালন,চোখ কিছুক্ষণ বন্ধ করে রাখলে ফ্যাটিগ,স্ট্রেস,টেনশন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
৮)রিলাক্স,মন ভাল রাখতে :কমিউনিটি ওয়ার্ক, এলাকায়,দুস্থ্য,সাহায্য প্রত্যাশীদের পাশে সাধ্যমত থাকা,একটা নতুন ভাষা শেখা, বাড়িতে টবে, বাগানে গাছ পরিচর্যা, নতুন,পুরোনো বই পড়া,গান শোনা,গান গাওয়া,বাজনা বাজানো শেখা, ছবি আঁকা (এখন কতরকম নতুন রং পেন্সিল,স্কেচ,ওয়াটার কালার পেন)।
৯)সাপোর্ট গ্রূপ: বন্ধুবৃত্তে,ফেসবুক,প্রতিবেশী,আত্মীয় স্বজন থেকে (এখানে চান্স কম,কম্পিটিশন বেশি) বেছে নিয়ে একটা সাপোর্ট গ্রূপ তৈরী করা।যারা সত্যিকারের শুভানুধ্যায়ী,উপকারী বন্ধু, লোকদেখানো স্ট্যাটাস সর্বস্ব নয় যে আজকে আপনি প্রতিষ্ঠিত তাই রোজের সখ্য আর যেই এই অতিমারির জন্য আপনি সাহায্যপ্রার্থী সঙ্গে সঙ্গে হিরণ্ময় উপেক্ষা, উদাসীনতা,নির্লিপ্তি এদের জীবন থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে সত্যিকারের সাপোর্ট গ্রূপ তৈরী করতে পারলে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে।
যিনি আমাদের ‘প্রাণের আরাম,মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ সেই রবীন্দ্রনাথের কথায়,
‘মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।’
ছবি:আই স্টক ফটো,শাটারস্টক
শেয়ার করুন :