সুমন্ত্র মিত্র
সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া একটা অটো চালকের সত্যি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।তার মেয়ের রং চাপা,বুদ্ধিমতী,ভালো ছাত্রী।গ্রাজুয়েশন শেষে তার বিয়ের সম্বন্ধ হতে এক উচ্চবিত্ত পরিবারের সুপুরুষ ডাক্তারের সঙ্গে দেখা শোনা করে বিয়ে ফাইনাল হওয়ার পর থেকেই শুরু হল মেয়েটি ও পরিবারের কাছে বন্ধু বান্ধব,আত্মীয় স্বজনের অবাক আশ্চর্য টিপ্পনির স্রোত,’বাবা তোর তো জীবন ঘুরে গেল রে?,’ইশ কি ভাগ্য’।‘অমন পাত্র অমন বাড়ি কজনের জোটে,তুই তো চাঁদে চলে যাবি রে,বাড়ি গাড়ি পেয়ে আমাদের মনে রাখবি তো?’,এমনকি সেই পাত্রেরও ফোনে জিজ্ঞাসা,’কি তুমি নিশ্চয়ই খুব খুশি আমি ও আমরা তোমাকে আর তোমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পছন্দ করেছি?’বিয়ের কিছুদিন আগে মেয়েটি কেঁদে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে,’আচ্ছা বাবা,কি করে চিরদিন আমি এই কৃতজ্ঞ আর কৃপার প্রার্থী হয়ে কুঁকড়ে দিন কাটাবো?ওখানে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সবাই আমায় মনে করাবে আমি কি লাকি?আমার কি ভাগ্য?’
অটোচালক বাবা পত্রপাঠ সবাইকে স্তম্ভিত করে বিয়ে ভেঙে দেন।পাত্র পাত্রী পক্ষ ও আত্মীয়স্বজনের মুখের ওপর সজোরে,সপাটে জানিয়ে দেন মেয়েকে এমন কৃপার জীবনের অভিশাপ দেবেন না।মেয়ে চাইলে পড়বে।প্রয়োজন হলে আর একটা অটো কিনে দেবেন,স্বাধীন ভাবে চালাবে কিন্তু যার সঙ্গে সারাজীবন থাকবে সেখানে যেন সমানাধিকার,মর্যাদা,স্নেহ ভালোবাসা পায়।অনুকম্পা,দয়া,কৃপা নয়।
প্রসঙ্গত এ বছরের নারীদিবসের থিম “DigitALL: Innovation and technology for gender equality”।এই নতুন আবিষ্কার, প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার জন্য একটি জেন্ডার-রেস্পন্সিভ দৃষ্টিভঙ্গি নারী ও মেয়েদের তাদের অধিকার এবং নাগরিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতি উন্নয়ন এবং মানবিক চ্যালেন্জের সামনে রুখে দাঁড়ানোর জন্য এবং ২০৩০র অ্যাজেন্ডা হল স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচুর সুযোগের সৃষ্টি করা। দুর্ভাগ্যবশত,নারীদের এই ডিজিটাল বিপ্লবের সুযোগ বর্তমান বেড়ে ওঠা লিঙ্গ বৈষম্যের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে । ক্রমবর্ধমান লিঙ্গ বৈষম্য ডিজিটাল দক্ষতা এবং প্রযুক্তির অ্যাক্সেসের প্রেক্ষাপটে ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর এই ডিজিটাল লিঙ্গ বিভাজনের ফলে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং রূপান্তরমূলক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তাই একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদিক যুগে ব্রহ্মবাদিনী কন্যা গার্গীকে বলা যায় অধুনিক শিক্ষিতা নারীর, বিশেষ করে অবিবাহিতা পেশাজীবী নারীদের পথিকৃৎ,যাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ মহা ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন, “স্তব্ধ হও”। প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলি থেকে প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যবতী,সর্বজয়া থেকে মহানগরের আরতি থেকে দহনের ঝিনুক,আর সাহিত্যে,সিনেমাতে যাদের কথা নেই,আমার আপনার বাড়ির সেই ঠাকুমারা যারা ১০/১১ বছরে পুতুল নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে ২০ না পেরোতেই বিধবা হয়ে সারাজীবন সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠানে ব্রাত্য হয়ে রয়ে চলে গেলেন,সেই মায়েরা যাদের বিয়ের কারণে গান,নাচ,লেখা ছেড়ে সংসার করতে হল,সে পথ ও নানা ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করে গেলেন, আর একটু একটু করে রুখে দাঁড়াতে,প্রতিবাদ করতে করতে আজকের আধুনিক মেয়েরা তাদের দু তিন প্রজন্ম আগের মা ঠাকুমার তুলনায় অনেক স্বাধীন হয়েও রাস্তায় আজকালকার ইয়াং জেনদের কথায়,এখনকার মেয়েদের সবেতে ফেমিনিজম, সবাই ফেমিনিস্ট তাহলে বাসে ট্রামে মেট্রোতে লেডিস সিট খোঁজা কেন?আজকের মেয়েরা পড়াশোনা করছে, পার্টি করছে.আগেকার মতন পর্দানশীন নয়.মনের মতন চাকরি আর কেরিয়ার করছে,এখন এত নারীদিবস নিয়ে আদিখ্যেতার কারণ কি?কারণ আজও বাসে ট্রেনে সিটের লড়াইয়ের চেয়েও ঢের বেশি কনুই বাঁচানোর লড়াই করতে হয়।
দীর্ঘ দু বছর ভয়ঙ্কর অতিমারির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েরা।সাম্প্রতিক ম্যাককিনসে রিসার্চে দেখা গেছে কোভিড কালে মেয়ের কাজের অস্থিরতা ১,৮% বেশি পুরুষদের তুলনায়।গ্লোবাল এম্প্লয়মেন্টে ৩৯% কিন্তু চাকরি গেছে ৫৪%।এর সঙ্গে যে অসংখ্য অগণিত খেটে খাওয়া পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মেয়েদের জীবন সংগ্রাম এই অতিমারিতে ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল তার কোনও পরিসংখ্যান নেই।
লেডি ব্রেবোর্নের ছাত্রী শ্রমণা মিত্রের উওমেন্স স্টাডি জার্নালে পাবলিক প্লেসে জেন্ডার ডিফারেন্স রিসার্চ পেপারে মেয়েরা তাদের ওপর রেপ,যৌন নির্যাতন,অত্যাচারের কথা নিজস্ব বয়ানে ও কলমে বলেছে। আবহমান ধরে দেশে বিদেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পাবলিক প্লেসে পুরুষদের প্রাধান্য,শাসন ও একাধিপত্যের নিদারুণ আখ্যান আছে।দৈনন্দিন পাবলিক প্লেসে এর কুপ্রভাবে আক্রান্ত এমন অজস্র সাধারণ মেয়েরা। এখনও এই আধুনিক পৃথিবীতে অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ মেয়েদের রাতে একা বেরোতে নেই, বেরোলে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দহনের পারমিতা ও নির্ভয়ার মত এমন অজস্র পরিণতি আমরা জানি।এখনও শুনতে হয় মেয়েদের পোশাক নির্যাতনের কারণ।সন্ধ্যাবেলায়, রাতে একা ফেরার সময় ওলা উবেরে এবং লোকাল ট্রেনে প্রত্যেক মেয়েরা আজও নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারে না।রাত ৯টা বেজে গেলে লোকাল ট্রেনে ফেরা মেয়েকে স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাবা বা দাদাকে সঙ্গে থাকতে হয়। না হলে অজানা আতঙ্ক তাড়া করে তাকে আর লাঞ্ছনা,নির্যাতনের শিকার হলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ উল্টে আঙ্গুল তোলে রাতে একা বেরোনোর জন্য।
কর্মক্ষেত্রে বহু নিদর্শন আছে যেখানে একই কাজে মেয়েদের বেতন পুরুষদের চেয়ে কম।এই কিছুদিন আগে অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোনকে একটি বিগ ব্যানারের ছবি থেকে বাদ পড়তে হয়েছে কারণ তার অপরাধ তিনি ছবির হিরোর সমান পারিশ্রমিক দাবি করেছিলেন।আগেকার কর্তাপ্রধান পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মা ঠাকুমারা সবাই খাওয়ার পর খেতে বসার,বাড়ির কর্তার একাধিপত্যের দিনের প্রতিতুলনায় এখন মেয়েদের স্বাধিকারের সুযোগ সুবিধে বাড়লেও পুরুষদের সঙ্গে সমানাধিকারে আজও তা যথেষ্ট কম তা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট।
“Being born a woman is an awful tragedy. Yes, my consuming desire to mingle with road crews, sailors and soldiers, bar room regulars—to be a part of a scene, anonymous, listening, recording—all is spoiled by the fact that I am a girl, a female always in danger of assault and battery. My consuming interest in men and their lives is often misconstrued as a desire to seduce them, or as an invitation to intimacy. Yet, God, I want to talk to everybody I can as deeply as I can. I want to be able to sleep in an open field, to travel west, to walk freely at night.”-Sylvia Plath, The Journals of Sylvia Plath 1950-1962.
“And our bodies, learning the habit of careful deportment in public places, speak to us steadily and clearly, saying, you are not free.”-Susan Griffin, Rape: The Politics of Consciousness, p. 77
আমেরিকান কবি,ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্ল্যাথ ও নারীবাদী দার্শনিক সুসান গ্রিফিনের বৈষ্যমের প্রতিবাদী লেখার নির্যাস পাবলিক প্লেসে একটা পরাধীনতার অসহায়ত্ব বোধ যা মেয়েরা রোজ সহ্য করে।
আজকের পৃথিবীতে মেয়েদের সমানাধিকার,তাদের স্বাধীনতা সম্মানের প্রশ্নে সজোরে প্রতিবাদ করতে হবে রোজকার জীবনে শুধু পুরুষ নয় অনেক সময়ে মেয়েদেরও কাছ থেকে শোনা এই কথার ছোবল: ‘তোমার গায়ের রং এত চাপা যে বিয়ে দিতে খুব সমস্যা হবে’।‘কি মোটা,তোকে কোন ছেলে পাত্তা দেবে ?’,’কি রোগা,তোকে কেউ ঘুরেও দেখবে না’।‘এটা তোমার বাপের বাড়ি নয় যে যা খুশি করবে’।(যিনি বলছেন তিনি খেয়াল করেন না তিনিও অন্য বাড়ি থেকে এসেছিলেন),’মেয়েদের সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়’।
এই বাংলায় প্রতিবছরের মত এবারেও তৃণমূল ৮ই মার্চ বিভিন্ন ব্লকে নারীদিবসের অনুষ্ঠান পালিত হবে।সূত্রের খবর এবারে এই রাজ্যের পাশাপাশি অন্য রাজ্যেও নারীদিবস উদযাপন করবে।প্রতি বছরই তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই পদযাত্রা করে।মহিলা নেতা-কর্মীরা পা মেলান এই পদযাত্রায়। নারী শক্তিই যে তৃণমূলের অন্যতম শক্তিবর্ধক বিভিন্ন সভায় সে কথা বলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের প্রার্থী তালিকায় নাম থেকে জনপ্রতিনিধি বাছাই,মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ রেখেছেন। একুশের বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের একটা বড় অংশের কৃতিত্বও ‘অর্ধেক আকাশ’কেই দিয়েছেন তিনি।
শেষ কথা:বছরের একটা দিন নারীদিবসে মেয়েরা নারী আর বাকি ৩৬৪ দিনে শুধুই কারুর মা,স্ত্রী,বোন,মেয়ে না থেকে বছরের ৩৬৫ দিন হোক নারীদিবস আর একই সঙ্গে পুরুষ দিবসও.তবেই অর্ধেক আকাশ থেকে বৈষম্যের কালো মেঘ সরে রোদ উঠবে।
শেয়ার করুন :